ছবি সংগৃহীত

ব্যবসা গুটিয়ে নিচ্ছে কম্পিউটার সোর্স!

ইতোমধ্যে কম্পিউটার সোর্সের ৪৭টি শো-রুমের মধ্যে নোয়াখালী, চট্টগ্রাম (পাঁচটার মধ্যে ৩টা বন্ধ), ফেনীসহ ২৫টি বন্ধ হয়ে গেছে। অবশিষ্ট যে ২২টি শো-রুম চালু রয়েছে সেগুলোও বন্ধের পথে।

এম. মিজানুর রহমান সোহেল
জেষ্ঠ্য প্রতিবেদক
প্রকাশিত: ১২ মার্চ ২০১৭, ১২:০৩ আপডেট: ২০ আগস্ট ২০১৮, ২২:৩২
প্রকাশিত: ১২ মার্চ ২০১৭, ১২:০৩ আপডেট: ২০ আগস্ট ২০১৮, ২২:৩২


ছবি সংগৃহীত

কম্পিউটার সোর্সের লোগো। ছবি: সংগৃহীত

(প্রিয়.কম) দেশের শীর্ষ কম্পিউটার আমদানি ও বিপণন প্রতিষ্ঠান কম্পিউটার সোর্স লিমিটেড ব্যবসা গুটিয়ে নিচ্ছে বলে খবর পাওয়া যাচ্ছে। ব্যাংক থেকে শত শত কোটি টাকা কম্পিউটার ব্যবসা করার নামে ঋণ নিয়ে সেই টাকায় টাঙ্গাইল, কক্সবাজারসহ দেশের বিভিন্ন জেলায় কয়েক শত একর জমি ক্রয় এবং নিজেদের অনেক শো-রুম ক্রয়ের ফলে বিনিয়োগ করার নগদ টাকা সংকটে পড়েছে প্রতিষ্ঠানটি। ইতোমধ্যে দেশজুড়ে কম্পিউটার সোর্সের ৪৭টি শো-রুমের মধ্যে নোয়াখালী, চট্টগ্রাম (পাঁচটার মধ্যে ৩টা বন্ধ), ফেনীসহ ২৫টি বন্ধ হয়ে গেছে। অবশিষ্ট যে ২২টি শো-রুম চালু রয়েছে সেগুলোও বন্ধের পথে।

২০১২ সাল পরবর্তী কম্পিউটার সোর্স বেশ কয়েকটি ফ্ল্যাগশিপ শো-রুম চালু করেছিল প্রতিষ্ঠানটি। এর মধ্যে সবচেয়ে চোখে পড়ার মতো ছিল ধানমন্ডি-১৬ (পুরাতন-২৭)-এর শো-রুম। ৭ হাজার স্কয়ার ফিট এই শো-রুম চালু করার পর তারা লোকসানে পড়ে যায়। প্রতি মাসে লাখ লাখ টাকা খরচ হলেও আয়ের খাতায় ছিল শূন্য। ফলে এই শো-রুমটিও বন্ধ করে দেয় তারা। বৃহস্পতিবার তাদের সেই শো-রুমে যাওয়ার পর দেখা যায়, আগের সেই বিশাল শো-রুম আর নেই, সেখানে এখন স্ট্যান্ডার্ড ব্যাংক লিমিটেড একটি শাখা চালু হয়েছে। আর পাশে ছোট একটি কক্ষে চলে গেছে কম্পিউটার সোর্স।

অসংখ্য শো-রুম বন্ধের মধ্যে গুঞ্জন শোনা যাচ্ছে ব্যাংকের কাছে শত কোটি টাকা ঋণ নিয়ে ফেরত দিতে না পারার কারণে নতুন নামে ব্যবসা শুরু করতে যাচ্ছে কম্পিউটার সোর্স। নতুন এই প্রতিষ্ঠানের নাম দেওয়া হয়েছে 'স্টুডিও ম্যাশন লিমিটেড'। যদিও কম্পিউটার সোর্স একই সাথে ‘সিএসএম’ (কম্পিউটার সোর্স মেশিন) নামে একটি প্রতিষ্ঠান বাংলাদেশে এবং ‘সেভাল ইলেক্ট্রনিক্স লিমিটেড’ নামে আরও একটি প্রতিষ্ঠান সিঙ্গাপুরে পরিচালনা করছে। সম্প্রতি জানা গেছে, কম্পিউটার সোর্সের কাছে প্রোডাক্ট ও সার্ভিস নেওয়া হলে 'স্টুডিও ম্যাশন লিমিটেড' নামে ইনভয়েস (ক্রয় রশিদ) দেওয়া হচ্ছে। 

