ছয় মাস আগের সতর্কবার্তা জাতিসংঘ আমলে না নেওয়ার খেসারত দিচ্ছেন রোহিঙ্গারা। ছবিটি কক্সবাজারের কুতুপালং শিবির থেকে ফোকাস বাংলার তোলা

সতর্কবার্তা আমলে নেয়নি জাতিসংঘ, খেসারত দিচ্ছেন রোহিঙ্গারা

ব্রিটিশ সংবাদমাধ্যম গার্ডিয়ান এই তথ্য প্রকাশ করেছে। ওই রিপোর্টের একটি কপি হাতে পাওয়ার কথা জানিয়ে গার্ডিয়ান বলছে, চলতি বছরের মে মাসেই রিচার্ড মিয়ানমার নিয়ে জাতিসংঘের ভুল পদক্ষেপের বিষয়ে সতর্ক করে দিয়েছিলেন।

জাহিদুল ইসলাম জন
জ্যেষ্ঠ সহ-সম্পাদক, নিউজ এন্ড কারেন্ট অ্যাফেয়ার্স
প্রকাশিত: ০৫ অক্টোবর ২০১৭, ২১:৫৫ আপডেট: ২০ আগস্ট ২০১৮, ১৩:৪৮
প্রকাশিত: ০৫ অক্টোবর ২০১৭, ২১:৫৫ আপডেট: ২০ আগস্ট ২০১৮, ১৩:৪৮


ছয় মাস আগের সতর্কবার্তা জাতিসংঘ আমলে না নেওয়ার খেসারত দিচ্ছেন রোহিঙ্গারা। ছবিটি কক্সবাজারের কুতুপালং শিবির থেকে ফোকাস বাংলার তোলা

(প্রিয়.কম) মিয়ানমারের রাখাইনে রোহিঙ্গারা নিরাপত্তা বাহিনীর নির্বিচার আচরণের লক্ষ্যবস্তু হতে পারে, চলমান অভিযান শুরুর ছয় মাস আগে পাওয়া এমন একটি সতর্কবার্তা চেপে গিয়েছিল জাতিসংঘ। মিয়ানমারে জাতিসংঘের আবাসিক প্রতিনিধি রেনেটা লক দেসালিয়েনের কাছে ‘দি রোল অব দি ইউনাইটেড নেশন ইন রাখাইন স্টেট’ শীর্ষক ওই প্রতিবেদন দিয়েছিলেন স্বাধীন গবেষক রিচার্ড হর্সি। তবে বিশ্লেষণ পছন্দ না হওয়ায় তা চেপে গিয়েছিলেন রেনেটা।

ব্রিটিশ সংবাদমাধ্যম গার্ডিয়ান এই তথ্য প্রকাশ করেছে। ওই প্রতিবেদনের একটি কপি হাতে পাওয়ার কথা জানিয়ে গার্ডিয়ান বলছে, চলতি বছরের মে মাসেই রিচার্ড মিয়ানমার নিয়ে জাতিসংঘের ভুল পদক্ষেপের বিষয়ে সতর্ক করে দিয়েছিলেন। রিপোর্টে নির্ভুলভাবে পূর্বানুমান করা হয়েছিল, পরবর্তী ছয় মাসের মধ্যে পরিস্থিতি গুরুতর আকার নেবে।

জাতিসংঘ সদর দফতরকে দ্রুততার সঙ্গে পরিস্থিতি থেকে উত্তরণের উপায় খোঁজার পরামর্শ দিয়ে হর্সি ২৮ পাতার ওই প্রতিবেদনে আশঙ্কা প্রকাশ করেছিলেন, মিয়ানমারের নিরাপত্তা বাহিনী ভারী অস্ত্রসহ রোহিঙ্গাদের সঙ্গে নির্বিচার আচরণ করতে পারে।

নিরাপত্তা চৌকিতে রোহিঙ্গা বিদ্রোহীদের হামলার পর ২৫ আগস্ট থেকে মিয়ানমারের রাখাইনে সেনাবাহিনীর অভিযান হর্সির ওই ভবিষ্যদ্বাণীকে সত্যি প্রমাণ করে। এক মাসের একটু বেশি সময় ধরে চলমান অভিযানে রাজ্যটি থেকে বাংলাদেশে পালিয়ে আসতে বাধ্য হয়েছে পাঁচ লাখেরও বেশি রোহিঙ্গা।

