দ্বিপ্রহর তখন। অফিসে ঢুকতেই টেলিভিশনের পর্দায় ভেসে উঠল ‘সাংবাদিক আবদুল গাফ্ফার চৌধুরী আর নেই।’ জানতাম গাফ্ফার চৌধুরী অসুস্থ, কিছুদিন ধরেই হাসপাতালে আছেন। তবু তার এই চিরপ্রস্থানের খবর বিশ্বাস হচ্ছিল না। কয়েক দিন আগে তার এক কন্যার মৃত্যু হয়েছে। এক দিন ফোনে, কন্যার কথা বলতে গিয়ে কিছুক্ষণ কাঁদলেন। তারপর ভারী গলায় বললেন, ‘আমিও বুঝি আর বেশি দিন বাঁচব না।’
গাফ্ফার চৌধুরীকে স্বচক্ষে দেখতে না পেলেও স্পষ্ট বুঝতে পারছিলাম, কথা বলতে তার কষ্ট হচ্ছে। অস্বস্তি হচ্ছে। তার পরও বললেন, ‘বুকের ভেতরটা কেমন ফাঁকা লাগে। আমার সমবয়সী কিংবা আমার থেকে বয়সে ছোট অনেকেরই মৃত্যু হয়েছে। আমি বেঁচে আছি। কিন্তু অসুস্থ অবস্থায় হাসপাতালে শুয়ে স্মৃতি হাতড়াই আর ভারাক্রান্ত হই।’ হয়তো তার এ চিন্তা আজকাল আমাদের কারও কারোর মনে গ্রোথিত হচ্ছে। মৃত্যু চিন্তা আমাদের সবাইকে ছুঁয়ে যায়। নানান ঘটনায় আমাদের ঘিরে ফেলছে। বাংলাদেশের রাজনৈতিক পরিস্থিতি নিয়ে তার মনে এক ধরনের হতাশা তৈরি হয়েছে বলেও মনে হলো। বললেন ‘আওয়ামী লীগ পথ হারিয়েছে...।’ এ-কথা বলার সাহসও তার ছিল। এও বললেন, ‘বাম রাজনীতিটাও দিকবিচ্ছিন্ন হয়ে গেছে। তারা তাদের লক্ষ্য থেকে অনেকটা দূরে সরে গেছে।’ বাম রাজনীতির প্রতি তার সমর্থন ছিল না। কোনো কোনো ক্ষেত্রে তার দ্বিমত ছিল। তাতে বিদ্বেষ ছিল না। তার বড় প্রত্যাশা ছিল, চেয়েছিলেন বাম রাজনীতি প্রগতিধারাকে শক্তিধর করুক। দ্বিধাবিভক্ত ছাড়াই বাংলাদেশে নেতৃত্ব দিক।
‘আগাচৌ’। সংক্ষেপে এ নামে বেশি পরিচিত তিনি। তাকে নিয়ে অনেকের অনেক রকম মতামত ও দৃষ্টিভঙ্গি আছে। সমালোচনাও আছে। সেটাকে বিনয়ের সঙ্গে গ্রহণ করার গুণ সবার থাকে না। আগোচৌর ছিল। কিন্তু অপশক্তির বিরুদ্ধে লড়াই করার জন্য যে কলম হাতে নিয়েছিলেন গাফ্ফার চৌধুরী, বায়ান্নর ভাষা আন্দোলন থেকে শুরু করে সেটা বাংলাদেশের স্বাধীনতাযুদ্ধ এবং পরবর্তীকালেও তা অব্যাহত রেখেছিলেন। সারাজীবন সোচ্চার এমন কলমসৈনিক জীবন থেকে হারিয়ে গেলেন।