স্টুডিও ম্যাশন লিমিটেডের নামে দেওয়া ইনভয়েসে ঠিকানা দেওয়া বিটিএমসি ভবন, লেভেল-২, ৭-৯ কাজী নজরুল ইসলাম এভিনিউ, কাওরান বাজার, ঢাকা। টেলিফোন নম্বর দেওয়া হয়েছে ৯১৪১৫৭৭, ৯১২৭৫৯২, ৯১১৮৬৯৭। ওয়েবসাইটের ঠিকানায় দেওয়া আছে www.studiomasonbd.com এই ঠিকানা। তবে ওয়েবসাইটে গিয়ে দেখা গেছে সাইটটি এখনও চালু হয়নি। জানা গেছে, এই একই ঠিকানাতে কম্পিউটার সোর্সের কর্পোরেট ডিল করা হয়। এখান থেকেই স্টুডিও ম্যাশন লিমিটেড নামের নতুন এই প্রতিষ্ঠান যাত্রা শুরু করতে যাচ্ছে। কম্পিউটার সোর্সের একজন কর্মকর্তা বলছেন, ‘এখানে সোর্সের যেসব প্রোডাক্টে ওয়ারেন্টি নেই সেগুলোর সার্ভিস দেওয়া হয়’। তবে সোর্স নতুন নামে ব্যবসা করার উদ্দেশ্য কী, তা ব্যাখ্যা করতে পারেননি।

১৯৯৩ সাল থেকে আনুষ্ঠানিকভাবে কম্পিউটার সামগ্রী বাজারজাত শুরু করে প্রতিষ্ঠানটি। প্রায় তিন দশক ধরে ব্যবসা করতে গিয়ে কয়েক দফায় বিভিন্ন কারণে ব্যবসায় প্রভাব পড়লেও ২০১২ সালের পর থেকে অর্থনৈতিক সংকটে রয়েছে কম্পিউটার সোর্স। নিজেদের অনেক ব্যবসা প্রতিষ্ঠান বন্ধ করার পাশাপাশি গত এক বছরেই অন্তত দুই শতাধিক কর্মী ছাঁটাই করেছে তারা। প্রিয়.কম-এর কাছে এসব বিষয়ের সত্যতা স্বীকার করেছেন কম্পিউটার সোর্সের পরিচালক (ডিস্ট্রিবিউশন সেলস) এ ইউ খান জুয়েল। তিনি বলছেন, ‘আমাদের সম্পত্তি ক্রয় করা ঠিক হয়নি। আমাদের ব্যবসায় নগদ টাকার প্রয়োজন।’

এ ইউ খান জুয়েল বলেন, ‘অর্ধেক বন্ধ হয়েছে ঠিক আছে কিন্তু দেখুন আমাদের গুলশানে দুটি অফিস ছিল বা উত্তরায় দুটি অফিস ছিল এমন আরও কিছু অফিস আমাদের ছিল। তবে কিছু অফিস আমাদের কেবি স্কয়ারে নিয়ে এসেছি। সব কর্পোরেট অফিস একত্রিত করেছি। আমরা রিটেইলে ব্যবসা করলে ক্যাশ করতে পারি কিন্তু কর্পোরেটে যে ব্যবসা করা হচ্ছে সেখানে এখনও আমাদের ১৪০ কোটি টাকা বাকি পড়ে আছে।’ গত কয়েক বছরে কম্পিউটার সোর্সের যে ২২টি শো-রুম বন্ধ হয়েছে। সেখান থেকে প্রায় ৫০/৬০ জন কর্মী ছাঁটাই করা হয়েছে বলে তিনি জানান। তবে কর্মী ছাঁটাই দেখে অন্যান্য বিভাগের সব মিলে দুই শতাধিক কর্মী চাকরি ছেড়েছে বলেও তিনি জানান। 

কম্পিউটার সোর্সের একজন কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে প্রিয়.কমকে বলেন, ‘আমরা এখন সরাসরি রিটেইল না থাকার জন্য চেষ্টা করছি। এ জন্য কিছু কিছু সেলস সেন্টার বন্ধ হয়েছে। এ ছাড়া আমাদের সেলস সেন্টার বন্ধ করার জন্য ব্যবসায়ীরা আন্দোলনে নেমেছিল। ব্যবসায়ীরা দাবি করেছে কম্পিউটার মার্কেটে যেন কম্পিউটার সোর্স না থাকে। এসব কিছুর প্রেক্ষাপটে সেলস সেন্টারগুলো বন্ধ করে দেওয়া হচ্ছে। তবে আমাদের কোনো ডিস্ট্রিবিউশন বন্ধ হয়নি।’ তিনি দাবি করেন, ‘ব্যবসার প্রয়োজনে অনেক কিছু পরিবর্তন করা হয়। ঠিক একইভাবে এটা আমাদের বিজনেস প্লানের একটি অংশ।’