মিয়ানমারে জাতিসংঘের আবাসিক প্রতিনিধি রেনেটা লক দেসালিয়েন হর্সিকে প্রতিবেদনটি তৈরির এ দায়িত্ব দেন। কয়েক মাসের কাজের পর দেওয়া রিপোর্টে ১৬টি সুপারিশ করেছিলেন রিচার্ড হর্সি। তিনি মিয়ানমার সরকারের সঙ্গে খোলামেলা আলাপের পরামর্শ দেওয়া ছাড়াও রিপোর্টটি সাহায্য সংস্থাগুলোর মধ্যে ব্যাপক প্রচারের ব্যবস্থা নেওয়ার কথাও বলেছিলেন।

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক সূত্রের বরাতে গার্ডিয়ান জানায়, প্রতিবেদনের বিশ্লেষণ ‘পছন্দ না হওয়ায়’ রেনেটা লক ওই সুপারিশ বাস্তবায়নে আগ্রহী ছিলেন না। কার্যত রিপোর্টটি চেপে গিয়েছিলেন এক সময়ে বাংলাদেশে জাতিসংঘের আবাসিক প্রতিনিধি হিসেবে কাজ করে যাওয়া রেনেটা।

মিয়ানমারে জাতিসংঘের আবাসিক প্রতিনিধি রেনেটা লক দেসালিয়েন
মিয়ানমারে জাতিসংঘের আবাসিক প্রতিনিধি রেনেটা লক দেসালিয়েন। সংগৃহীত ছবি 

ওই প্রতিবেদনে জাতিসংঘকে মানবাধিকার সমুন্নত রাখতে কৌশল প্রণয়নের পাশাপাশি গণনৃশংসতা বন্ধে সাবেক মহাসচিব বান-কি মুনকে পদক্ষেপ নেওয়ার কথাও বলেছিলেন রিচার্ড হর্সি। জাতিসংঘ কীভাবে এই পদক্ষেপ বাস্তবায়ন করবে তার ওপর সফলতা নির্ভর করবে উল্লেখ করে রিচার্ড হর্সি যোগ করেছিলেন, মানবাধিকার আর নিরাপত্তার বিষয়ে নিরব থাকা উচিত হবে না।

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক মিয়ানমারে কর্মরত জাতিসংঘের একটি সূত্র গার্ডিয়ান-কে বলেছে, ‘রেনেটা লক দেসালিয়ান ওই বিশ্লেষণ পছন্দ না করায় জাতিসংঘ এবং সাহায্য সংস্থাগুলোর মধ্যে তা ছড়িয়ে দেওয়া হয়নি।’ সংশ্লিষ্ট আরেকটি সূত্র বলছে, ‘রিপোর্টটি রেনেটাকে দেওয়া হয়েছিল তবে তিনি তা বিতরণের ব্যবস্থা নেননি। কারণ ওই রিপোর্টে তিনি খুশি ছিলেন না।’

রিচার্ড হর্সি আশা করেছিলেন, ওয়াল্ড ফুড প্রোগ্রাম, ইউএনএইচসিআর, সেভ দ্য চিলডে্রনের মতো জাতিসংঘের মানবিক সংস্থাগুলোর কাছ থেকে তিনি রিপোর্ট বিষয়ে প্রতিক্রিয়া পাবেন। তবে গার্ডিয়ান নিশ্চিত হয়েছে যে সেই প্রতিক্রিয়া আর কখনোই পাওয়া হয়নি।

এক সংবাদ সম্মেলনে মিয়ানমারে জাতিসংঘ দূতাবাসের এক মুখপাত্র সেসময় জানিয়েছিলেন, প্রতিবেদনটির কয়েকটি আউটলাইনের সঙ্গে তাদের সংস্থা একমত। শান্তি, মানবাধিকার আর উন্নয়ন ত্বরান্বিত রাখতে রাখাইনে সহিংসতা ছড়িয়ে পড়ার আগে কিছু চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি হতে হবে তাদের।

