চা শিল্পেও করোনা থাবা

মানবজমিন প্রকাশিত: ০৩ আগস্ট ২০২০, ১০:১২

দেশের গুরুত্বপূর্ণ অর্থকরী ফসল চা। জাতীয় অর্থনীতিতে চা শিল্পের গুরুত্ব অনেক। কিন্তু করোনার প্রভাবে শিল্পটি যেমন সংকটে পড়েছে তেমনি চা শ্রমিকদের জন্য দুর্দিন নেমে এসেছে। এমনিতেই শ্রমের যথাযথ মূল্য পেতে সারা বছরই আন্দোলন করতে হয় শ্রমিকদের। এরমধ্যেও করোনা সংক্রমণের কারণে সারা দেশ যখন লকডাউন, তখন শিল্পের ক্ষতি এড়াতে করোনার ঝুঁকি নিয়েই শ্রমিকরা বাগানগুলোতে কাজ করেছে। কিন্তু করেনার প্রভাব এড়াতে পারে নি শিল্পটি। বাগান মাকিদের দাবি, গত বছরের তুলনায় এবার চা উৎপাদন যেমন কমেছে, তেমনি চারগুণ কমেছে চা বিক্রিও। এ অবস্থায় সম্প্রতি কয়েকটি চা বাগান বন্ধ ঘোষণা করা হয়। এতে চা শ্রমিকরা বিপাকে পড়েছেন। শ্রমিকদের দাবি, দিনে মাত্র ১০২ টাকা মুজুরির বিনিময়ে তারা কঠোর পরিশ্রম করে এ শিল্পটিকে টিকিয়ে রেখেছে। সর্বনিম্ন মুজুুরি ৩০০-৪০০ টাকা করার দাবিও তাদের দীর্ঘদিনের। কিন্তু যখনই শ্রমিকরা জোর দাবি জানায়, তখনই শ্রমিকদের কণ্ঠরোধ করার জন্য মালিকরা দমন-পীড়ন শুরু করেন। এসব আন্দোলন ঠেকাতেই মালিকরা বাগান বন্ধ করে দেয়।বাংলাদেশ চা শ্রমিক ফেডারেশনের দেয়া তথ্য অনুযায়ী, করোনাকালে অন্তত ৭-৮ টি চা বাগান বন্ধ ঘোষণা করা হয়েছে। এরমধ্যে রয়েছে হবিগঞ্জের রেমাক চা বাগান, কালিটি, রেমাক ও ইমাম চা বাগানসহ আরো কয়েকটি চা বাগান। সংগঠনটির উপদেষ্টা শফিকুল ইসলাম মানবজমিনকে জানান, করোনাকালে শ্রমিকরা ঝুঁকি নিয়ে কাজ করেছে। এতে অন্তত ২৩জন শ্রমিক করোনায় আক্রান্ত হয়েছেন। মারা গেছেন ৫ জন। তারপরও শ্রমিকরা তাদের শ্রমের সঠিক মূল্য পান না। শ্রমিকরা এজন্য আন্দোলন শুরু করলে তাদের থামাতে বাগান বন্ধ ঘোষণা করা হয়। চা শ্রমিকরা এমনিতেই নানা বৈষম্যের শিকার। তাদের ভূমির অধিকার নেই। শ্রমের সঠিক মুজুরি পান না। গত ১৭০ বছররের ইতিহাসে শ্রমিকরা নানা বঞ্চনার শিকার।জানা গেছে, সর্বশেষ গত সোমবার মৌলভীবাজারের কমলগঞ্জ উপজেলার সীমান্তবর্তী ধলই চা বাগান বন্ধ ঘোষণা করা হয়। বাগান পুনরায় চালুর দাবিতে এখন পর্যন্ত অবস্থান কর্মসূচিসহ বিভিন্নভাবে আন্দোলন করে যাচ্ছেন চা শ্রমিকরা। শ্রমিকদের ভাষ্যমতে, ঈদুল আজহার আগেই তাদের মজুরি দেয়ার কথা ছিল। কিন্তু সোমবার গভীর রাতে অনির্দিষ্টকালের জন্য চা বাগান বন্ধ ঘোষণা করে কর্তৃপক্ষ নোটিশ টানিয়ে দেয়। এতে বিপাকে পড়েন প্রায় ৬০০ চা শ্রমিক।চা বাগান পঞ্চায়েতের সভাপতি গৌরাঙ্গ নায়েক বলেন, শ্রমিকদের বিভিন্ন দাবি-দাওয়া নিয়ে কর্তপক্ষের সঙ্গে দেন দরবার চলছিল। তাই শ্রমিকদের কণ্ঠরোধ করার জন্য দমন-পীড়ন শুরু হয়েছে। এই দাবিকে কেন্দ্র করে গড়ে ওঠা শ্রমিক আন্দোলন ঠেকাতে বাগান কর্তৃপক্ষ শ্রম আইনের অপপ্রয়োগ করে বাগান বন্ধ ঘোষণা করেছে।শ্রমিকদের দেয়া তথ্যমতে, চা শ্রমিকদের বর্তমানে দৈনিক মজুরি ১০২ টাকা। এ মজুরি পেতে আবার বাগানভেদে ২০ থেকে ২৫ কেজি চাপাতা তুলতে হয়। বাড়তি চা পাতা তুললে যে পরিমাণ টাকা পাওয়ার কথা, তাও পান না বেশির ভাগ শ্রমিক। চা পাতা তোলার স্থানে গাড়ি থাকার কথা। কিন্তু অনেক বাগানেই গাড়ি থাকে না। অনেক শ্রমিককে কাজের স্থান থেকে উত্তোলিত পাতা ওজন করে জমা দেয়ার জন্য পাতার গাট্টি পিঠে করে তিন থেকে পাঁচ কিলোমিটার পর্যন্ত দূরে যেতে হয়। রোদ-বৃষ্টিতে ভিজে এ কাজ করতে হয়। বৃষ্টির সময় রেইনকোট দেয়ার কথা থাকলেও তা দেয়া হয় না।