আমি সরাসরি রাজনীতি কখনো করিনি। এমনকি ছাত্রজীবনেও কোনো রাজনৈতিক দলের লেজুড়-ছাত্র সংগঠনের সঙ্গে যুক্ত হইনি। তবে মতাদর্শ তথা জাতীয় স্বার্থ বিবেচনায় কোনো না কোনো রাজনৈতিক দলের বা ছাত্র সংগঠনের সমর্থক ছিলাম। ভোটের সময়ে সে সমর্থন কাজেও লাগাতাম। হক-ভাসানীর যুক্তফ্রন্টের নির্বাচনের সময়ে ছোট ছিলাম, কিছু বুঝিনি, পরে পড়ে জেনেছিলাম। ১৯৫৮-এর আইয়ুব খানের মার্শাল ল’র উত্তাপ আমরা অজপাড়াগ্রামেও টের পেয়েছি। আমরা বলতাম, আমের টরি জামের টরি-আইলোরে ভাই মিলিট্টরি। টরি অর্থ আম বা জামের ছোট্ট মুকুল-অবস্থা। কেন এবং কীভাবে যে ‘ছেলে ঘুমালো, পাড়া জুড়ালো, বর্গী এলো দেশে’র মতো এ আমের টরি আর জামের টরি চালু হয়েছে-তা আজও জানি না। আমার দেখামতে, এই আইয়ুবের সামরিক আইন বস্তুত প্রকৃত সামরিক আইন ছিল। আমরা ছোটরা দৈনিক সকাল-বিকাল দুবার বাড়ির আঙ্গিনার পাতা পর্যন্ত ঝাড়ু দিয়ে পরিষ্কার করতাম, পুকুরপাড়ের গাছ পর্যন্ত সরদারদের চিহ্নিত মতে কেটে ফেলা হয়েছিল, যাতে পাতা পড়ে পুকুরের পানি দূষিত না হয়। আর হাঁস-মুরগির পা ধরে মাথা ঝুলিয়ে বহন তো হতোই না বেতের ভয়ে। মার্শাল ল’র সে রাজনৈতিক উত্তাপ শেষ হতে না হতেই ১৯৬২’র শিক্ষা কমিশন রিপোর্টের বিরুদ্ধে বড়দের সঙ্গে ষষ্ঠ শ্রেণিতে থাকতেই মিছিলে যোগ দিলাম। তবে ১৯৬৫’র ৬ সেপ্টেম্বর পাক-ভারত যুদ্ধ শুরু হলে আমরা ভারতের বিরুদ্ধে স্লোগান দিতে দিতে সীমান্তের কাছেই চলে গেলাম যেন। তারপর ১৯৬৬’র ৬ দফা, ১৯৬৯’র গণঅভ্যুত্থান, ১৯৭০-এর নির্বাচন, ১৯৭১-এর ৭ মার্চ, এরপর স্বাধীনতা যুদ্ধ-পরেরগুলো তো অনেকটা বড় হয়েই জেনেশুনে সচেতনভাবে দেখলাম ও জড়ালাম। রাজনৈতিকভাবে ভোটের জন্য প্রথম সরাসরি মিছিলে-মিটিংয়ে ১৯৭০ দিয়েই শুরু। আর আপাতত সর্বশেষ সম্পৃক্ততা ছিল ৩০ ডিসেম্বর ২০১৮-এর জাতীয় নির্বাচনে, স্থানীয় সংসদ সদস্যের নির্বাচনে। মজার বিষয় হলো-সক্রিয়ভাবে জড়ালেও কারও দলীয়-লেজুড় হইনি কখনো। তবে নির্বাচন নিয়ে আমার আগ্রহের কমতি কখনো ছিল না, বিচার-বিশ্লেষণে তো অপার আনন্দ রয়েছেই। তারই ফলে কলামেও আমার বিবেচ্য বিষয় থাকে প্রশাসন আর রাজনীতি।