চূড়ান্ত প্রতিবেদনটি পাওয়ার পর তা জ্যেষ্ঠ কয়েকজন কর্মকর্তাকে দেখানো হয়েছিল বলে মিয়ানমারে কর্মরত জাতিসংঘের একটি সূত্র জানিয়েছে। মিয়ানমারের সূত্রগুলো বলছে, দুটি অনুষ্ঠানে তা নিয়ে আলোচনার পর সভার কার্যতালিকা থেকে ওই রিপোর্টটি হারিয়ে যায়।

এর আগে মুসলিম সংখ্যালঘু রোহিঙ্গাদের অধিকার নিয়ে তাচ্ছিল্য করার অভিযোগ উঠেছিল রেনেটা লক দেসালিয়েনের বিরুদ্ধে। সাহায্য সংস্থাগুলোর অভিযোগ, মানবাধিকার রক্ষায় প্রচেষ্টা চালানোর চেয়ে সরকারের সঙ্গে সুসম্পর্ক বজায় রাখায় বেশি মনোযোগী ছিল মিয়ানমারের জাতিসংঘ অফিস।

তবে এই অভিযোগ অস্বীকার করছেন জাতিসংঘ মহাসচিবের একজন মুখপাত্র। তিনি বলেন, ‘দেশটিতে কর্মরত আবাসিক প্রতিনিধি মানবাধিকার সমুন্নত রাখতে নিরন্তর চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন। জাতিসংঘের সব কর্মকাণ্ডের কেন্দ্রবিন্দুতে থাকে মানবাধিকার।’

এসব বিষয়ে গার্ডিয়ান রিচার্ড হর্সির মন্তব্য জানতে চাইলে ইমেইলে তিনি বলেন, ‘জাতিসংঘ জানত রাখাইনে স্থিতাবস্থা চললেও সম্ভবত বড় একটি সংকটের সৃষ্টি হতে পারে।’

ওই প্রতিবেদনটি নিয়ে রেনেটা লক দেসালিয়েনের অযৌক্তিক তীব্র সমালোচনার মুখে পড়েছিলেন বলেও জানান তিনি।

প্রসঙ্গত, গত ২৫ আগস্ট মিয়ানমারের রাখাইন রাজ্যে রোহিঙ্গা নিধন অভিযান শুরুর পর প্রাণ বাঁচাতে বাংলাদেশে পালিয়ে আসা রোহিঙ্গাদের সংখ্যা ইতোমধ্যে ৫ লাখ ছাড়িয়ে গেছে বলে জানিয়েছে জাতিসংঘ। তবে বেসরকারি হিসাবে এ সংখ্যা ৬ লাখেরও বেশি। এদিকে পালিয়ে আসার হার আগের চেয়ে কিছুটা কমলেও, তা পুরোপুরি বন্ধ হয়ে গেছে বলার সময় এখনও হয়নি বলে জানিয়েছেন সংস্থাটির মুখপাত্র।      

অভিযানের নামে মিয়ানমারের সেনাবাহিনী খুন, ধর্ষণ, ঘরবাড়ি পুরিয়ে দেওয়া, কুপিয়ে হত্যাসহ বর্বরতার চূড়ান্ত সীমাও অতিক্রম করেছে বলে অভিযোগ নিউইয়র্ক ভিত্তিক মানবাধিকার সংস্থা হিউম্যান রাইচ ওয়াচের। স্যাটেলাইট থেকে প্রাপ্ত ছবি বিশ্লেষণের মাধ্যমে সংস্থাটি বলেছে, ইতোমধ্যে প্রায় ২১৪টি রোহিঙ্গা অধুষ্যিত গ্রাম পুরোপুরি ধ্বংস করে দেওয়া হয়েছে। রাখাইন রাজ্যে রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীর বিরুদ্ধে মিয়ানমারের সেনাবাহিনী মানবতাবিরোধী অপরাধ করছে উল্লেখ করে দেশটির ওপর কিছু ক্ষেত্রে ও সেনাবাহিনীর ওপর নিষেধাজ্ঞা আরোপেরও আহ্বান জানায় সংস্থাটি।

প্রিয় সংবাদ/শান্ত    

পাঠকের মন্তব্য(০)

মন্তব্য করতে করুন


আরো পড়ুন

loading ...