কবি কাজী কাদের নেওয়াজের 'শিক্ষাগুরুর মর্যাদা' কবিতা কমবেশি সবারই জানা। কবিতার কিছু পঙক্তি এরকম—বাদশাহ্ কহেন, "সেদিন প্রভাতে দেখিলাম আমি দাঁড়ায়ে তফাতে/নিজ হাতে যবে চরণ আপনি করেন প্রক্ষালন/পুত্র আমার জল ঢালি শুধু ভিজাইছে ও চরণ/নিজ হাতখানি আপনার পায়ে বুলাইয়া সযতনে/ধুয়ে দিল না'ক কেন সে চরণ, স্মরি ব্যথা পাই মনে।" মোগল বাদশাহ আলমগীর শিক্ষকের মর্যাদাকে এই পর্যায়ে আসীন করেছিলেন।
সমাজে একজন শিক্ষকের অবস্থান অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। তিনি ধর্ম-বর্ণ, জাত-পাত সবকিছুর ঊর্ধ্বে। কিন্তু, সাম্প্রতিক সময়ে শিক্ষক লাঞ্ছিতের ঘটনা তো ঘটেছেই, এমনকি শিক্ষককে পিটিয়ে হত্যাও করা হয়েছে। সর্বশেষ রাজশাহীর সরকার দলীয় সংসদ সদস্য ওমর ফারুক চৌধুরীর বিরুদ্ধে স্থানীয় এক কলেজের অধ্যক্ষকে মারধরের অভিযোগ উঠেছে। গতকাল যদিও সংবাদ সম্মেলনে ওই অধ্যক্ষ বলেছেন, সংসদ সদস্য তাকে মারেননি। কিন্তু, স্থানীয়রা বলছেন, সংসদ সদস্যের ভয়ে বাধ্য হয়েই তিনি এখন এ কথা বলছেন।
একজন সংসদ সদস্য একজন অধ্যক্ষকে মারধর করেছেন বলে অভিযোগ ওঠার পরে আবার সংবাদ সম্মেলনে ওই অধ্যক্ষ যে তা অস্বীকার করলেন, এ ঘটনা থেকে কী বার্তা পাওয়া যায়? এ বিষয়ে দ্য ডেইলি স্টার কথা বলেছে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের পদার্থ বিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক ড. কামরুল হাসান মামুন, আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগের অধ্যাপক তানজিম উদ্দিন খান এবং গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগের অধ্যাপক ড. কাবেরী গায়েনের সঙ্গে।
তাদের মতে, একজন অধ্যক্ষকে মারধর করার পরে ভয় দেখিয়ে তা অস্বীকার করতে বলার ঘটনা অত্যন্ত ন্যক্কারজনক। এর মাধ্যমে সমাজ আরও কয়েক ধাপ নিচে নেমে গেল। এ ধরনের ঘটনাই প্রমাণ করে যে, দেশে শিক্ষার মান তলানিতে এসে ঠেকেছে। পাশাপাশি সমাজে নেই কোনো ন্যায্যতা-জবাবদিহিতা।
একজন অধ্যক্ষকে মারা যেমন অপরাধ, ভয় দেখিয়ে তাকে দিয়ে উল্টো কথা বলানো তারচেয়েও বড় অপরাধ বলে মনে করেন অধ্যাপক কামরুল হাসান মামুন। তিনি বলেন, 'একজন শিক্ষককে মারার পর ভয় দেখিয়ে আবার উল্টো কথা বলানো আরও বেশি ভয়ংকর। ভয়ের একটা সংস্কৃতি তৈরি করা হলো। মারধর করবে, কিন্তু বিচার চাওয়া যাবে না। এই যে একটা সংস্কৃতি যোগ হলো, এর মাধ্যমে সমাজ আরও কয়েক ধাপ নিচে নেমে গেল। ওই শিক্ষকের তো ক্ষমতা নেই। আজ থেকে ৩০ বছর আগে কেউ একজন শিক্ষকের গায়ে হাত তুলত না। কেউ যদি তোলার সাহস দেখাত, তখন শিক্ষকদের পাশাপাশি আমাদের শিক্ষার্থীরাও প্রতিবাদ করতেন। এই যে এখন আমাদের শিক্ষকরা রাজনীতি করেন, শিক্ষার্থীরা করেন, কী জন্যে করেন? কোথায় তারা? এই শিক্ষক যে মার খেলেন, কীভাবে তার প্রতিবাদ করা সম্ভব যেখানে সমাজ চুপ করে আছে? আমাদের শিক্ষক সমিতি কোথায়? শিক্ষক নেতারা কোথায়? বাংলাদেশজুড়ে যে শিক্ষার্থীরা আছেন, তারা কোথায়?'
অধ্যাপক কামরুল হাসান মামুনের ভাষ্যমতে, 'অন্য যে কোনো পেশার চেয়ে শিক্ষকতা আলাদা। কারণ, জ্ঞানও পানির মতো প্রবাহিত হয়। প্রবাহিত হওয়ার জন্য একটা ঢাল লাগে। পানি প্রবাহের জন্য যেমন উঁচু-নিচু ঢাল লাগে, তেমনি জ্ঞান প্রবাহের জন্য লাগে সম্মানের ঢাল। অর্থাৎ শিক্ষককে উচ্চস্থানে না বসালে শিক্ষার্থীর মধ্যে জ্ঞানটা আসবে না। আমাদের সমাজটা এখন এমন এক জায়গায় চলে গেছে যে, শিক্ষককে আর উচ্চস্থানে বসাতে চায় না। যেজন্য জ্ঞানের প্রবাহের সেই অবস্থাও এখন নেই। সমাজের মানুষরাও কিন্তু কোনো প্রতিবাদ করছে না।'