(প্রিয়.কম) আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংস্থা অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনাল রোহিঙ্গা ইস্যুতে তাদের দেওয়া সর্বশেষ প্রতিবেদনে রোহিঙ্গাদের ওপর মিয়ানমার সেনাবাহিনীর নির্যাতন, হত্যা, ধর্ষণসহ মানবতাবিরোধী অপরাধের স্পষ্ট প্রমাণ হাজির করেছে।
রোহিঙ্গা ইস্যুতে অ্যামনেস্টি এর আগে যতগুলো প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে, এ প্রতিবেদনটি তাদের মধ্যে সবচেয়ে বিশ্লেষণাত্মক ও দীর্ঘ। রাখাইনের সহিংসতা থেকে বাংলাদেশে পালিয়ে এসেছেন, এমন ১২০ জন রোহিঙ্গা নারী পুরুষের সাক্ষাৎকারের ভিত্তিতে এই প্রতিবেদনটি তৈরি করা হয়েছে।
রোহিঙ্গাদের নিশ্চিহ্ন করতেই মিয়ানমনার সেনাবাহিনী রাখাইনে অভিযান শুরু করেছে ও পরিকল্পিতভাবে খুন, ধর্ষণ ও অগ্নিসংযোগ করেছে বলে জানানো হয়েছে এতে। অ্যামনেস্টি বলছে, প্রত্যক্ষদর্শীদের জবানবন্দী, স্যাটেলাইট থেকে পাওয়া ছবি-ভিডিও এবং সব ধরনের তথ্য উপাত্ত বিশ্লেষণ করে এ উপসংহারে উপনীত হওয়া যায় যে, ‘রাখাইনে হাজার হাজার রোহিঙ্গা নারী, পুরুষ ও শিশুদের ওপর পরিকল্পিত আক্রমণ চালানো হয়েছে এবং এটি মানবতার বিরুদ্ধে সুস্পষ্ট অপরাধ।’
আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালতের রোম চুক্তিতে যে ১১ ধরনের অপরাধকে মানবতার বিরুদ্ধে অপরাধ হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে, রাখাইনের সহিংসহায় তার মধ্যে ৬টি অপরাধের প্রমাণ পাওয়া গেছে। এ অপরাধগুলোর মধ্যে রয়েছে, হত্যা, জোরপূর্বক নির্বাসন, ধর্ষণ, নিপীড়ন, নির্যাতন।
প্রত্যক্ষদর্শীরা এসব নৃসংশ অপরাধের জন্য মিয়ানমার সেনাবাহিনীর পশ্চিমাঞ্চলীয় কমান্ড, ৩৩ লাইট ইনফ্যান্ট্রি ডিভিশন এবং সীমান্তরক্ষা বাহিনীকে দায়ী করেছে।
অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনালের একজন পরিচালক তিরানা হাসান বলছেন, ‘রাখাইনে মিয়ানমার সেনাবাহিনী যে বর্বরতম অভিযান চালিয়েছে, তার উদ্দেশ্যই হচ্ছে রোহিঙ্গাদের স্থায়ীভাবে মিয়ানমার থেকে উচ্ছেদ করা। এ অভিযানের কারণে কয়েক দশকের মধ্যে এ অঞ্চলে সবচেয়ে বড় শরণার্থী সঙ্কটের সৃষ্টি হয়েছে।’
তিনি বলেন, ‘এসব নৃসংশ অপরাধের ন্যায়বিচার পাওয়ার প্রথম ধাপ হচ্ছে অপরাধগুলোর কথা ফাঁস করে দেওয়া। অপরাধীদের অবশ্যই বিচার হতে হবে। আরেকটি ভুয়া তদন্তের নামে মিয়ানমার সেনাবাহিনী এ ঘটনা কিছুতেই ধামাচাপা দিতে পারে না।’
