দন্তচিকিৎসক আহমেদ মাহী বুলবুল খুন হয়েছেন। ভোরের ঢাকায় তাঁর ছুরিবিদ্ধ রক্তাক্ত দেহ পড়ে ছিল রাজধানীর কাজীপাড়ার রাস্তায়। পথচারীরা তাঁকে উদ্ধার করে প্রথমে মিরপুর আল হেলাল বিশেষায়িত হাসপাতালে নিয়ে যান। সেখানে তিনি চিকিৎসা পাননি। পরে পুলিশ এসে সোহরাওয়ার্দী হাসপাতালে নিয়ে গেলে চিকিৎসকেরা তাঁকে মৃত ঘোষণা করেন। বাসা থেকে বের হয়েছিলেন স্ত্রী আর দুই শিশুসন্তানের কাছে বিদায় নিয়ে। চিকিৎসার পাশাপাশি ঠিকাদারি করতেন। সেই কাজেই নোয়াখালী যেতে চেয়েছিলেন। কিন্তু সেটাই তাঁর অনন্তযাত্রা হয়ে গেল। প্রাথমিকভাবে পুলিশের ধারণা, ছিনতাইকারীরা তাঁকে ছুরিকাঘাত করেছে, সময়মতো চিকিৎসা না পাওয়ায় অতিরিক্ত রক্তক্ষরণে মৃত্যু হয়েছে।
আহমেদ মাহী বুলবুল আমাদের বন্ধু, বড় ভাই। ঢাকার সাংবাদিক ও বামপন্থী ছাত্র-তরুণদের কাছে খুবই পরিচিত মুখ। বন্ধুবৎসল, সদা হাস্যোজ্জ্বল মানুষটা ছিলেন সবারই আপন জন। মগবাজারে ওয়্যারলেস গেটে তাঁর ছোট্ট চেম্বার। আমাদের পরিচিত কারও দাঁতের সমস্যা হলে মুশকিল আসানের মতো ছিলেন ডাক্তার বুলবুল। রোগীর চেয়ে তাঁর উদ্বেগই বেশি। ঠিকমতো বাসায় পৌঁছেছে কি না, ওষুধ কিনেছে কি না, খুব বেশি ব্যথা করছে কি না, তরল খাবার খেয়েছে কি না—এসব খোঁজখবর নিতেন বারবার ফোন করে। পরবর্তী চেকআপের তারিখও মনে করিয়ে দিতেন। আমাদের দেশে দাঁতের চিকিৎসা ব্যয়বহুল। কিন্তু বুলবুলের কাছে চিকিৎসা মিলত যৌক্তিক খরচেই।
বামপন্থী ছাত্র-তরুণ আর সাংবাদিক বাদেও তাঁর রোগী ছিলেন নিম্নবিত্ত মানুষ। বিনা মূল্যে কিংবা নামমাত্র মূল্যে তাঁদের চিকিৎসা দিতেন। পথশিশুদের বিনা মূল্যে দাঁতের চিকিৎসা দিতেন। আমাদের সমাজে বিরল হয়ে আসা এসব গুণ তাঁকে ‘মানবিক চিকিৎসক’ বলে পরিচিতি এনে দিয়েছিল। চিকিৎসাকে সেবা হিসাবে নিয়েছিলেন, উপার্জনের জন্য বেছে নিয়েছিলেন ব্যবসা।
রাজনৈতিক বিশ্বাসের দিক থেকে বিএনপির সঙ্গে তাঁর মানসিক সম্পৃক্ততা ছিল। কিন্তু আওয়ামী লীগ, বাম—সব ধারার মানুষের সঙ্গে ছিল তাঁর সমান সখ্য। সবার সঙ্গেই ছিল বন্ধুত্ব। রাজনীতিসহ নানা বিষয়ে তাঁর সঙ্গে তর্কবিতর্ক চলত। কিন্তু মতান্তর কখনো মনান্তর হতো না। বুলবুলের মৃত্যুর খবর পাওয়ায় ফেসবুকে বিভিন্ন শ্রেণি-পেশা ও ভিন্ন রাজনীতির মানুষেরা যে অকপট শোক জানিয়েছেন, তা তাঁর মানবিক গুণের প্রতি সবার সম্মান প্রদর্শন।
মনে পড়ছে, আমরা যখন বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ি, সংগঠন করি, সে সময়ে বন্যা, মঙ্গা, ঘূর্ণিঝড়—যেকোনো মানবিক উদ্যোগে বুলবুলকে আমরা কাছে পেতাম। সিডরদুর্গত মানুষের জন্য মেডিকেল ক্যাম্প করতে হবে, চিকিৎসকদের নিয়ে যাওয়াসহ সব আয়োজন করেছিলেন বুলবুল। এ রকম একজন বন্ধুবৎসল, পরোপকারী চিকিৎসককে কেন খুন হতে হলো? চল্লিশ বছরের জীবনে অসংখ্য মানুষের চিকিৎসাসেবা যিনি দিয়েছেন, তিনিই কেন চিকিৎসা পেলেন না?
সোহরাওয়ার্দী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের মর্গে বুলবুলকে শেষবারের মতো যাঁরা বিদায় জানাতে গিয়েছিলেন, তাঁদের কেউই মনে করছেন না, এটা ছিনতাইকারীর হামলা হতে পারে। বাংলা ট্রিবিউনের প্রধান প্রতিবেদক সাংবাদিক উদিসা ইসলাম ফেসবুক পোস্টে লিখেছেন, ‘ফাঁকা রাস্তায় “ছিনতাইকারী” পায়ে (থাইয়ের অংশ) ছুরি মেরে গেল, পায়ের ছুরিকাঘাতে মরেও গেল। পকেটের টাকা নিল না! তারপরও তাঁরা ছিনতাইকারী? কেন?’