আজও যথাযথ মূল্যায়ন করা হয়নি প্রথিতযশা অভিনেত্রী ও স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রের শব্দসৈনিক সুমিতা দেবীকে। এমনকি তার মৃত্যুদিবসও মনে রাখেনি চলচ্চিত্র বিষয়ক সংগঠনগুলো। এ নিয়ে আক্ষেপ প্রকাশ করছেন তার পরিবারের সদস্যরা। সূত্র : বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
৬ জানুয়ারি বাংলা চলচ্চিত্রের ‘ফাস্টলেডি’ খ্যাত এ অভিনেত্রীর মৃত্যুবার্ষিকী ছিলো। এদিন চলচ্চিত্র সংশ্লিষ্ট কোনো সংগঠনের তরফ থেকে কোনো আয়োজন করা হয়নি বলে জানালেন তার ছোট ছেলে অনল রায়হান। তিনি বললেন, ‘জীবিতকালেও মা অবমূল্যায়িত ছিলেন; আর মৃত্যুর পর তো মানুষ তাকে ভুলেই গেছে।’ অথচ বাংলা চলচ্চিত্রের জন্য নিজের জাত-ধর্ম, বাবা-মা, পরিবার-পরিজন ও চিরচেনা কলকাতা শহরকে জলাঞ্জলি দিয়েছিলেন তিনি। ১৯৩৬ সালের ২ ফেব্রুয়ারি মানিকগঞ্জের এক সম্ভ্রান্ত ব্রাহ্মণ পরিবারে জন্ম নেওয়া এ শিল্পীর পারিবারিক নাম হেনা ভট্টাচার্য। পঞ্চাশের দশকের শেষভাগে চলচ্চিত্র ব্যক্তিত্ব ফতেহ লোহানীর ‘আসিয়া’ ও ‘আকাশ আর মাটি’ ছবিতে অভিনয়ের মাধ্যমে রূপালী পর্দায় অভিষেক ঘটে তার। ফতেহ লোহানীই তাকে ‘সুমিতা দেবী’ নামটি দেন। ‘আসিয়া’ চলচ্চিত্রে দুর্দান্ত অভিনয় করে রাতারাতি খ্যাতি পাওয়া এ শিল্পী তিন যুগেরও দীর্ঘ ক্যারিয়ারে ‘ওরা এগারো জন’, ‘সুজন সখী’, ‘জন্ম থেকে জ্বলছি’, ‘আমার জন্মভূমি’, ‘চিত্রা নদীর পারে’র মতো চলচ্চিত্রে অভিনয় করেছেন। আরও আছে ‘সোনার কাজল’, ‘কাঁচের দেয়াল’, ‘দুই দিগন্ত’, ‘এই তো জীবন’, ‘অশান্ত প্রেম’।
অভিনয়ের পাশাপাশি নির্মাণেও ছিলেন সিদ্ধহস্ত। ‘আগুন নিয়ে খেলা’, ‘মোমের আলো’, ‘মায়ার সংসার’, ‘আদর্শ ছাপাখানা’ ও ‘নতুন প্রভাত’ চলচ্চিত্রে নির্মাণ শৈলী দেখিয়েছেন তিনি। জহির রায়হানের পরিচালনায় উর্দু চলচ্চিত্র ‘সঙ্গম’-এ অভিনয় করেন তিনি। পরে আরও কয়েকটি চলচ্চিত্রে একসঙ্গে কাজ করতে গিয়ে পরস্পরের প্রেমে পড়েন জহির রায়হান-সুমিতা; ১৯৬১ সালে সেই প্রণয় পরিণয়ে রূপ নেয়। তাদের সংসারে বিপুল রায়হান ও অনল রায়হান নামে দুই ছেলের জন্ম হয়। বিয়ের পর ছাড়লেন নিজের ধর্ম। জহির রায়হানের সংসার শুরুর পর হিন্দু ধর্ম থেকে মুসলমান ধর্মে দীক্ষিত হন তিনি; পরে তার নাম হয় নিলুফার বেগম। ধর্ম পরিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে নিজের বাবা-মা, ভাই-বোনদের সঙ্গেও দূরত্ব দেয়াল তৈরি হয় তার। কলকাতার পুরো সমাজই সামাজিকভাবে বর্জন করেছিলো তাকে। ‘তিনি ব্রাহ্মণ পরিবারের মেয়ে ছিলেন। তার ধর্মান্তরিত হওয়াটা পরিবারের পক্ষ থেকে মেনে নেওয়া স্বাভাবিক ছিলো না। তারপর থেকে পরিবারের কারও সঙ্গেই তার যোগাযোগ ছিলো না।’- বলেন অনল রায়হান। মায়ের এই ত্যাগকে ‘আইকনিক’ ত্যাগ হিসেবে দেখছেন তিনি।
