কোভিড যে শুধু আতঙ্ক ছড়িয়েছে, মৃত্যুর মিছিল দেখিয়েছে তাই নয়- অবচেতনভাবে আমাদের কিছু মঙ্গলও করে দিয়েছে। আমরা যখন প্রাইমারি শিক্ষার্থীদের ওপর পিইসি নামের তথাকথিত পাবলিক পরীক্ষা চাপিয়ে দেওয়াকে ভয়ানক ক্ষতিকর ও অপ্রয়োজনীয় বলে লিখে যাচ্ছিলাম, শিশুশিক্ষার্থীদের পরীক্ষার এতসব অক্টোপাস থেকে মুক্ত করার কথা বলছিলাম তখন পিইসি পরীক্ষার পক্ষে এমন সব সাফাই বক্তব্য সরকারের ঊর্ধ্বতন জায়গা থেকে বলা হচ্ছিল, শুনে মনে হচ্ছিল আমাদের নতুন করে ধারাপাত শেখানো হচ্ছে। কোভিড এসে সব লণ্ডভণ্ড করে দেওয়ার পর সবকিছু সামাল দিতে সংকটে পড়ে যায় সরকার। তখন নিজেরাই সরে আসে পিইসি থেকে। এই সরে আসাটা সাময়িক না স্থায়ী তা অবশ্য এখনো বুঝতে পারছি না।
তবে আমরা যে সার্বিক বিচারে লক্ষ্যহীন শিক্ষাযাত্রায় ছুটছি তা পরিপার্শ্বের বাস্তবতা দেখলেই বোঝা যায়। ঢাকা শহরে চল্লিশোর্ধ্ব এক মায়ের গল্প এখানে যুক্ত করছি। আমি জানি, চারপাশের বাস্তবতা দেখে অভ্যস্ত পাঠক এ গল্পে মোটেও চমকে যাবেন না। এই আধুনিক গৃহবধূ আমার পরিচিত। তিনি দুঃখ করছিলেন তার মেয়েটিকে নিয়ে। মেয়েটি পড়াবিমুখ হয়ে যাচ্ছে। পড়ার টেবিলে জোর করে বসাতে হয়। কিন্তু পড়ায় তেমন মন থাকে না। আমি সবিস্তারে জানলাম। মেয়েটি ঢাকার এক নামি বিদ্যালয়ে ক্লাস ফাইভে পড়ে। স্কুল ছুটির পর মা এক কোচিং সেন্টারে নিয়ে যান। সেখানে একটি বিষয়ের চর্চার পর বাড়ি আসেন। নাকে-মুখে খেয়ে দুপুর আড়াইটা থেকে সাড়ে চারটা পর্যন্ত আরও দুটি বিষয় পড়ার জন্য কোচিং সেন্টারে যেতে হয়। বাসায় এসে ক্লান্তির রেশ না কাটতেই সন্ধ্যায় একজন গৃহশিক্ষক আসেন অঙ্ক করাতে। সাতটায় শিক্ষক চলে যাওয়ার পর একটু নাস্তার বিরতি। আটটায় মা পড়তে বসান। এখানেই মেয়ে বিদ্রোহ করে, পড়তে চায় না। শুনে আমি বললাম এইটুকুন মেয়ে সারাদিনই তো পড়ার মধ্যে রইল, তা হলে আবার কেন? ওর মায়ের উক্তি এগুলো তো সব স্কুল আর কোচিং করা, আসল পড়া তো তাকে পড়তে হবে! আমি ছোট্ট মেয়েটির করুণ চোখের দিকে তাকালাম। এই গৃহবধূরও যুক্তি আছে। বললেন সামনে পিইসি পরীক্ষা। ভালো ফল না করলে ওর ভবিষ্যৎ কী! অকাট্য যুক্তি।