স্বতন্ত্র ইবতেদায়ি মাদ্রাসা জাতীয়করণের দাবিতে জাতীয় প্রেসক্লাবের সামনে অনশন করছেন শিক্ষকরা। ছবি: প্রিয়.কম

‘আমি শিক্ষক, কিন্তু মুখ দেখাতে লজ্জা হয়’

স্বতন্ত্র ইবতেদায়ি মাদ্রাসা জাতীয়করণের দাবিতে রাশিদা খাতুনের মতো দেশের বিভিন্ন অঞ্চল থেকে আসা শিক্ষকরা চলতি মাসের ১ তারিখ থেকে রাজধানীর জাতীয় প্রেসক্লাবের সামনে অবস্থান করছেন। দাবি আদায় না হওয়ায় আজ ৯ জানুয়ারি বেলা ১১টা থেকে তারা অনশন করছেন। এরই মধ্যে অসুস্থ হয়ে পড়ায় ১৯ জনকে হাসপাতালে ভর্তি করা হয়েছে।

প্রদীপ দাস
নিজস্ব প্রতিবেদক
প্রকাশিত: ০৯ জানুয়ারি ২০১৮, ১৬:৩৪ আপডেট: ১৯ আগস্ট ২০১৮, ০৯:৩২
প্রকাশিত: ০৯ জানুয়ারি ২০১৮, ১৬:৩৪ আপডেট: ১৯ আগস্ট ২০১৮, ০৯:৩২


স্বতন্ত্র ইবতেদায়ি মাদ্রাসা জাতীয়করণের দাবিতে জাতীয় প্রেসক্লাবের সামনে অনশন করছেন শিক্ষকরা। ছবি: প্রিয়.কম

(প্রিয়.কম) সিরাজগঞ্জ জেলার রায়গঞ্জের স্বতন্ত্র ইবতেদায়ি মাদ্রাসার শিক্ষক রাশিদা খাতুন। ১৭ বছর ধরে শিক্ষকতা করেও তিনি কোনো ধরনের বেতন-ভাতা পাননি। তিন ছেলেমেয়ের জননী এই শিক্ষিক বলেন, ‘পরিবারে এক টাকাও দিতে পারি না। ছেলেমেয়ে, স্বামী, পাড়ার মানুষের কাছে জবাবদিহি করতে হয়। তারা বলে, কী চাকরি কর, বেতন হয় না। আমি শিক্ষক, কিন্তু এই মুখ পরিবার, প্রতিবেশীর কাছে দেখাতে লজ্জা হয়। অনেকে বলে শিক্ষকতায় সম্মান আছে, পেটে ভাত না থাকলে সম্মান দিয়ে কী করব?’ এ সময় তার সঙ্গে ছিল ছয় বছর বয়সী ছেলে।

স্বতন্ত্র ইবতেদায়ি মাদ্রাসা জাতীয়করণের দাবিতে রাশিদা খাতুনের মতো দেশের বিভিন্ন অঞ্চল থেকে আসা শিক্ষকরা চলতি মাসের ১ তারিখ থেকে রাজধানীর জাতীয় প্রেসক্লাবের সামনে অবস্থান করছেন। দাবি আদায় না হওয়ায় আজ ৯ জানুয়ারি বেলা ১১টা থেকে তারা আমরণ অনশন শুরু করেছেন। এরই মধ্যে অসুস্থ হয়ে পড়ায় ১৯ জনকে হাসপাতালে ভর্তি করা হয়েছে। 

এ বিষয়ে জানতে কথা হয় গোবিন্দগঞ্জের সাখইল স্বতন্ত্র ইফতেদায়ি মাদ্রাসার শিক্ষক আবু সাঈদের সঙ্গে। তিনি জাতীয় প্রেসক্লাবের সামনে চলমান অনশনে অসুস্থদের হাসপাতালে আনা-নেওয়ায় স্বেচ্ছাসেবী হিসেবে কাজ করছেন। 

সাঈদ জানান, ৯ জানুয়ারি দুপুর সাড়ে ১২টা পর্যন্ত চলমান আন্দোলনে ১৯ জনের মতো আন্দোলনকারী অসুস্থ হয়ে পড়েন। বেলা ১১টায় অনশন শুরুর আগেই অনেককে হাসপাতালে ভর্তি করা হয়।

অনশন শুরুর পর ৫-৬ জনকে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। অসুস্থদের ডায়রিয়া, হঠাৎ কাঁপুনি ও জ্বরে আক্রান্ত হওয়ার উপসর্গ দেখা গেছে।

এত জন অসুস্থ হওয়ার কারণ ব্যাখ্যা করে আবু সাঈদ বলেন, যারা প্রেসক্লাবের সামনে অবস্থান করছেন, তাদের অধিকাংশই ১ জানুয়ারি থেকে এখানে আছেন। নয় দিনে প্রেসক্লাবের সামনে অবস্থান করে তারা দুর্বল হয়ে পড়েছে। এর মধ্যে দূরদুরান্ত থেকে গাড়িতে করে আসা, ঠিক মতো খাওয়া-দাওয়া না করা, ফুটপাতের খাবার খাওয়া, ভিন্ন পরিবেশ, অতিরিক্ত ঠাণ্ডার কারণে তারা অসুস্থ হয়ে পড়ছে।

