ব্যক্তিগত তথ্যের সুরক্ষা গোপনীয়তার অধিকারের অংশ। গোপনীয়তার অধিকার বাংলাদেশের সংবিধানস্বীকৃত, তবে শর্তসাপেক্ষ একটি অধিকার। ‘গৃহ ও যোগাযোগের রক্ষণ’ শিরোনামে সংবিধানের ৪৩ অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে, ‘রাষ্ট্রের নিরাপত্তা, জনশৃঙ্খলা, জনসাধারণের নৈতিকতা বা জনস্বাস্থ্যের স্বার্থে আইনের দ্বারা আরোপিত যুক্তিসংগত বাধানিষেধ সাপেক্ষে প্রত্যেক নাগরিকের ক. প্রবেশ, তল্লাশি ও আটক হইতে স্বীয় গৃহে নিরাপত্তা লাভের অধিকার থাকিবে; এবং খ. চিঠিপত্রের ও যোগাযোগের অন্যান্য উপায়ের গোপনীয়তা রক্ষার অধিকার থাকিবে।’
সংবিধানস্বীকৃত এই অধিকারের ভিত্তিতে ব্যক্তিগত তথ্যের সুরক্ষার জন্য আইন প্রণয়নের উদ্যোগ নেওয়া হলে কারোরই আপত্তি থাকার কথা নয়। তাহলে প্রস্তাবিত উপাত্ত সুরক্ষা আইন নিয়ে কেন এত আশঙ্কা? এর কারণ হলো উদ্দেশ্য হিসেবে ব্যক্তিগত তথ্যের সুরক্ষা নিশ্চিত করার কথা বলা হলেও খসড়া আইনটির সঙ্গে বহুল আলোচিত-সমালোচিত ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের (ডিএসএ) সম্পর্ক এবং আইনের কিছু ধারা নিয়ে সরকারের ‘অনড়’ অবস্থান। অবস্থাদৃষ্টে মনে হচ্ছে, ব্যক্তিগত তথ্যের সুরক্ষার কথা বলা হলেও এ আইন প্রণয়নের পেছনে ভিন্ন উদ্দেশ্যও রয়েছে।
উপাত্ত সুরক্ষা আইন, ২০২২ (খসড়া) চলতি বছরের এপ্রিল মাসে ওয়েবসাইটে দিয়ে প্রস্তাবিত আইনটি নিয়ে ‘সর্বসাধারণের’ মতামত জানতে চেয়েছিল তথ্য ও যোগাযোগপ্রযুক্তি (আইসিটি) বিভাগ। এর ফলে গণমাধ্যমসহ একাধিক দেশি-বিদেশি সংস্থা আইনটি নিয়ে তাদের আপত্তি-আশঙ্কার কথা জানায়। এরপর গত ১৬ জুলাই আইসিটি বিভাগ তাদের ওয়েবসাইটে আইনের নতুন একটি খসড়া প্রকাশ করে এবং পরের দিন ঢাকার একটি হোটেলে অংশীজনদের নিয়ে পরামর্শ সভা করে।
সেই সভায় লেজিসলেটিভ ও সংসদবিষয়ক বিভাগের সাবেক সচিব মো. শহীদুল হক তাঁর উপস্থাপনায় বলেন, খসড়াটি নিয়ে ১৯টি প্রতিষ্ঠান মতামত দিয়েছে। কিন্তু ওই দিন সভায় অংশীজনদের বক্তব্য থেকে জানা যায়, নতুন খসড়াতেও তাদের মতামতের খুব বেশি প্রতিফলন নেই। এ ঘটনা থেকে বোঝা যাচ্ছে, তেমন একটা পরিবর্তন ছাড়াই সরকার আইনটি পাস করার পরিকল্পনা করছে। সরকারের এই ‘অনড়’ অবস্থানের কারণে এ প্রশ্ন ওঠা স্বাভাবিক যে এই আইনে কী এমন আছে, যা পরিবর্তন করতে তাদের এত ‘অনীহা’।
প্রস্তাবিত এই আইনের উৎস খুঁজতে গিয়ে দেখা যায়, ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের ৬০ (২) ঝ–এর প্রদত্ত ক্ষমতাবলে ‘তথ্য গোপনীয়তা ও সুরক্ষা বিধিমালা, ২০১৯’ শিরোনামে একটি বিধিমালা তৈরির উদ্যোগ নেওয়া হয়েছিল। সরকারের তথ্য ও যোগাযোগপ্রযুক্তি বিভাগ তার একটি খসড়া ২০১৯ সালে অনলাইনে প্রকাশও করে। এ খসড়া নিয়ে তখন নানা মহল থেকে আপত্তি জানানো হয়। পরে সরকারের পক্ষ থেকে খসড়াটি ‘অফিশিয়াল’ নয় বলে তা প্রত্যাহার করে নেওয়া হয়।
কিন্তু এরপরও ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের সঙ্গে প্রস্তাবিত উপাত্ত সুরক্ষা আইনের ‘সম্পর্কচ্ছেদ’ হয়নি। সর্বশেষ খসড়া আইনের নবম অধ্যায়ে উপাত্ত সুরক্ষা কার্যালয় সম্পর্কে বিধান করা হয়েছে এবং এই কার্যালয়কে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের দ্বারা প্রতিষ্ঠিত ডিজিটাল নিরাপত্তা এজেন্সির অধীন করা হয়েছে। প্রস্তাবিত উপাত্ত সুরক্ষা আইন প্রয়োগের ক্ষেত্রে ‘একচ্ছত্র’ ভূমিকা থাকবে মহাপরিচালকের। এই মহাপরিচালক হলেন ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের অধীন নিযুক্ত ডিজিটাল নিরাপত্তা এজেন্সির মহাপরিচালক।
কিন্তু ডিজিটাল নিরাপত্তা এজেন্সির কার্যাবলি এবং ব্যক্তিগত তথ্য সুরক্ষার উদ্দেশ্য পরস্পর সাংঘর্ষিক। কেননা ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীকে ব্যক্তিগত তথ্যে নজরদারি করার ব্যাপক সুযোগ দেওয়া হয়েছে, যা ব্যক্তিগত তথ্য সুরক্ষার অধিকারকে ক্ষুণ্ন করতে পারে।
উপাত্ত সুরক্ষা আইনের ৬০ ধারা অনুযায়ী, এই আইনের অধীন সংঘটিত অপরাধের বিচার হবে তথ্য ও যোগাযোগপ্রযুক্তি আইনের দ্বারা গঠিত সাইবার ট্রাইব্যুনালে। ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে দায়ের হওয়া মামলাগুলোর বিচারও একই আদালতের এখতিয়ারাধীন।