গত চার দশকে যখনই লন্ডন গেছি তখনই আবদুল গাফ্ফার চৌধুরীর সঙ্গে দেখা করেছি। তিনি আমার বাবার সঙ্গে চাকরি করেছেন। আমার বড় চাচা প্রয়াত বোরহানউদ্দিন খান জাহাঙ্গীরের কৈশোরের বন্ধু। আমাকে দেখেছেন জন্ম থেকেই। সুতরাং আমি তাঁর স্নেহের পাত্র। কিন্তু তাঁর গুণেই আমাদের সম্পর্কটা হয়ে গেছে বন্ধুর মতো।
আমি অনেকদিন তাঁকে বলেছি, একটি স্মৃতিকাহিনি লেখার জন্য। এর অনেকটাই তিনি লিখেছেন। প্রকাশিতও হয়েছে কাগজে। এসব মিলিয়ে একটি পাণ্ডুলিপি তৈরি করা এখনও তাঁর পক্ষে সম্ভব হয়নি।
মুনতাসীর মামুন: আমরা এখান থেকে আবার একটু সিস্টেমিটিক্যালি আসি। এতক্ষণ তো আমরা আপনার সাংস্কৃতিক, সাহিত্যিক এসব আন্দোলন এবং এ বিষয়ে জানলাম। আপনি এর পরে নিজেই উল্লেখ করেছেন যে, আপনি প্রথমত সাংবাদিক হিসেবে পরিচিত হয়ে উঠেছেন সাধারণ মানুষের কাছে এবং আপনি আগে বলেছেন যে সেই পঞ্চাশের দশক থেকে সাংবাদিকতার সঙ্গে যুক্ত। ষাটের দশক পর্যন্ত আপনার সাংবাদিক জীবনের একটি বিবরণ যদি দেন তাহলে আমাদের আলোচনাটা আরও সুসম্পন্ন হয়।
আবদুল গাফ্ফার চৌধুরী: আমি মেট্রিক পাস করে ঢাকা এসেই জীবিকার জন্য প্রথম দৈনিক ইনসাফ নামে বিরোধীদলের একটা কাগজ ছিল মানে মুসলিম লীগ শাসনের বিরোধী। সেটা ছিল ট্রান্সলেটরের কাজ। সেটি সাংবাদিকতার কাজ আমি বলব না। নিউজ টেবিলে বসে ইংরেজি নিউজ আসত সেগুলো বাংলা করা। সেখান থেকে দৈনিক সংবাদ বের হলো, মুসলিম লীগের কাগজ তাতে যাই। সংবাদ থেকে আমি কিছুদিন সাংবাদিকতা করিনি কারণ অনার্স পরীক্ষা দেওয়ার জন্য কিছুকাল, ইউনিভার্সিটিতে যখন পড়ি তখন আমি এই ডেস্কের কাজ থেকে নিজেকে গুটিয়ে নিই। এর সময় পড়াশোনাও করতে পারব সাংবাদিকতাও করতে পারব তখন আমি- সম্পাদকীয় বিভাগে সম্পাদকীয় লেখার কাজে যোগ দিই। দৈনিক মিল্লাত ছিল ইউসুফ আলী চৌধুরীর কাগজ, সেখানে আমি সম্পাদকীয় লেখা শুরু করি। তারপর ইত্তেফাকে লেখা শুরু করি। তারপর আজাদে লেখা শুরু করি। এবং সম্পাদকীয় লিখতে লিখতে কলাম লেখা শুরু করি। তখন থেকে আমি নিজের নামে লিখলে নিজের মত প্রকাশের স্বাধীনতা দেওয়া হোক। প্রথম প্রথম যে পেরেছিলাম তা নয়। প্রথম হয়তো যে পত্রিকায় চাকরি করতাম তার মতেই লিখতাম।
পরে যখন কলাম একটু জনপ্রিয় হলো তখন এই বার্গেনিংটা মালিকদের সঙ্গে করতে পেরেছি। পূর্বদেশ-এর সঙ্গে করতে পেরেছি, আজাদের সঙ্গে করতে পেরেছি। নিজের নামে যখন লিখতাম- তবে নিজের মতটাই লিখতাম। সেটা ছিল অনেকটাই আওয়ামী লীগ ঘেঁষা। যদিও আমি আওয়ামী লীগের কোনো মেম্বার হইনি, কিন্তু আওয়ামী লীগের শহীদ সোহরাওয়ার্দীর পরবর্তী পদক্ষেপগুলো মানে শেখ মুজিবুর রহমানের নেতৃত্বে আসার পরে আওয়ামী লীগের সঙ্গে অনেকটা সম্পর্ক ঘনিষ্ঠ হয়। তার আগ পর্যন্ত শহীদ সোহরাওয়ার্দীর নেতৃত্বকে আমি কখনও পছন্দ করিনি। সব সময় মনে করতাম যে বাংলাদেশের স্বার্থ বিকিয়ে দিচ্ছে। তার ফলে কলামটা যেহেতু আওয়ামী লীগকে সমর্থন করার মানে হতো যখন বাংলা ভাষা, বাংলা সংস্কৃতিকে সমর্থন করা, বাঙালির স্বায়ত্তশাসনের আন্দোলনকে সমর্থন করা, বাঙালির স্বাধীকার আন্দোলনকে সমর্থন করা। ফলে আমার লেখা বেশ কিছুটা লেখনির জোরে না হলেও তখনকার রাজনৈতিক পরিবেশের জোরে অনেকটা বেশি জনপ্রিয়তা অর্জন করেছে এবং আমি নিজেকে একজন কলামিস্ট হিসেবে তখনই, ষাটের দশকেই প্রতিষ্ঠা করতে পেরেছি।