ধানের নতুন জাত উদ্ভাবনে মগ্ন সেন্টু কুমার হাজং। ছবি: প্রিয়.কম

গ্রামের কৃষক সেন্টু এক অদম্য বিজ্ঞানী!

অভাবের কারণে মাধ্যমিক পাস করার সুযোগ হয়ে ওঠেনি। কিন্তু ধৈর্য্য আর চেষ্টা থাকলে যে সব করা সম্ভব, তাই প্রমাণ করেছেন শেরপুরের নালিতাবাড়ী উপজেলার নয়াবিল ইউনিয়নের চাটকিয়া গ্রামের কৃষক সেন্টু কুমার হাজং।

সানী ইসলাম
কন্ট্রিবিউটর, শেরপুর
প্রকাশিত: ২১ জানুয়ারি ২০১৮, ০৮:০০ আপডেট: ১৬ আগস্ট ২০১৮, ০৯:১৬
প্রকাশিত: ২১ জানুয়ারি ২০১৮, ০৮:০০ আপডেট: ১৬ আগস্ট ২০১৮, ০৯:১৬


ধানের নতুন জাত উদ্ভাবনে মগ্ন সেন্টু কুমার হাজং। ছবি: প্রিয়.কম

(প্রিয়.কম) অভাবের কারণে মাধ্যমিক পাস করার সুযোগ হয়ে ওঠেনি। কিন্তু ধৈর্য্য আর প্রচেষ্টা থাকলে যে সব করা সম্ভব, তা-ই প্রমাণ করেছেন শেরপুরের নালিতাবাড়ী উপজেলার নয়াবিল ইউনিয়নের চাটকিয়া গ্রামের কৃষক সেন্টু কুমার হাজং (৪৭)। ধানের নতুন জাত উদ্ভাবনে পুঁথিগত বিদ্যা না থাকলেও এক যুগ ধরে একক প্রচেষ্টায় ১৯ ধরনের নতুন ধান উদ্ভাবন করেছেন তিনি। চেষ্টা চলছে আরও নতুন নতুন জাত উদ্ভাবনের।

সেন্টু হাজং তার উদ্ভাবিত ১৯টি নতুন ধানের জাতের মধ্যে সাতটি ধানের নাম দিয়েছেন। অন্যগুলোর নাম এখনও দেওয়া হয়নি। এ ছাড়া সংকরায়নের মাধ্যমে দেশি বিলুপ্ত প্রজাতির ৩৫ প্রকার ধান একক বৈশিষ্ট্যে উন্নত করতে চাষাবাদ ও সেগুলোর বীজ তৈরি করে চলেছেন তিনি। 

সেন্টুর দাবি, চিনিশাইল একরে ৩০ থেকে ৩৫ মণ ধান হয়। আর তার উদ্ভাবিত সেন্টুশাইল একরে ৫০ থেকে ৫৬ মণ ধান হয়। চিনিশাইলের ধানের গাছ উচ্চতায় সাধারণত ১৬০ সেন্টিমিটার হয়। ফলে ঝড়ে বা বাতাসে ধানগাছ হেলে পড়ে। কিন্ত সেন্টুশাইল উচ্চতায় ১০০ থেকে ১২০ সেন্টিমিটার লম্বা হয়। তাই বাতাসে হেলে পড়ে না। এই ধান আষাঢ় থেকে ভাদ্রের ১৫ দিনের মধ্যে লাগাতে হয়। এ রকম প্রায় প্রতিটি নতুন উদ্ভাবিত ধানের সুফল রয়েছে।

শতাধিক কৃষক সেন্টু হাজংয়ের উদ্ভাবিত বীজ নিয়ে চাষাবাদ করে সফল হয়েছেন। তাই দিনে দিনে কৃষকরা সেন্টুর নতুন নতুন জাতের ধান চাষের দিকে ঝুঁকছেন।

