দেশের টাকা বিদেশে পাচার হয়ে যাচ্ছে। বৈধ-অবৈধ আয় করে সেই টাকা বিদেশে পাচার করে ভোগের মাধ্যম হুন্ডি। বাংলাদেশের অনেক রাজনৈতিক নেতা, এমপি-মন্ত্রী, ব্যবসায়ী, উচ্চপদস্থ সরকারি-বেসরকারি কর্মকর্তা, আমলা-সচিব হুন্ডির সঙ্গে প্রত্যক্ষভাবে জড়িত। উচ্চশিক্ষায় বিদেশগামী শিক্ষার্থী, চিকিৎসায় বিদেশগামী, শপিং ও ভ্রমণে যাওয়া, এমনকি হজে যাওয়া যাত্রীরাও অনেক সময় হুন্ডির ওপর নির্ভর করেন। কিছু পক্ষ জেনে অর্থ পাচার করে, অন্যরা বাংলাদেশ ব্যাংক ও বাণিজ্যিক ব্যাংকের বাধায় পড়ে দরকারে হুন্ডি করে। প্রবাসীশ্রমিক ভাইবোনেরা, বিদেশে স্থায়ীভাবে বসবাসরত অনাবাসী বাংলাদেশিরা (এনআরবি), ফ্রিল্যান্সর ও ব্যবসায়ীরা ব্যাংকিং চ্যানেলে বৈধভাবে এবং হুন্ডির মাধ্যমে অবৈধভাবে দেশে টাকা নিয়ে আসেন।
মোটাদাগে প্রবাসী ও চাকরিজীবীরা বৈদেশিক মুদ্রা দেশে আনেন, রাজনৈতিক নেতা, এমপি-মন্ত্রী ও আমলারা বৈদেশিক মুদ্রা পাচার করেন, আর ব্যবসায়ীরা দুটিই করেন।
হুন্ডি ছোট সমস্যা, বড় সমস্যা পাচার। ‘ডলার ড্রেইন’ বন্ধ করতে হলে পাচার থামাতে হবে। পাচারের একটা বড় অংশের সঙ্গে অবৈধ আয় করা, চাঁদাবাজি-তদবিরে কামাই করা রাজনৈতিক নেতা, ঘুষ খাওয়া প্রশাসনিক কর্মকর্তা-আমলারা জড়িত। পাশাপাশি রপ্তানি মূল্য কম দেখিয়ে ‘আন্ডার ইনভয়েসিং’ এবং আমদানি মূল্য বেশি দেখিয়ে ব্যবসায়ীদের বৈদেশিক মুদ্রা পাচার, মোট পাচারের একটা বড় অংশ। যেহেতু পাচার বহুলাংশে ‘ক্ষমতা ও প্রভাব’ প্রশ্নের সঙ্গে জড়িত, তাই পাচার ও হুন্ডি থামাতে রাজনৈতিক সদিচ্ছা জরুরি। হুন্ডি দেশে ও দেশের বাইরে মুদ্রা আনা-নেওয়ার দ্বিমুখী চক্র। এতে ডলারসহ বৈদেশিক মুদ্রা যেমন পাচার হয়, তেমনি আসেও। হুন্ডি ঠেকাতে গেলে আগে হুন্ডি কেন হয়, সেটা বোঝা জরুরি।
ব্যাংকিং চ্যানেলে বিদেশ থেকে ডলার আনলে বা ডলার এনে ঘোষণা দিলে, সেটা বৈদেশিক মুদ্রার মজুতে জমা হয়। অর্থব্যবস্থায় নতুন টাকা তৈরি হয়, অর্থাৎ সম্পূর্ণ নতুন অর্থ বা সম্পদ সৃষ্টি হয়। কিন্তু বৈদেশিক মুদ্রা এনে ঘোষণাহীন রাখলে কিংবা হুন্ডি চ্যানেলে অর্থ আনলে সেটা রিজার্ভে জমা হয় না, ফলে নতুন সম্পদও তৈরি হয়, তবে মানুষের অর্থের প্রয়োজন মিটে। সরকারি নজরদারি, ব্যাংকে ঘুষ ও হয়রানি, ব্যাংক ফি, অগ্রিম আয়কর, ব্যাংকের নিম্ন মুদ্রা বিনিময় হার এবং বিভিন্ন পেপার ওয়ার্কের বহুবিদ ঝামেলা ও আর্থিক লোকসান ইত্যাদি এড়াতে লেনদেনের উল্লেখযোগ্য অংশ হুন্ডিতে সম্পন্ন হয়। বড় প্রশ্ন হচ্ছে, মানুষ কেন হুন্ডি করে? কেন বৈদেশিক মুদ্রা দেশে আনতে কিংবা বাইরে নেওয়ার প্রয়োজনে ব্যাংকে যায় না?
অগ্রিম আয়করে যত ভয়
সরকার কাঁচামাল আমদানিতে শুল্ক ছাড় দিয়ে রপ্তানি আয় দেশে ফেরামাত্রই অগ্রিম আয়কর বা এআইটি কেটে রাখে। ফলে রপ্তানি আয়ের একটা অংশ বিদেশে রাখতে, কিংবা পরবর্তী আমদানির জন্য রপ্তানিকারক ডলার বা বৈদেশিক মুদ্রা না ভাঙানোর ঝোঁক দেখান ব্যবসায়ীরা। বর্তমান এআইটি পদ্ধতি ভালো, নাকি কাঁচামাল আমদানিতে শুল্ক ছাড় বন্ধ করে অগ্রিম আয়কর বন্ধ করা ভালো, এটা গবেষণার বিষয় হতে পারে। অভিযোগ আছে, এআইটি থেকে বাঁচতে ব্যবসায়ীরা বিদেশি বায়ারের যোগসাজশে রপ্তানির এলসি মূল্যমান কম দেখিয়ে বাকিটা হুন্ডিতে সেটেল করেন।
নতুন নতুন পদক্ষেপ হুন্ডিতে উৎসাহ দেবে কী
বাংলাদেশ ব্যাংক তাৎক্ষণিকভাবে রপ্তানিকারকের বৈদেশিক মুদ্রায় খোলা ইআরকিউ (এক্সপোর্ট রিটেনশন কোটা) অ্যাকাউন্টের স্থিতি পূর্বের হারের দ্বিগুণ নগদায়নের নির্দেশ দিয়েছে। ইআরকিউ স্থিতি বর্ধিত রাখার উদ্দেশ্যই ছিল রপ্তানিকারকের নিয়মিত আমদানি ও তাৎক্ষণিক প্রয়োজন মেটানোর ডলার সংরক্ষণ করা, বিভিন্ন পেমেন্ট ঝামেলামুক্ত ও দ্রুত করা। এতে ব্যবসায়ীরা ডলারকে টাকায় ভাঙিয়ে আবার দ্রুতই ডলার কেনার উপর্যুপরি ‘কনভারশন লস’ থেকেও বাঁচতে পারে। পাশাপাশি নেট ওপেন পজিশনের (এনওপি) সীমা কমিয়ে ১৫ শতাংশ করায় বাণিজ্যিক ব্যাংকের এলসি বা ঋণপত্র খোলার সেবা সক্ষমতাও কমবে। পাশাপাশি রপ্তানিকারকদের ইআরকিউ ব্যালেন্সের ‘মেয়াদি আমানত’ নগদ করতে বলা হয়েছে।