গত ১৫ জুন অনুষ্ঠিত কুমিল্লা সিটি করপোরেশন (কুসিক) নির্বাচন নিয়ে আমার বেশ আগ্রহ ছিল দীর্ঘ ২৯ বছর পর কুমিল্লা পৌরসভা/সিটি করপোরেশন নির্বাচনে আওয়ামী লীগ জয়ী হতে পারবে কিনা ভেবে। কুমিল্লা পৌরসভার বয়স কিন্তু কম নয়, ১৮৯০ সালে প্রতিষ্ঠিত। ১৯৮৪ এবং ১৯৯৪ দুবার আ ক ম বাহাউদ্দিন বাহার, সংসদ-সদস্য, পৌরসভায় আওয়ামী লীগের সর্বশেষ চেয়ারম্যান। এবারের নির্বাচিত মেয়র আরফানুল হক রিফাতকে বাহারের শিষ্য বলা হয়। জয়ের পরও বলা হচ্ছে, বাহারের মদদেই রিফাত উতরে গেছেন। ভোটের ব্যবধান মাত্র ৩৪৩ হলেও জিতেছেন তো, নাকি? এ নির্বাচনে প্রথম তিন শীর্ষসংখ্যার ভোটের অধিকারী রিফাত ৫০,৩১০, মনিরুল হক সাক্কু ৪৯, ৯৬৭ এবং নিজাম উদ্দিন কায়সার ২৯,০৯৯ ভোট। কুমিল্লার রাজনীতিতে আওয়ামী লীগের দুনেতার দুগ্রুপ যে নিজেদের মধ্যে প্রভাব বিস্তারে ব্যস্ত থাকত, তাতো কম-বেশি সবাই জানে। বর্তমান সংসদ-সদস্য বাহাউদ্দিন বাহারের এবং প্রয়াত নেতা আফজাল খানের ক্ষমতার দ্বন্দ্ব আওয়ামী লীগকে বরং বেকায়দায়ই ফেলত। এদের দুজনের বিবাদের সুযোগ পেত অন্য প্রার্থী। ফলে আওয়ামী লীগ প্রার্থী হারত। আফজাল খানের মেয়ে আঞ্জুম সুলতানাও গত নির্বাচনে এ কারণেই হেরেছেন মর্মে বলা হয়ে থাকে। এবারের ভিন্ন স্বাদ হলো, নিজাম উদ্দিন কায়সারও মনিরুল হক সাক্কুর মতো বিএনপির লোক। প্রদত্ত ভোটের শতকরা ভাগে ২০১২ ছিল ৭৩ শতাংশ, ২০১৭ বেড়ে হয় ৮০ শতাংশ; কিন্তু এবার কমে হয়ে পড়ে ৫৯ শতাংশ (৫৮.৭৪)। এবারের নির্বাচনে ১০৫ কেন্দ্রের মধ্যে ১০১টিতে সাক্কু ভোটে এগিয়ে ছিলেন, কিন্তু শেষ চারটিতে তিনি ৩৪৩ ভোটে পিছিয়ে পড়ে হেরে যান। অর্থাৎ এ চার কেন্দ্রে রিফাত পিছিয়ে থাকা ৬০০ সমান করে আরও ৩৪৩ ভোট বেশি পান। তাহলে মানেটা দাঁড়ায় এ চার কেন্দ্রই জয় নির্ধারক। সাক্কুর অভিযোগ এ চার কেন্দ্রের ফল ঘোষণায় বিলম্বের কারণেই তার পরাজয় হয়েছে। আমরা ইঙ্গিতটা বোধহয় এমন অর্থবহ হিসাবে ধরে নিতে পারি যে, এ চার কেন্দ্রে কোনো না কোনোভাবে তাকে ‘হারিয়ে’ দেওয়া হয়েছে। সাক্কু মামলাও করতে পারেন মর্মে খবর বেরিয়েছে। নিজেদের মধ্যে ভোট ভাগাভাগিতে হেরেছেন-এ কথা কিন্তু সাক্কু বলছেন না।