৭ জানুয়ারি সেন্টু হাজংয়ের বাড়িতে গিয়ে দেখা যায়, অনেক কৃষক তার কাছে এসেছেন পরামর্শ নিতে। সামনে বোরো ধান চাষ করার প্রস্তুতি চলছে। তাই গ্রামের কৃষকরা সেন্টুর কাছে উন্নত জাতের বীজ নিতে এসেছেন। আর এই বীজের বেশির ভাগই সেন্টু স্থানীয় কৃষকদের বিনা মূল্যে দিয়ে সাহায্য করছেন।

সেন্টু হাজংয়ের বাড়ির উঠানে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে আছে নানা জাতের ধানের চারার মাটির টপ। আরও নতুন নতুন ধানের জাত উদ্ভাবনের চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন বলে জানান এই উদ্ভাবক কৃষক।

সেন্টু বলেন, ‘এই ধান গবেষণার কাজে ব্যাপক ধৈর্য্য প্রয়োজন। আমি এক যুগ কাজ করে ১৯ প্রকারের নতুন ধান আবিষ্কার করতে পেরেছি। তবে সরকারি ও বেসরকারি প্রতিষ্ঠানগুলো সহায়তা করলে আরও উন্নত জাতের ধান আবিষ্কার করতে পারব।’

শেরপুর এই কৃষক বলেন, ‘প্রতি বছর আমার উদ্ভাবিত ধান বিভিন্ন উপজেলার কৃষক এসে নিয়ে যান। তারা চাষাবাদ করে লাভবানও হয়েছেন। আমি আমার নতুন ধান দেশের কৃষকদের মধ্যে ছড়িয়ে দিতে চাই।’ 

চাটকিয়া গ্রামের কৃষক সতেন্দ্র বর্মন জানান, এ বছর আমন মৌসুমে সেন্টুশাইল ধান আড়াই একর জমিতে চাষ করেছিলেন তিনি। একরে ৪৫ মণ ধান পেয়েছেন। চিকন এই ধানের বাজারমূল্য মণপ্রতি এক হাজার ৫৫০ টাকা। তাই এই ধান চাষ করে লাভবান হওয়া সম্ভব হয়েছে।

আগামী মৌসুমে অনেক কৃষক এই ধান চাষ করতে আগ্রহী। রুপাকুড়া গ্রামের কৃষক খোরশেদ আলম জানান, তিনি সেন্টুশাইল চাষ করে লাভবান হয়েছেন। সেন্টুশাইল প্রতি মণ ধানের দাম এক হাজার ৫৫০ টাকা। আমন মৌসুমে আরও বেশি জমিতে তিনি এই ধান চাষ করবেন।

ধান গবেষণাই মূল কাজ সেন্টু হাজংয়ের। ছবি: প্রিয়.কম

উপজেলার নয়াবিল ইউনিয়ন পরিষদের (ইউপি) চেয়ারম্যান মো. ইউনুস আলী দেওয়ান মুঠোফোনে প্রিয়.কমকে বলেন, ‘সেন্টু একজন আদর্শ কৃষক। তিনি একক প্রচেষ্টায় এক যুগ ধরে ১৯ প্রকারের নতুন ধান উদ্ভাবন করেছেন। তাকে সরকারি-বেসরকারিভাবে সহযোগিতা করতে পেলে, সে আরও ভালো করবে।’

এ বিষয়ে জেলা খামারবাড়ির উপপরিচালক আশরাফ উদ্দিন বলেন, ‘কিছু দেশীয় ধান রয়েছে। সেগুলো সেন্টু হাজং সিলেকশন পদ্ধতির মাধ্যমে ধানের জাত উন্নয়নের চেষ্টা করেছেন। উনার ও স্থানীয় লোকজনদের ভাষ্য অনুযায়ী, উনি সফল হয়েছেন। ধান গবেষণা প্রতিষ্ঠান ও বিনার গবেষকরা সেন্টু হাজংয়ের কর্মকাণ্ড পরিদর্শন করেছেন। ধান গবেষণায় তার অনেক আগ্রহ রয়েছে, আমরা তাকে সকল প্রকার করিগরি সহযোগিতা দেওয়ার চেষ্টা করব।’