সেলসে এখন কেন থাকবেন না? জানতে চাইলে এই কর্মকর্তা বলেন, ‘দেখুন আমরা কোনো সেলস কোম্পানি না। ডিস্ট্রিবিউশন কোম্পানি। খুলনা ও বরিশালে কম্পিউটার সোর্স অফিসে হামলাও চালানো হয়েছিল। আগে প্রতিষ্ঠানের নিরাপত্তা নিশ্চিত করবেন নাকি ব্যবসা করবেন? আমরা নিরাপত্তার কথা আগে চিন্তা করেছি। আর আমরা কিছু সেলস সেন্টার বন্ধ করলেও এখন বড় পরিসরে এগিয়ে যাওয়ার পরিকল্পনা করছি। আগামী ১৩ মার্চ বঙ্গবন্ধু আন্তর্জাতিক সম্মেলন কেন্দ্রে লজিটেকের নতুন বাংলা কী-বোর্ড চালু হবে। আমরা ব্যবসা বন্ধ করে দিলে এসব নতুন করে চালু করছি কেন?’ 

নিজেদের ব্যবসার করুণ অবস্থার কারণে বিভিন্ন সময় নানা মুখী উদ্যোগ নিয়েছে কম্পিউটার সোর্স। এর মধ্যে অনলাইনে পণ্য বিক্রি করা এবং সম্প্রতি হার্ডওয়্যারের ব্যবসার পাশাপাশি ‘ইনফোটেক’ নামের নতুন একটি সফটওয়্যার উইং চালু করেছে। এ ব্যাপারে এ ইউ খান জুয়েল বলেন, ‘অনলাইনে আমরা প্রোডাক্ট বিক্রির ঘোষণা দিয়েছি কিন্তু ভালো রেসপন্স পাচ্ছি না। আর সফটওয়্যার ব্যবসা শুরু করেছি কারণ এখন এ ব্যবসার চাহিদা বৃদ্ধি পেয়েছে।’ 

তবে বাংলাদেশ কম্পিউটার সমিতির (বিসিসি) কার্যনির্বাহী কমিটির একজন নেতা নাম প্রকাশ না করার শর্তে প্রিয়.কমকে বলেন, ‘ক ব্যাংকম্পিউটার সোর্সের কাছে কয়েকশত কোটি টাকা পাওনা রয়েছে। ব্যাংক তাদের লেনদেন স্থগিত করেছে। কম্পিউটার ব্যবসায়ীদের আন্দোলনের কারণে তারা ব্যবসা বন্ধ করেনি। মার্কেটে টাকা মেরে দেওয়ার কোনো কারণও নেই। তাদের কর্মীদের ওপর কোনো হামলা হয়নি। আন্দোলন হয়েছে তিন বছর আগে। তাহলে এখন ব্যবসা বন্ধ করার কারণ কি? তাদের প্রায় সব আউটলেট বন্ধ। গত রোজার ঈদের আগে থেকেই ব্যবসা বন্ধের প্রক্রিয়া শুরু হয়েছে।’ 

তিনি আরও বলেন, ‘ডিস্ট্রিবিউটর হয়েও যখন কম্পিউটার সোর্স সারা দেশে শো-রুম খুলছিল তখন খুচরা পর্যায়ের ব্যবসায়ীরা ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। অনেক মার্কেটে ব্যবসায়ীরা রীতিমত আন্দোলনে নেমেছেন। তখন এসব কিছুই তোয়াক্কা করেনি প্রতিষ্ঠানটি। যতদিনে উপলব্ধি হয়েছে ততদিনে বাজারে অনেক খুচরা পর্যায়ের ব্যবসায়ীরা ক্ষতিগ্রস্ত হয়ে গেছেন। দেশজুড়ে যখন এসব শো-রুম করা হয় তখন স্থানীয় ডিলার ও খুচরা ব্যবসায়ীরা তীব্র আপত্তি করেছিল। আর এখন তা অপ্রয়োজনীয় মনে করছে, প্রচুর লোক ছাঁটাই করছে। বাজারে এর ফলে অস্থিরতা সৃষ্টি হবে।’

আগামী পর্বে পড়ুন - 

* এমএলএম ব্যবসা বন্ধের প্রভাব পড়েছে কম্পিউটার সোর্সে: খান জুয়েল

প্রিয় সংবাদ/রিমন

পাঠকের মন্তব্য(০)

মন্তব্য করতে করুন


আরো পড়ুন

loading ...