মাওলানা সা’দ: ভারত সরকারের আস্থাভাজন থেকে যেভাবে আজ ফেরার আসামি
প্রকাশিত: ১৯ এপ্রিল ২০২০, ০৯:১৩
ভারতে তাবলিগ জামাতের প্রধান মাওলানা সা’দ কান্ধলভির সঙ্গে নরেন্দ্র মোদি সরকারের প্রকাশ্য দহরম-মহরম না-থাক, তিনি বিজেপির যথেষ্ঠ আস্থাভাজন বলেই পরিচিত ছিলেন। অন্য অনেক সুন্নি মুসলিম গোষ্ঠীর তুলনায় তাবলিগ জামাতের কর্মকান্ড হিন্দুত্ববাদী বিজেপি সরকারের আমলে প্রচ্ছন্ন প্রশ্রয় পর্যন্ত পেয়েছে।এমন কি, গত ২৯ মার্চ রাত দুটোর সময় দিল্লিতে তার ডেরায় হাজির হয়ে মাওলানা সা’দকে যিনি 'মারকাজ নিজামুদ্দিন' খালি করানোর ব্যাপারে রাজি করিয়েছিলেন – তিনি আর কেউ নন, ভারতের জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা ও নরেন্দ্র মোদির বিশ্বস্ত লেফটেন্যান্ট অজিত ডোভাল। সেই মাওলানা সা’দ কান্ধলভি এখন ভারতে আইনের চোখে একজন ফেরার আসামি। সরকারি নিষেধাজ্ঞা অমান্য করে দিল্লিতে তাবলিগের সদর দফতর 'মারকাজ নিজামু্দ্দিনে' মার্চের মাঝামাঝি যে ধর্মীয় জমায়েত হয়েছিল, সে খবর সামনে আসার পর থেকে প্রায় তিন সপ্তাহ হল তিনি আত্মগোপনে আছেন। দিল্লি পুলিশ তার বিরুদ্ধে এফআইআর দায়ের করলেও তাকে এখনও খুঁজে পায়নি।এর মধ্যে গত বৃহস্পতিবার (১৭ এপ্রিল) তার বিরুদ্ধে 'কালপিবল হোমিসাইড' বা অনিচ্ছাকৃত হত্যার অভিযোগও আনা হয়েছে। সেদিন রাতেই ভারতের এনফোর্সমেন্ট ডিরেক্টোরেট মাওলানা সা’দের বিরুদ্ধে ‘মানি লন্ডারিং’ বা আর্থিক তছরুপের মামলা পর্যন্ত এনেছে।পুলিশ ও তদন্তকারী সংস্থাগুলোর কাছ থেকে প্রবল চাপের মুখে মাওলানা সা’দ দিল্লি পুলিশকে অবশেষে চিঠি লিখে জানিয়েছেন, তিনি তাদের তদন্তে সহযোগিতা করতে রাজি আছেন।এখন প্রশ্ন হল, যে ধর্মীয় নেতাকে বিজেপি সরকার পর্যন্ত রীতিমতো সম্মানের চোখে দেখত, তাদের চোখেই তিনি আচমকা কিভাবে ভিলেনে পরিণত হলেন?আর তা ছাড়া, হিন্দুত্ববাদী দল বিজেপি এই মুসলিম ধর্মীয় নেতাকে সমীহই বা করত কেন? বিজেপির কেন্দ্রীয় স্তরের একজন সিনিয়র নেতা ও জাতীয় সাধারণ সম্পাদক বাংলা ট্রিবিউনকে যার জবাবে জানাচ্ছেন, এর কারণ হল তাবলিগ জামাতের ধর্মীয় দর্শন।তিনি বলছিলেন, ‘প্রায় একশো বছরের পুরনো তাবলিগ জামাতের জন্ম কিন্তু ভারতের হরিয়ানাতেই। কিন্তু মাওলানা সা’দ বা তার বাপ-দাদার নেতৃত্বে এই সংগঠন চিরকাল মুসলিমদের মধ্যে ধর্মীয় প্রচারেই নিজেদের সীমাবদ্ধ রেখেছে – কখনও হিন্দুদের ঘাঁটাতে যায়নি। অন্য ধর্মের লোকেদের মধ্যে ইসলামের প্রচার করাই তাবলিগে নিষিদ্ধ।’