বাংলাদেশমুখী রোহিঙ্গা জনস্রোত। ইউএনএইচসিআর-এর ড্রোন থেকে ১৬ অক্টোবর সোমবার তোলা ছবি।
রাখাইনের মংডুর মিন গিই নামের একটি গ্রামে এবং বুথিডংয়ের কিউন পক গ্রামে মিয়ানমার সেনাবাহিনী নারীদের ধর্ষণ করেছে, এমন প্রমাণ অ্যামনেস্টির হাতে এসেছে বলে দাবি করেছে মানবাধিকার বিষয়ক এ সংস্থাটি। চারজন নারী ও ১৫ বছর বয়সী একজন কিশোরী অ্যামনেস্টিকে জানিয়েছেন, তারা মিয়ানমার সেনাবাহিনীর দ্বারা ধর্ষণের শিকার হয়েছেন।
পরিচয় গোপন রেখে ৩০ বছর বয়সী এন রোহিঙ্গা নারীর বক্তব্য প্রতিবেদনে তুলে ধরা হয়েছে। তিনি জানান, সেনাবাহিনীর সদস্যরা প্রথমে বাড়ি বাড়ি ঘুরে প্রথমে নারীদের আলাদা করে ফেলে। এরপর তাদের আটকে রেখে জোর করে টাকাপয়সা ও অন্যান্য জিনিসপত্র ছিনিয়ে নেয়।
ওই নারী বলেন, ‘আমার দুই বছরের ছেলে শফিকে তারা লাঠি দিয়ে মাথায় আঘাত করে। এক আঘাতেই শফি সাথে সাথে মারা যায়। আমার বাকি তিন ছেলেকেও খুন করা হয়।’
তিনি জানান, এরপর সেনাবাহিনীর সদস্যরা সব নারীকে উলঙ্গ করে ও তাদের হাতের লাঠি দিয়ে মাথায় আঘাত করে। এতে নারীরা দুর্বল হয়ে পড়ার সেনারা লাঠি দিয়ে তাদের যৌনাঙ্গে আঘাত করে। এরপর তারা তারা ধর্ষণ করে।
গত ২৫ আগস্ট রাখাইনের পুলিশ চেকপোস্টে বিদ্রোহী গোষ্ঠী আরসা’র হামলার পর সেনা অভিযান শুরু হয়। সেনাবাহিনীর সাথে মাঝে মাঝে স্থানীয় সশস্ত্র গোষ্ঠীও যোগ দেয় বলে জানানো হয় অ্যামনেস্টির প্রতিবেদনে। সেনাবাহিনীর অভিযানের মুখে পালায়নরত রোহিঙ্গাদের পেছন থেকে গুলি করা হত্যা করা হয়।
১২ বছর বয়সী ফাতিমা অ্যামনেস্টিকে জানান, পাশের গ্রাম থেকে ধোঁয়া উঠছে দেখে তার আট ভাইবোন, মা-বাবা এবং বৃদ্ধ দাদী বাড়ি ছেড়ে পালানোর সময় সেনাবাহিনীর সদস্যরা তাদের পেছন থেকে গুলি করে। এতে তার বাবা এবং ১০-বছর বয়সী বোনের গুলিবিদ্ধ হয় এবং। তার ডান উরুতেও গুলি লাগে।
প্রসঙ্গত, গত ২৫ আগস্ট মিয়ানমারের রাখাইন রাজ্যে রোহিঙ্গা নিধন অভিযান শুরুর পর প্রাণ বাঁচাতে বাংলাদেশে পালিয়ে আসা রোহিঙ্গাদের সংখ্যা ইতোমধ্যে ৫ লাখ ৮২ হাজার ছাড়িয়ে গেছে বলে জানিয়েছে জাতিসংঘ। তবে বেসরকারি হিসাবে এ সংখ্যা ৬ লাখেরও বেশি।
সেপ্টেম্বরের শেষের দিকে পালিয়ে আসার হার আগের চেয়ে কিছুটা কমলেও, অক্টোবরের ১৫ তারিখ থেকে তা আবারও বৃদ্ধি পেয়েছে। চলমান রোহিঙ্গা ঢল অব্যাহত থাকলে শরণার্থীর এ সংখ্যা ১০ লাখে পৌঁছাতে পারে বলেও সতর্ক করেছে জাতিসংঘ।
প্রিয় সংবাদ/রিমন
পাঠকের মন্তব্য(০)
মন্তব্য করতে লগইন করুন