বিয়ের পর স্বামী-নির্মাতা জহির রায়হানকে নির্মাণে উৎসাহিত করার পাশাপাশি আর্থিকভাবেও সহযোগিতা করেছিলেন তিনি। ১৯৬১ সালে ‘কখনো আসেনি’ চলচ্চিত্র নির্মাণ শুরুর আগে জহির রায়হানের হাতে কোনো কানাকড়ি ছিলো না। তখন চলচ্চিত্র নির্মাণের জন্য শুরুতেই এফডিসিতে ২৫ হাজার টাকা জমা দিতে হতো। তখনকার শীর্ষস্থানীয় নায়িকা হিসেবে এফডিসির প্রধানকে বলে সেই অর্থ মওকুফ করে নিয়েছিলেন সুমিতা দেবী। শুটিং শুরুর পর দফায় দফায় চলচ্চিত্রের পেছনে অর্থ লগ্নি করে জহির রায়হানকে নির্মাণে উৎসাহিত করেন তিনি।
মুক্তিযুদ্ধ শুরু হলে স্বাধীনবাংলা বেতার কেন্দ্রের সঙ্গে যুক্ত হন তিনি; আর তথ্যচিত্র নির্মাণ করে মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে প্রচারণা চালান জহির রায়হান। মুক্তিযুদ্ধের সময় দু’জনের কাছেই কোনো টাকা-পয়সা ছিলো না। নিজেদের সবটুকু অর্থ প্রবাসী সরকারের তহবিলে জমা দিয়েছিলেন। মুক্তিযোদ্ধাদের এফডিসিতে থাকার ব্যবস্থা করেছেন সুমিতা; তাদের চুল কাটিয়েছেন, খাওয়া-দাওয়ার ব্যবস্থাও করেছেন। তখন তার কোলে দুই সন্তান অনল-বিপুল। মায়ের মুখ থেকে শোনা যুদ্ধদিনের সেই গল্প শোনালেন অনল, ‘মায়ের কাছ থেকে শুনেছি, এফডিসিতে ফ্লোরের মধ্যে দিনের পর দিন আমাদের পড়ে থাকতে হতো। তখন আমাদের ভয়ংকর দিন কেটেছে। পরে গেরিলা যোদ্ধাদের সঙ্গে কলকাতায় রওনা করেছিলেন বাবা-মা।’ কলকাতায় যাওয়ার পথে একাধিকবার পাকিস্তানি আর্মিদের বন্দুকের নলের মুখ থেকে ফিরেছে পরিবারটি। যুদ্ধের পুরো ৯ মাস দেশের জন্য কাজ করেছেন সুমিতা দেবী। কলকাতায় বাংলাদেশি শিল্পীদের সংগঠনের ব্যানারে মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে মিছিল-মানববন্ধন করেছেন। কলকাতার বাইরে দিল্লি হয়ে মাদ্রাজ থেকেও লোকজনের কাছ থেকে চাঁদা তুলে প্রবাসী সরকারের তহবিলে জমা দিয়েছেন।
মুক্তিযুদ্ধে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখা এ শিল্পীকে স্বাধীনতার ৪৮ বছরেও একুশে পদক কিংবা স্বাধীনতা পদকে সম্মানিত করা হয়নি। এমনকি বাংলাদেশ বেতার, টেলিভিশন কিংবা এফডিসিও তাকে মনে রাখেনি। এই মূল্যায়নহীনতা কেন? প্রশ্নটা করলে অনল রায়হান নিজের তিনটি পর্যবেক্ষণ তুলে ধরলেন :
এক. শিল্প-সংস্কৃতি ও সামাজিক আদর্শের কারণে এমনটা ঘটতে পারে। আমাদের ফিল্ম ইন্ডাস্ট্রিতে প্রবীণদের ভুলে যাওয়ার অভ্যাসটা খুব পুরানো। প্রবীণরা জীবিতকালেই ঠিকঠাক মতো মূল্যায়ন পায় না, মারা যাওয়ার পর তো আর কোনও জায়গা থাকে না। দুই. দ্বিতীয় কারণ হতে পারে ‘ধর্ম’। উনি মুসলমান হয়েছিলেন কিন্তু ফিল্মে নামটা সুমিতা দেবীই রেখেছিলেন। ব্যাপারটা অনেকে হয়তো ভালোভাবে নিতে পারেনি। তিন. মুক্তিযুদ্ধের পর দেশের রাজনীতিতে অনেক রাজাকার ঢুকেছে। তাদের কাছে মুক্তিযোদ্ধা সুমিতা দেবীর অবদান খুব বেশি গুরুত্ব পায়নি। ফলে সেখানে একজন সুমিতা দেবীর হারিয়ে যাওয়াটাই স্বাভাবিক। কিন্তু তার পেশার সঙ্গে যারা জড়িত ছিলেন তারাই যদি মূল্যায়ন না করে তাহলে কী হবে? এখন অন্তত তাকে মূল্যায়ন করা হোক; একুশে পদক কিংবা স্বাধীনতা পদকের মতো সম্মানে সম্মানিত করা হোক।