(প্রিয়.কম) রোহিঙ্গা তথা মিয়ানমার পরিস্থিতি ক্রমেই জটিল হয়ে উঠছে। সাথে জটিল হয়ে উঠছে পক্ষ-বিপক্ষের রসায়ন। বিশেষ করে আঞ্চলিক ও আন্তর্জাতিক রাজনীতির পক্ষ-বিপক্ষের বিষয়টি মিয়ানমার ইস্যুতে কেমন যেন গোলমেলে হয়ে যাচ্ছে। একটা প্রচলিত ধারণা রয়েছে যে, মিয়ানমারের পেছনে হচ্ছে চীন। চীনই মিয়ানমারের মূলশক্তি। কিন্তু ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির মিয়ানমার সফরে ‘মিয়ানমারের এই সংকটে ভারত পাশে থাকবে’ এমন ঘোষণা এ ধারণাকে আমূল প্রশ্নবিদ্ধ করেছে। এ প্রশ্নবিদ্ধতাকে আরও বাড়িয়ে দিয়েছে আয়ারল্যান্ড থেকে প্রকাশিত অনলাইন ‘দ্য আইরিস ইন্ডিপেন্ডেন্টে’ প্রকাশিত একটি প্রতিবেদন। গণমাধ্যমটি বলেছে, মিয়ানমারের বিরুদ্ধে জাতিসংঘের সম্ভাব্য পদক্ষেপ ঠেকানোর জন্য মিয়ানমার চীন ও রাশিয়ার সাথে কূটনৈতিক তৎপরতা শুরু করেছে। চীন যদি মিয়ানমারের মূল শক্তি হয় তাহলে তার সাথে নতুন করে আবার কেন কূটনৈতিক তৎপরতা! তবে কী গোপনে মিয়ানমার তার ‘কেবলা’ পরিবর্তনের দিকে এগিয়ে যাচ্ছিল?
‘কেবলা’ পরিবর্তনের এই সংবাদটির গোড়ায় আরেকটু পানি ঢেলেছে মিয়ানমার সেনাবাহিনীকে ইসরায়েলের প্রশিক্ষণ ও সামরিক সহায়তার ব্যাপারটি। সাথে বাতাসে গুজব রয়েছে, ইসরায়েল ও মার্কিনীদের মিয়ানমারের তেলসহ প্রাকৃতিক সম্পদে শ্যেন দৃষ্টির বিষয়ে। চীনের প্রধান প্রতিপক্ষ যুক্তরাষ্ট্র, আর যুক্তরাষ্ট্রের প্রধানতম বন্ধু ইসরায়েল, সুতরাং হিসাবটি সহজাতভাবেই প্রশ্নবোধক। যারা চীনের ‘ওয়ান বেল্ট ওয়ান রোড’ নীতিকে সামনে এনে মিয়ানমার আর চীনের সম্পর্ক অবিচ্ছেদ্য ভাবতে চাচ্ছেন তারাও উপরোক্ত বিষয়গুলির ওপর নজর দিতে পারেন। সর্বোপরি, মিয়ানমারের মতো সীমিত গণতন্ত্র বা গণতন্ত্রহীন এবং যারা অর্থনৈতিকভাবেও সবল নয়, এমন দেশগুলোর রাজনীতি নানা কারণে পরনির্ভরশীল হয়ে দাঁড়ায়, এদের ক্ষমতাসীনদের প্রায়শই বন্ধু বদল করতে হয় এবং এতে অন্যরা সুযোগ নেয়, এমন বিষয়টিও ভাবনার বাইরে রাখা উচিত নয়।
