আহমদ ছফার সর্বাধিক আলোড়িত প্রবন্ধ 'বাঙালি মুসলমানের মন'। বাংলা সাহিত্যেও বোধ করি এর অবস্থান ঈর্ষণীয়। বিদ্বৎসমাজ ও বুদ্ধিজীবী মহলের প্রতিনিধি স্থানীয়দের কয়েকজন প্রবন্ধটিকে দিয়েছেন শ্রেষ্ঠ প্রবন্ধের তকমা ও মান্যতা। যার সঙ্গে আমার রয়েছে বিস্তর দ্বিমত এবং একমত হতে না পারার সদর্থক অনুযোগ।
'ছফার মতো' এই দেশটাকে যারা কেবল ভালই বাসেন না, সহানুভূতির সঙ্গে আত্ম নিবেদন করেন দেশ ও জনপ্রেমে এবং বুদ্ধিজীবীর ধর্মে রাখেন মনন ও সৃজন চর্চার যাবতীয় চ্যালেঞ্জ গ্রহণের অমিত সাহস, তারা বোধ করি একমত হবেন ছফার শ্রেষ্ঠ প্রবন্ধ 'সাম্প্রতিক বিবেচনা: বুদ্ধিবৃত্তির নতুন বিন্যাস'। এই ছাড়া অন্যকোন প্রবন্ধ কিংবা 'বাঙালি মুসলমানের মন' কে সে কাতারে রাখিনা।
তাহলে কেন অধিকাংশ 'বাঙালি মুসলমানের মন'কেই ছফার প্রতিনিধি জ্ঞান করল এবং চর্চা জারি রাখল সেই প্রশ্নের উত্তর তালাশে করব। বাঙালি মুসলমানের মানস গঠনের দীর্ঘ ভ্রমণকে তিনি ছোট্ট একটা প্রবন্ধের মধ্যে দিয়ে যেভাবে ধরতে পেরেছেন, তা শুধু বিস্ময়কর ও অভূতপূর্ব নয়, তুলনারহিত। মাত্র ২০ পৃষ্ঠার একটা প্রবন্ধ, উত্তর ভূমিকা সমেত ২৮ পৃষ্ঠা। যা লেখা হয়েছিল ১৯৭৬ সালে, গ্রন্থভূক্ত হয়ে প্রকাশিত হয় ১৯৮১ সালে।
স্বল্পায়তনের প্রবন্ধটি হয়ে উঠেছে একটা জাতির বোঝাবুঝির গুরুত্ববহ দলিল বিশেষ। 'বাঙালি মুসলমানের মন' পড়ে আমরা যেন নিজেদেরকেই আবিষ্কার করি। প্রবন্ধটির বয়স পঞ্চাশের কাছাকাছি হয়ে এলেও তার মানস গঠনে কোনো পরিবর্তন কিংবা উন্নতিতো ঘটেইনি বরং অবনমন হয়েছে এবং প্রবন্ধে চিহ্নিত স্বর ও সুর ধরতে হয়েছেন অপারগ, এবং সতত চেষ্টা জারি রাখার যে কোশেশ ও অধ্যবসায় প্রয়োজন তা থেকে রেখেছেন নিরাপদ দূরত্ব ও বিস্তর ব্যবধান। বাঙালির বিদ্বৎ ও বুদ্ধিজীবী সমাজ তারপরেও এই প্রবন্ধকে যেভাবে গ্রহণ করেছেন, 'সাম্প্রতিক বিবেচনা: বুদ্ধিবৃত্তির নতুন বিন্যাস'কে নয়। কারণ এই প্রবন্ধে ছফা ব্যক্তির চেয়ে সমষ্টির দায় ও ব্যর্থতাকে অন্বেষণ করেছেন।
বাঙালি মুসলমানের এই সীমাবদ্ধতার পেছনে তিনি বাঙালিকেও যেমন দায়ী করেননি তেমনি মুসলমানের ওপরও কোনো প্রকার দোষারোপও দেননি। তিনি বলেছেন, 'বাঙালি মুসলমানের মন যে এখনো আদিম অবস্থায় তা বাঙালি হওয়ার জন্যও নয় এবং মুসলমান হওয়ার জন্যও নয়। সুদীর্ঘকালব্যাপী একটি ঐতিহাসিক পদ্ধতির দরুন তার মনের উপর একটি গাঢ় মায়াজাল বিস্তৃত রয়েছে, সজ্ঞানে তার বাইরে সে আসতে পারে না। তাই এক পা যদি এগিয়ে আসে, তিন পা পিছিয়ে যেতে হয়। মানসিক ভীতিই এ সমাজকে চালিয়ে থাকে। দু' বছরে কিংবা চার বছরে হয়ত এ অবস্থার অবসান ঘটানো যাবে না, কিন্তু বাঙালি মুসলমানের মনের ধরন-ধারণ এবং প্রবণতাগুলো জানার চেষ্টা করলে এ অবস্থা থেকে বেরিয়ে আসার একটা পথ হয়ত পাওয়াও যেতে পারে।'