‘অন্যভাবে বলা যায়, ভারতে অন্যান্য যে সব মুসলিম জিহাদি সংগঠন রয়েছে – যেমন ইন্ডিয়ান মুজাহিদিন বা লস্কর-ই-তইবা – তাদের সঙ্গে তাবলিগের কোনও তুলনাই চলে না। তাদের কর্মকান্ড ধর্মীয় পরিসরেই সীমাবদ্ধ, দেশের রাজনীতি বা কূটনীতি নিয়ে তারা কখনও মাথা ঘামানোর চেষ্টাই করেনি,’ বলছিলেন তিনি।যেমন – ভারতের কাশ্মির নীতি নিয়ে তাবলিগ নেতৃত্বের মনোভাব যা-ই হোক, তারা কখনও তা সামনে আনেননি। আরএসএস, বিশ্ব হিন্দু পরিষদ বা ওই ধরনের কট্টর হিন্দুত্ববাদী গোষ্ঠীগুলোর সঙ্গেও তাবলিগের কখনও কোনও বড়সড় সংঘাত হয়েছে বলেও জানা নেই।আর ঠিক এই কারণেই তাবলিগ জামাতের প্রধান মাওলানা সা’দ কান্ধলভিকে বিজেপি-ও বরাবর অন্য নজরেই দেখে এসেছে। পশ্চিম উত্তরপ্রদেশের শামলী ও মুজফফরনগর জেলায় তাবলিগের যে বিশাল কর্মকান্ড আছে – সে রাজ্যে যোগী আদিত্যনাথের সরকার ক্ষমতায় আসার পরও তাতে কখনও বাধা দেওয়া হয়নি।কিন্তু মাওলানা সা’দ ও বিজেপি সরকারের এই পারস্পরিক সমীকরণে বাদ সাধল একটাই ফ্যাক্টর – আর সেটা করোনাভাইরাস।দিল্লিতে রাজনৈতিক বিশ্লেষক কল্যাণ গোস্বামীর কথায়, ‘ভারতে করোনাভাইরাস সংকটের প্রথম পর্বে সরকার যখন পরিস্থিতি সামলাতে রীতিমতো হিমশিম খাচ্ছে – তখন তাবলিগ জামাত সরকারের হাতে কার্যত একটা লোপ্পা ক্যাচ তুলে দিয়েছিল।’‘সরকারও সেটা লুফে নিতে ভুল করেনি – আর সঙ্গে সঙ্গেই তারা বলতে শুরু করে দেয় তাবলিগ জামাতের নির্বুদ্ধিতার জন্যই পরিস্থিতি এতটা খারাপ মোড় নিয়েছে। দিল্লি সরকার ও কেন্দ্রের নাকের ডগাতেই যে হাজার হাজার দেশি-বিদেশি ডেলিগেটকে নিয়ে তাবলিগ জমায়েত করেছে, সেটা ভুলে গিয়ে ভারতে ইসলামোফোবিয়ার ঝড় উঠল।’‘সরকার তাদের দৈনন্দিন ব্রিফিংয়ে পর্যন্ত দুরকম ফিগার দেওয়া শুরু করল – তাবলিগ জামাতের ইভেন্ট না-হলে দেশে কত করোনা রোগী থাকতেন, আর সেই জমায়েত হওয়ার কারণে রোগীর সংখ্যা কতটা বেড়ে গেছে। এত বড় মহামারির জন্য যে এভাবে শুধু একটা সংগঠনকে খোলাখুলি দায়ী করা হতে পারে – তা অকল্পনীয়’, বলছিলেন কল্যাণ গোস্বামী।ফলে পর্যবেক্ষকরা মনে করছেন করোনাভাইরাস সংকট সামলাতে সরকারের একটা ‘বলির পাঁঠা’ দরকার ছিল – আর একটা ভুল সিদ্ধান্তের জেরে সেই কোপটাই গিয়ে পড়েছে মাওলানা সা’দের ঘাড়ে।