সভ্যতার সূচনা হয়েছিল মানুষের হাত দিয়ে কৃষি উৎপাদন শুরু হওয়ার পর থেকে। কৃষিব্যবস্থার উদ্ভবের আগে মানুষ তার প্রয়োজনীয় খাদ্য সংগ্রহ করত পশু শিকার এবং গাছ-গাছড়া থেকে ফল-ফলাদি সংগ্রহ করার মাধ্যমে।
ওই সময় মানুষ এক ধরনের যাযাবরের জীবনযাপন করত। কোনো জায়গায় খাদ্যের উৎস হিসাবে পশু এবং গাছ-গাছড়ার মজুত ফুরিয়ে যাওয়ার কারণে খাদ্য সংগ্রহ করা না গেলে মানুষ বাধ্য হয়ে অন্য স্থানের দিকে হিজরত করত, যেখানে খাদ্য সম্ভার পাওয়া যায়। একপর্যায়ে মানুষ দেখতে পেল নদীর কিনারায় নরম মাটিতে প্রকৃতিজাত শস্য জন্মায়। এ শস্য হতে পারে ধান, গম, ভুট্টা বা অন্য কিছু।
মানুষ বুঝতে পারল এসব ফসলের জন্য নরম মাটি এবং পানি খুবই প্রয়োজনীয়। মানুষ চিন্তা করল মাটি নরম করার কাজটি করা সম্ভব যদি মাটি খুঁচিয়ে দেওয়ার মতো কোনো হাতিয়ার ব্যবহার করা যায়। আর পানির প্রয়োজনটা মেটানো সম্ভব, যদি ধারে কাছে নদী, জলাশয় কিংবা প্রাকৃতিক ঝরনা থাকে। এভাবেই কৃষি সভ্যতার উদ্ভব হয়েছিল।
কৃষিব্যবস্থার মাধ্যমে খাদ্য উৎপাদন সহজতর হওয়ার ফলে মানুষ নির্দিষ্ট স্থানে স্থায়ীভাবে বসবাস করার চিন্তা-ভাবনা শুরু করল। এই চিন্তা-ভাবনা থেকেই বসতবাড়ি এবং শহর-নগরের উৎপত্তি। কৃষি কাজ দুরকমের হতে পারে। এর একটি হলো Shifting Agriculture এবং অপরটি হলো Sedentary Agriculture. প্রথমটির ক্ষেত্রে জায়গা পরিবর্তন করে চাষবাস করা হয়। আমাদের দেশে ‘জুম চাষ’ নামে পার্বত্য চট্টগ্রামে যে কৃষিব্যবস্থা প্রচলিত আছে সেটা Shifting Agriculture. যারা জুম চাষ করে, তারা একটি অঞ্চলের কোনো স্থানে আগুন দিয়ে বন-জঙ্গল পরিষ্কার করে সে জায়গাটিকে ফসল চাষের জন্য উপযুক্ত করে। এভাবে একটি স্থানে দুই-তিন বছর চাষাবাদের পর ওই স্থানটি পরিত্যাগ করে ভিন্ন একটি স্থানে চলে যায় জুমচাষিরা। বন-জঙ্গল পুড়িয়ে যে ছাই পাওয়া যায় তা সার হিসাবে ব্যবহৃত হয়। একটি স্থানে একাধিকবার চাষ করার ফলে ওই স্থানের উর্বরতা হ্রাস পায়। জুমচাষিরা তখন অন্য কোনো স্থানে সরে যায়। এক স্থানে চাষ করার পর পরবর্তী কত বছরে সেখানে আবার চাষ করা হবে সেটা নির্ভর করে জুমের জন্য প্রাপ্ত জমির সঙ্গে মানুষের অনুপাতের ওপর। এক সময় পার্বত্য চট্টগ্রামে ৭ বছরের ব্যবধানের পর চাষের জন্য জুমিয়ারা ফেরত আসত। এখন জনসংখ্যা বৃদ্ধি পাওয়ার ফলে এই ব্যবধান ২-৩ বছরে হ্রাস পেয়েছে।
অন্যদিকে Sedentary Agriculture-এ জমি বদল করার প্রশ্ন ওঠে না। বংশানুক্রমে মানুষ একই জমিতে বারবার চাষ করে। জমির উর্বরা শক্তি হ্রাস যাতে না পায়, সেজন্য জৈব সার এবং রাসায়নিক সার ব্যবহার করা হয়। সেচ ব্যবস্থারও অনেক উন্নতি হয়েছে। একই স্থানে বসতি গড়ে চাষবাস করা এবং দৈনন্দিন জীবনযাপনের মধ্য দিয়ে মানুষ বিভিন্ন ধরনের প্রতিষ্ঠান, আইন ও বিচার সালিশের ব্যবস্থা, পণ্য বিনিময়ের জন্য মুদ্রার ব্যবহার, যাতায়াতের জন্য চাকাযুক্ত গাড়ির ব্যবহার এবং সমাজ অনুমোদন করে না এমন সব কর্মকাণ্ডের জন্য অপরাধ দমন ব্যবস্থা মানুষ গড়ে তুলেছে। এরই নাম সভ্যতা। সভ্যতায় শুধু ক্ষুধা ও তৃষ্ণা নিবারণের ব্যবস্থা করা হয় না, উৎসব পার্বণ, নৃত্য-সংগীত, সাহিত্য ও ধর্ম ইত্যাদিও বিকশিত হয়।