সাম্প্রতিক আন্তর্জাতিক রাজনীতিতে চীনের সাথে রাশিয়ার একটি প্রচ্ছন্ন সম্পর্ক সবারই জানা। মধ্যপ্রাচ্যে এদের সাথে মিলেছে ইরান। ইউরোপের মুসলিম দেশ তুরস্কও এখন চীন-রাশিয়ামুখী। এই হিসাবে রোহিঙ্গা ইস্যুতে তুরস্কের প্রেসিডেন্ট পত্নীর বাংলাদেশে আগমন এবং রোহিঙ্গাদের দুর্দশা স্বচক্ষে দেখার প্র্রয়াসকেও আন্তর্জাতিক রাজনীতির বাইরে রাখা যাবে না। আর আঞ্চলিক রাজনীতিতেও রয়েছে ‘টুইস্ট’। এমন পরিস্থিতিতে মোদির মিয়ানমার সফর দক্ষিণ এশিয়ার রাজনীতির বাতাসে উল্টো স্রোতেরই আভাস দিচ্ছে। চীন যদি মিয়ানমারের পাশে থাকে, তবে পাকিস্তানের ভূমিকা থাকবে অন্তত নিরপেক্ষ। কিন্তু পাকিস্তানকে দোষারোপ করা হচ্ছে আরাকানকে ইসলামী স্টেট বানানোর মদদদাতা হিসেবে। চীন আর পাকিস্তানের বন্ধুত্ব বর্তমান বিশ্ব রাজনীতিতে একেবারে খোলামেলা। সুতরাং পাকিস্তানকে এমন দোষারোপ ও মিয়ানমারে মোদির উষ্ণ সংবর্ধনা রাজনীতির উল্টো বাতাসেরই জানান দেয়। বাতাসের এই গতিপথ বুঝতে আমাদের প্রতিনিধিদলের চাল আমদানির নিমিত্তে এ সময়ে মিয়ানমারে যাওয়াটাও হিসাবে আনতে হবে।
উপরোক্ত বিষয়গুলি থেকে ধারণা করতে সম্ভবত কষ্ট হয় না রোহিঙ্গা ইস্যুতে আন্তর্জাতিক এবং এশিয়া তথা দক্ষিণ এশিয়ার রাজনৈতিক জটিলতার বিষয়টি। কিন্তু রাজনীতি যতই জটিল হোক, মিয়ানমারের বিরুদ্ধে সারাবিশ্বে একটি জনমত গঠন হয়ে গেছে। দেশে দেশে রাষ্ট্রপ্রধানদের সম্পর্কের জটিলতা থাকতে পারে কিন্তু নিপীড়িতদের পক্ষে দাঁড়াতে জনগণ সবসময়েই একাট্টা। যেমন আরবজাহানের শাসকদের মধ্যে কলহ রয়েছে, বৈরিতা রয়েছে কিন্তু মানুষের মধ্যে তেমনটা নেই, থাকলে আইসিসকে বাইরে থেকে যোদ্ধা আনতে হতো না, শাসকদের ডেকে আনতে হতো না যুক্তরাষ্ট্র আর বৃটেনকে। এটা বুঝতে খুব বেশি জ্ঞানী হবারও প্রয়োজনও নেই।
জনমতের একটা প্রবল চাপ রয়েছে, এটা খুব বেশিদিন এড়িয়ে চলা সম্ভব নয়, অন্তত ইতিহাস তাই বলে। স্বৈরশাসকদের দিকে তাকান, জনমতের প্রবল চাপ হয়ত তারা শক্তির জোরে উপেক্ষা করে, কিন্তু তাদের সেই শক্তির উৎস খুঁজতে বন্ধু অন্যার্থে প্রভু বের করতে হয়, স্বার্থের একটু তারতম্য হলে নতুন আরেক শক্তি তথা প্রভুর খোঁজে বের হতে হয়। আর এই খোঁজাখুঁজির সামান্য এদিক-সেদিক হলেই ‘কেল্লা ফতে’।