কৃষক থেকে ধানগবেষক সেন্টু হাজং

২০০৫ সালে বেসরকারি সংগঠন ‘কারিতাস’ কৃষকদের নিয়ে ‘জৈব পদ্ধতিতে চাষাবাদ ও নতুন জাতের ধান উদ্ভাবন’ শীর্ষক তিনদিনের একটি প্রশিক্ষণ কর্মশালার আয়োজন করে। সেই কর্মশালায় অংশগ্রহণ করেন সেন্টু হাজং। এর পর থেকে ধান নিয়ে নতুন কিছু করতে দৃঢ় প্রত্যয়ে কাজ শুরু করেন তিনি।

ধান উদ্ভাবনের সামান্য অভিজ্ঞতাকে কাজে লাগিয়ে ধৈর্য্য সহকারে নতুন ধানের জাত সৃষ্টি করার জন্য প্রতি বছর পরীক্ষামূলকভাবে মাটির টবে ধান সংকরায়ন করে সেই বীজ হিসেবে সংরক্ষণ শুরু করেন। সেই বীজ পর্যায়ক্রমে চাষবাদ করে ১৯ প্রকারের নতুন ধানের জাত উদ্ভাবন করেছেন।

যেভাবে নতুন ধান উদ্ভাবন হলো

সেন্টু হাজং জানান, বেলা তিনটা থেকে পাঁচটার মধ্যে ধানগাছের অর্ধেক শীষ আসার সময় ব্রিডিং বা সংকরায়ন করতে হয়। প্রথমে একটা শীর্ষ ধানের মাঝখান দিয়ে আড়াআড়ি করে কাঁচি দিয়ে কাটতে হয়। প্রতিটা ধানের মাঝে ছয়টি রেণু থাকে। পরে কাটা ধান (মা ধান) থেকে সুঁচ দিয়ে যত্ন সহকারে রেনু বের করে পরের দিন সকাল ১০টা থেকে ১২টার মধ্যে পরাগায়ন করার জন্য অন্য জাতের ধানের (বাবা ধান) রেণু এনে মা ধানের ওপর ঝাঁকিয়ে দিয়ে মোটা কাগজ দিয়ে বেঁধে রাখতে হয়।

বাড়ির উঠান হয়ে উঠেছে গবেষণাগার। ধান নিয়ে গবেষণায় ব্যস্ত সেন্টু কুমার। ছবি: প্রিয়.কম

২০ থেকে ২৫ দিনের মধ্যে ধান পাকা বা কাটার সময় হলে সংকরায়ন করা ধানে পরিপুষ্ট চাল হয়। এই চাল বীজ হিসেবে সংরক্ষণ করেন সেন্টু। এভাবে ১২ বছর গবেষণা করে ১৯ প্রকারের নতুন ধানের জাত তৈরি করেছেন তিনি।

সেন্টু হাজং শুরুতে প্রতি বছর জুন-জুলাই মাসে ১৫ শতক জমিতে দুই ফুট দৈর্ঘ্য ও প্রস্থের ছোট ছোট বীজতলা তৈরি করতেন। বীজতলায় দশটি গ্রুপ করে ৩০০টি প্লট তৈরি করা হতো। ক্রমিক নম্বর ধরে খাতায় ধানে জাত ও উচ্চতা লিখে রাখতেন।

২৫ থেকে ৩০ দিন পরে এই চারা ক্রমিক নম্বর অনুযায়ী এক একর জমিতে দুই মিটার দৈর্ঘ্য ও প্রস্থের ছোট ছোট ৩০০টি খেত করে ৩০০ প্রকার ধান চাষ করেন। প্রকার ভেদে ৯০ থেকে ১০০ দিনের মধ্যে এই সব খেতে ফলন হয়েছে।

এখানে সব চেয়ে ভালো ফসল ও ধান গাছের উচ্চতা বিবেচনা করে সেই ধানের বীজ সংরক্ষণ করেন। এইভাবে পর্যায়ক্রমে সেন্টু হাজং উদ্ভাবিত নতুন ধানের বীজ বৃদ্ধি করেছেন। একই পদ্ধতিতে বিলুপ্ত ৩৫টি দেশি জাতের ধানের বীজ পলিথিন, কৌটা ও ধানের ছড়া বেঁধে ছোট ছোট কাগজে লিখে তিনি সংরক্ষণ করছেন।