চা শ্রমিক ফেডারেশনের উপদেষ্টা শফিকুল ইসলাম মানবজমিনকে বলেন, চা বাগানগুলোতে কাজ করা শ্রমিকেরা এক ধরনের আবদ্ধ জীবন যাপন করেন। শ্রমিকেরা শিক্ষা, স্বাস্থ্যের মতো মৌলিক পরিষেবা থেকে বঞ্চিত। সেই বৃটিশ আমলে চা বাগানের কাজের জন্য এই শ্রমিকদের নিয়ে আসা হয়েছিল বিভিন্ন অঞ্চল থেকে। সেই থেকেই বঞ্চনার শুরু। করোনাকালেও চা শ্রমিকরা ঝুঁকি ও অবহেলার শিকার হয়েছে। করোনা যুদ্ধে গোটা দুনিয়া যেখানে বেসামাল, সেখানে চা বাগানের শ্রমিকদের এখনো কাজ করতে হচ্ছে জীবনের ঝুঁকি নিয়ে। অথচ কোনো ঝুঁকি ভাতা পর্যন্ত দেয়া হচ্ছে না। কোন সুরক্ষা পণ্যও দেয়া হচ্ছে না। এই মহামারির সময়ে চা শ্রমিকরা ত্রাণ থেকেও বঞ্চিত হয়েছে। মালিকেরা চা শ্রমিকদের জীবনের ঝুঁকিকে কোন ঝুঁকি-ই মনে করে না। করোনাকালে আরেকটি বিষয় চা শ্রমিকদের উদ্বিগ্ন করছে, তা হলো- যে কোন অজুহাতে বাগান বন্ধ করে দেয়া, মজুরি না দেয়া।ওদিকে এবার করোনার প্রভাবে চা উৎপাদন এবং বিক্রি কমেছে বলে জানিয়েছে বাংলাদেশ চা সংসদ। তথ্য অনুযায়ী, চলতি বছর চা উৎপাদনের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে ৭ কোটি ৫৯ লাখ ৪০ হাজার কেজি। কিন্তু জানুয়ারি থেকে মে মাস পর্যন্ত এই ৫ মাসে উৎপাদন হয়েছে এক কোটি ২৮ লাখ ৪৬ হাজার কেজি। আর গত বছর প্রথম ৫ মাসে উৎপাদন হয়েছিল এক কোটি ৬২ লাখ ৮১ হাজার কেজি। বাগান মালিকদের সংগঠন চা সংসদ বলছে, দেশের বাজারে বছরে প্রায় ৯ কোটি কেজি চায়ের চাহিদা রয়েছে। এর বড় অংশ টং দোকান-হোটেল-রেস্টুরেন্টগুলোয় ব্যবহার হয়। গত মার্চ থেকে দীর্ঘদিন টং দোকান-হোটেল-রেস্টুরেন্ট বন্ধ ছিল। বর্তমানে সীমিত আকারে খুললেও ব্যবসা কমেছে। সামগ্রিকভাবে ব্যবহার ও বেচাকেনা কমে যাওয়ায় দেশে নিলামগুলোয় সরবরাহ করা বেশির ভাগ চা অবিক্রিত থেকে যাচ্ছে।শ্রীমঙ্গলের চা নিলাম কেন্দ্রের তথ্য অনুযায়ী, চলতি বছর এখন পর্যন্ত এ কেন্দ্র তিনটি নিলাম আয়োজন করা সম্ভব হয়েছে। প্রতিটি নিলামে লক্ষাধিক কেজি চা সরবরাহ হলেও তিন নিলাম মিলিয়ে এক লাখ কেজির সামান্য বেশি চা বিক্রি হয়েছে। গত বছর প্রতি কেজি চা ২০০-২৩০ টাকায় বিক্রি হলেও এবার তা কেজিপ্রতি ১৬০-১৮০ টাকায় নেমে এসেছে। চট্টগ্রামের নিলাম কেন্দ্রেও চায়ের বেচাকেনা ও দামে একই অবস্থা বজায় রয়েছে। অবিক্রীত চায়ের মজুদ ক্রমেই বাড়ছে।বাংলাদেশ চা সংসদ সিলেট ভ্যালির সভাপতি জিএম শিবলি বলেন, প্রাকৃতিক কারণে এবার চা উৎপাদন কমছে। আর বেচাকেনা ও দাম কমছে করোনার কারণে। সব মিলিয়ে নানামুখী সংকটে বড় ধরনের চাপের মুখে রয়েছে দেশের চা শিল্প।বাংলাদেশ চা বোর্ডের উপপরিচালক (পরিকল্পনা) মুনির আহমেদ বলেন, কয়েক বছরে দেশের চা শিল্প আমদানিনির্ভরতা কমে রপ্তানিমুখী হয়ে উঠতে শুরু করেছিল। এবার শিল্পটি বড় ধাক্কা খেয়েছে। মহামারি পরিস্থিতি দীর্ঘ সময় অব্যাহত থাকলে এবং সরকারি সহায়তা না পেলে সংকট আরো ঘনিভূত হবে।
সম্পূর্ণ আর্টিকেলটি পড়ুন
ঘটনা প্রবাহ

ট্রেন্ডিং

সংবাদ সূত্র

News

The Largest News Aggregator
in Bengali Language

Email: [email protected]

Follow us