প্রেসক্লাবের সামনে গিয়ে দেখা যায়, শত শত শিক্ষক অনশন করছেন। তাদের কেউ শুয়ে আছেন, কেউ বসে। তাদের মধ্যে কেউ কেউ নিজেদের কষ্ট মাইকে সবার সঙ্গে ভাগাভাগি করছেন। কষ্টের কথা বলতে গিয়ে নিজেই যেমন কাঁদছেন, সঙ্গে যারা শুনছেন, তারাও চোখ মুছে যাচ্ছেন। 

উপস্থিত গণমাধ্যমের সামনে মাইকে শিক্ষকদের বলতে শোনা যায়, এই শীতে দিন-রাত রাস্তায় অবস্থান করতে তাদের অনেক কষ্ট হচ্ছে। কিন্তু সরকার সেই কষ্ট শুনছে না। আন্দোলনে যেসব নারী শিক্ষক এসেছেন, তাদের অনেকের সঙ্গে আছে ছোট ছোট শিশু। সেই শিশুদের বাসায় রেখে আসা তাদের সম্ভব হয়নি। সে জন্য তাদের সঙ্গে খোলা আকাশের নিচে রাত কাটাচ্ছে অল্পবয়সী শিশুরাও।

আন্দোলনকারী শিক্ষিকাদের সঙ্গে সন্তানরা। ছবি : প্রিয়.কম

আন্দোলনকারী শিক্ষিকদের সঙ্গে আছে শিশু সন্তানরা। ছবি : প্রিয়.কম

জীবনযাপনে কষ্টের কথা বর্ণনা করে সিরাজগঞ্জের কাজীপুরের একটি ইবতেদায়ি মাদ্রাসার এক শিক্ষক জানান, ২৪ বছর শিক্ষকতা করে তিনি এক টাকাও বেতন-ভাতা পাননি। জমিজমাও নেই, তাই সংসার চালাতে শিক্ষকতা করার পর সকাল-বিকাল যে সময়টুকু পান, তখন সুতা কাটেন, কখনো বা অন্যের জমিতে কাজ করেন। তার স্কুল পড়ুয়া দুই ছেলেমেয়ে ও স্ত্রীও পাশের তাঁতি বাড়িতে সুতা কাটার কাজ করে।  অন্যের বাড়িতে কাজ করে, তার স্ত্রীও সংসারের কাজ শেষ সময় পেলে তাঁতি বাড়িতে সুতা কাটতে লেগে যান।

বাংলাদেশ স্বতন্ত্র ইবতেদায়ি মাদ্রাসা শিক্ষক সমিতির সভাপতি কাজাী রুহুল আমীন চৌধুরী বলেন, ‘অনেক শিক্ষক আছেন, যারা ৩৪ বছর ধরে চাকরি করছেন। কিন্তু বেতন পাচ্ছেন না। এ রকম পরিস্থিতিতে আমরা আটদিন প্রেসক্লাবের সামনে দিন-রাত অবস্থান করে নবম দিনে অনশন করছি। কিন্তু এর মধ্যে সরকারের পক্ষ থেকে কোনো সাড়া পাওয়া যাচ্ছে না। কিন্তু সরকার এভাবে নীরব থাকলে আমরা আমাদের আন্দোলন চালিয়ে যাব। আমাদের অনশন আমরণ, দাবি আদায় না হওয়া পর্যন্ত তা চলবেই।’

স্বতন্ত্র ইবতেদায়ি মাদ্রাসা শিক্ষক সমিতির দেওয়া সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়, ১৯৯৪ সালে বেসরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় ও স্বতন্ত্র ইবতেদায়ি মাদ্রাসার শিক্ষকদের বেতন ৫০০ টাকা করা হয়। এর পর বিভিন্ন সরকার ধাপে ধাপে ২৬ হাজার ১৯৩টি বেসরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়কে জাতীয়করণ করে। সেসব বিদ্যালয়ের শিক্ষকরা মাসে ২২ থেকে ৩০ হাজার টাকা বেতন পায়। কিন্তু এখন পর্যন্ত ইবতেদায়ি শিক্ষকরা তেমন কোনো বেতন পান না।

বিজ্ঞপ্তিতে উল্লেখ করা হয়, ১ হাজার ৫১৯টি মাদ্রাসার শিক্ষক নামমাত্র বেতন পায়। এসব মাদ্রাসার প্রধান শিক্ষক ২ হাজার ৫০০ টাকা ও সহকারী শিক্ষকরা ২ হাজার ৩০০ টাকা বেতন পায়। এই বেতন দুর্মূল্যের বাজারে অমানবিক, শিক্ষকদের অবমাননা ছাড়া কিছুই না।

 

 

 

 

 

 

পাঠকের মন্তব্য(০)

মন্তব্য করতে করুন


আরো পড়ুন

loading ...