যা হোক, অনেকের হায় আফসোস দেখলাম বিশ্বের দুই প্রধানতম পরাশক্তি আমেরিকা ও চীনের রোহিঙ্গা ইস্যুতে নিরবতা বিষয়ে। কেউ দু’পা এগিয়ে বললেন, এক এরদোয়ান কী করবে রোহিঙ্গাদের পাশে থেকে। এমন ধারণার পেছনেও কারণ রয়েছে, রয়েছে দুঃখজনক কিছু উদাহরণও, বসনিয়ার কথা বলা যায়। গণহত্যার যেই স্মৃতি এখনও মুছে যায়নি। কিন্তু তারপরের কথা কী কারও মনে আছে? পরিণতিটাও মনে রাখা জরুরি। জনমতের বহমান ঘৃণা কোনো সাময়িক বিষয় নয়, এটা প্রবাহমান। মানুষ যখন অত্যাচারিত হয়, তখনই অত্যাচারীর অবয়ব এবং অত্যাচারের কারণসমূহ সম্মুখে চলে আসে, আর তার সাথে আসে সমাধান ও প্রতিরোধের প্রয়াসও। ইতিহাস ঘেটে দেখুন, অত্যাচারিতের রক্তের শোধ সময় ঠিকই নিয়ে নেয়।
পুনশ্চ: রোহিঙ্গা ইস্যুতে আন্তর্জাতিক ও আঞ্চলিক রাজনীতির জটিলতা এবং প্রশ্নবিদ্ধতা নিয়েই মূলত উপরোক্ত আলোচনা। তবে এ আলোচনার ভিত্তিতে কোনো কংক্রিট সিদ্ধান্তের জন্য সময়টা এখনও সঠিক নয়, আরও অপেক্ষা করতে হবে। আপাত হয়ত হাজারো মানুষের প্রাণ, ইজ্জত ও সম্পদের বিনিময়ে রোহিঙ্গা ইস্যুর একটি আপদকালীন সমাধান হবে কিন্তু সময়সাপেক্ষে সৃষ্ট রাজনৈতিক জটিলতার মাশুল দিতে হবে অবশ্যই মিয়ানমারকে। সাথে জটিলতায় আক্রান্ত এশিয়া ও দক্ষিণ এশিয়ার রাজনীতিকেও পরিবর্তনের মাশুল গুনতে হবে এবং সেই মাশুল হবে দীর্ঘমেয়াদি। এর আপাতত কোনো বিকল্প নেই, সময়ের দায় শোধ করতে হয় সবাইকেই।
ফুটনোট: রোহিঙ্গাদের বিরুদ্ধে ঘটা অত্যাচারের বর্ণনা এ লেখায় নেই। প্রতিদিন গণমাধ্যম বিশেষ করে সামাজিকমাধ্যমে যা দেখছি তার বর্ণনা আমার লেখনির সাধ্যাতীত। যতটুকু সম্ভব আগের লেখাগুলোতে লিখেছি। পশুত্বের ধারকদের পাশবিকতার ক্ষমতা সীমাহীন। কিন্তু মানবিকতার পক্ষের মানুষদের সেই পাশবিকতার বর্ণনার সীমা মানবিক কারণেই সীমিত। সেই সীমিত সাধ্যেও বুকের বাষ্পতে চোখের দৃষ্টি রুদ্ধ হয়, গলা বন্ধ হয়ে আসে। লেখা হয় না, বলা হয় না। রুদ্ধ দৃষ্টি, বন্ধ গলায় জেকে বসে শুধু ঘৃণা।
ই মেইল: [email protected]
[প্রকাশিত মতামত লেখকের একান্তই নিজস্ব। প্রিয়.কম লেখকের মতাদর্শ ও লেখার প্রতি শ্রদ্ধাশীল। প্রকাশিত মতামতের সঙ্গে প্রিয়.কম-এর সম্পাদকীয় নীতির মিল নাও থাকতে পারে।]
পাঠকের মন্তব্য(০)
মন্তব্য করতে লগইন করুন