সেন্টুর উদ্ভাবিত ধানের জাত

সেন্টু হাজং পাইজামের সঙ্গে বিনা-৭ ধানের সংকরায়ন করে যে ধানের জাত তৈরি করেছেন তার নাম দেওয়া হয়েছে সেন্টু-১ ‘সুনালো’। দুধবিন্নির সঙ্গে মার্কাবিন্নি সংকরায়ন করে সেন্টু-৪ ‘বিশালীবিন্নি’, বিআর-১১-এর সঙ্গে চিনিশাইল সংকারায়ন করে সেন্টু-৮ ‘সেন্টুশাইল’, বিআর-১১-এর সঙ্গে চিনিশাইল সংকারায়ন করে সেন্টু-৯ ‘রুপাশাইল’ জাত উদ্ধাবন করেছেন তিনি। এ ছাড়া বিআর-১১-এর সঙ্গে চিনিশাইল সংকরায়ন করে সেন্টু-১০ ‘মেরিগোল্ড’, বিআর-১১-এর সঙ্গে চিনিশাইল সংকরায়ন করে সেন্ট-১১ ‘রানীশাইল’, বিআর-১১-এর সঙ্গে চিনিশাইল ও আরেকটি দেশি জাতের ধানের সংকরায়ন করে সেন্টু-১২ ‘সেন্টু গোল্ড’ ধানের নাম দেওয়া হয়েছে।

সেন্টু চিনিশাইল, তুলসিমালা, চাপাল, পাইজাম, বাইশমুঠি, হরি, স্বর্ণলতা ও রঞ্জিত ধানের সঙ্গে সংকরায়ন করে নতুন জাতের ধানের বীজ উদ্ভাবন করেছেন। তবে এখনও এইসব ধানের কোনো নাম দেওয়া হয়নি।

সেন্টু হাজংয়ের সংরক্ষণে থাকা বীজ দিয়ে চাষাবাদ করে ইতোমধ্যে শেরপুরসহ অন্যান্য জেলার শতাধিক কৃষক লাভবান হয়েছেন।

সেন্টুর তৈরি সার ও কীটনাশক

সেন্টু হাজং মনে করেন, ফসলের মাটি ভালো রাখতে এবং ভালো ধান পেতে হলে জৈব পদ্ধতিতে তৈরি সার ও কীটনাশক ব্যবহার করা উচিত। তাই তিনি বাজার থেকে রাসায়নিক সার ও কীটনাশক কিনে ফসলে দেন না বললেই চলে। 

তিনি নিজের তৈরি করা জৈব সার ও কীটনাশক ব্যবহার করেন। এ জন্য কেঁচোর বিষ্টায় কম্পোজ সার ও নিমপাতা, মেহগনির বিচি, আতাফলের পাতা দিয়ে জৈব পদ্ধতিতে কীটনাশক তৈরি করেন। এই কীটনাশক ব্যবহারে ভালো ফসল যেমন পাওয়া যায়, তেমনি রাসায়নিক সার কেনার টাকাও বেঁচে যায়।

কাজের স্বীকৃতি

সেন্টু হাজংয়ের উদ্ভাবনের স্বীকৃতিস্বরূপ ২০১৭ সালের ৬ মে ইস্টল্যান্ড ইনস্যুরেন্স কোম্পানি ঢাকা আর্মি গলফ গার্ডেনের হলরুমে তাকে ক্রেস্ট ও এক লাখ টাকা দিয়ে সংবর্ধনা দেয়। এ ছাড়াও সম্প্রতি ধান গবেষণা প্রতিষ্ঠান ও বিনার গবেষকরা সেন্টু হাজংয়ের কর্মকাণ্ড পরিদর্শন করে আরও উন্নত গবেষণার জন্য তার উদ্ভাবিত ধানের বীজ নিয়ে যান। গবেষকরা সেন্টুকে সব ধরনের সহযোগিতার অশ্বাস দিয়েছেন।

 

প্রিয় সংবাদ/রিমন

পাঠকের মন্তব্য(০)

মন্তব্য করতে করুন


আরো পড়ুন

loading ...