রুমানা বৈশাখী: আজ আমার দিনটা শুরু হয়েছে একটা কঠিন শক দিয়ে। আমার খুব মিষ্টি একজন বান্ধবী আছে। নাম শুনলে অনেকেই হয়তো চিনবেন, সে নিজে এককালে মিডিয়ায় পরিচিত মুখ ছিল। তবে সেটার চাইতেও বড় হচ্ছে, মেয়েটির একটি সাজানো-গোছানো সংসার ছিল। অতি ভালোমানুষ একটা বর, ফুটফুটে একটা কন্যা... তিনজনের একটা ঝলমলে পরিবার। যতবারই ওদের ছবি সামনে পড়তো ফেসবুকে ঘুরতে ঘুরতে , আমি হেসে ফেলতাম। মন ভালো করার হাসি। মনে মনে ভাবতাম- হে আল্লাহ, ঈর্ষার অন্ধকার ছায়া থেকে মানুষগুলিকে তুমি ভালো রেখো। কারো খারাপ দৃষ্টি এই সুখের ওপরে না পড়ুক।
সৃষ্টিকর্তা প্রার্থনা শোনেন নি। ঘুম থেকে উঠেই আজ প্রথমে যা দেখলাম, সেটা হচ্ছে বান্ধবীর বর মানুষটা আর বেঁচে নেই! ছবির মত সুন্দর পরিবারটা ছারখার হয়ে গিয়েছে। সদ্য বিধবা মেয়েটি বারবার হাহাকার করছে- 'আমি কোথায় তোমাকে খুজবো...কোথায় তোমাকে খুঁজবো' বলে।
এবার আসি একেবারে বিপরীত ঘটনায়...
রিলেশনশিপ কাউন্সিলার হবার সুবাদে এই অভিযোগগুলো আমি খুব শুনি... "আমার ওকে বোরিং লাগে, ওর সাথে আর ভাল্লাগে না!... ধুর, বিয়ের এত বছর কোন আবেদন থাকে নাকি? ... এত এত ঝগড়া হয় আমাদের, কোন ভালোবাসা অবশিষ্ট নাই।... ওর চেহারাও আর দেখতে ইচ্ছা করে না !... বাচ্চা না থাকলে কবেই ডিভোর্স দিয়ে ফেলতাম!"... ইত্যাদি ইত্যাদি শত রকমের অভিযোগ। ঘুরে ফিরে ওই একই কথা- অনেক ঝগড়া হয়, ইগো প্রবলেম, ওকে আর ভালবাসতে পারি না, ওকে আর চাই না! কেউ কেউ সঙ্গীর নানান আচরণে বিরক্ত হয়ে বলেই ফেলেন- "উফ, ও মরে গেলেই আমি বাঁচতাম!"
হ্যাঁ, বলতে গেলে এমন কথা রাগের মাথায় আমরা অনেকেই বলে ফেলি। প্রচণ্ড রাগে-ক্ষোভে হয়তো জীবনসঙ্গীর মৃত্যু কামনা করে বসি। মন থেকে না হলেও হয়তো মুখে মুখে। নানা ভাবে হয়তো সঙ্গী/সঙ্গিনীকে কষ্ট দিই। মনে করি, খুব "শাস্তি" দেয়া হচ্ছে। এর-তার কাছে আপন মানুষটার নামে দুর্নাম করা বা তাঁকে ছোট করে কথা বলার কাজটিও অনেক নারী-পুরুষ করে থাকেন। কিন্তু খুব সহজ করে একবার ভাবুন তো... তিনি যদি সত্যিই মরে যান? এই যে রাগের মাথায় তাঁর মৃত্যু কামনা করলেন, আপনার এই কামনা যদি সত্যি হয়ে যায় তাহলে কী হবে? সৃষ্টিকর্তা যদি আপনার ইচ্ছা কবুল করে নেন, যদি খুব অচিরেই একদিন মৃত্যু এসে তাঁকে নিয়ে যায়, কেমন বোধ করবেন তখন আপনি? সত্যিই কি তাঁর মৃত্যুতে আপনার জীবনটা অনেক বেশি সুখের হয়ে যাবে? সত্যি হবে তো?
ভাবুন... ভাবুন...
পৃথিবীর সবচাইতে নিশ্চিত ও অনিশ্চিত জিনিসটি হচ্ছে মৃত্যু। আসবে, আমরা সবাই জানি। কিন্তু কখন যে আসবে, সেটা কেউ জানি না। হয়তো সেটা জানি না বলেই ভুলে যাই যে মৃত্যুর থাবা বড় ভয়ংকর। রাতে যে মানুষটির দিক থেকে মুখ ফিরিয়ে নিয়ে ঘুমালাম, কালকের সকালে সেই মানুষটি বেঁচে নাও থাকতে পারে। সকালে যে মানুষটি ঘর থেকে বের হয়ে গেলো মন খারাপ করে, সন্ধ্যায় আর সে ঘরে নাও ফিরতে পারে। রাগের মাথায় ঝগড়া করে জীবন সঙ্গীর সাথে দুদিন কথা বললাম না, দুদিন পর আমার কথা শোনার জন্য মানুষটি বেঁচে নাও থাকতে পারে। হ্যাঁ, এটাই সত্য। এবং একমাত্র সত্য। মৃত্যু আসবেই, আমরা আমাদের সবরকম চেষ্টা করেও সেই মৃত্যুকে ঠেকিয়ে রাখতে পারবো না। তবু আমরা ভুলে যাই, মনে করি যে জীবনটা বুঝি চিরকালের। এই যে মানুষটা সাথে আছে, পাশে আছে... এভাবেই বুঝি চিরকাল কেটে যাবে। আমরা ভুলে যাই। মাঝে মাঝে যে মানুষটি থেকে দূরে গিয়ে হাঁপ ছেড়ে বাঁচি... একদিন তাঁকে আর একবার দেখার জন্য আজীবন হাহাকার করতে হতেও পারে!
আমি আমার জীবন থেকে সবচাইতে গুরুত্বপূর্ণ যে শিক্ষাটা পেয়েছি, সেটা হচ্ছে- কেবল আর কেবল মাত্র মৃত্যু সত্য। আর তাই, জীবন কেবল মাত্র বর্তমানে। এই ছোট্ট জীবনের মুহূর্তগুলো তিক্ততায় পার করার বোকামি আর হতে পারে না। সৃষ্টিকর্তা আমাদের জীবন দিয়েছেন , কিন্তু সেই জীবনকে আমরা কীভাবে যাপন করবো সেটা আমাদের হাতে দিয়ে দিয়েছেন। আজ ঝগড়া করলাম, কাল ভালবাসবো- আজ কটু কথা বললাম, কাল ভালো কথা বলবো- আজ অন্যায় করলাম- কাল ক্ষমা চেয়ে নিব... এমন ভাবনা সকলেই ভাবি। কিন্তু, সেই কালটা যদি আর না আসে? যদি আজ ঝগড়া করে কাল ভালোবাসার, কাল ভালো কথা বলার, কাল ক্ষমা চাইবার সুযোগটি আর না পাই? যদি আজই নির্ধারিত হয়ে থাকে আমার বা তাঁর মৃত্যু?
জীবন তাই এখন, জীবন তাই এখানে!
বিশ্বাস করুন, পৃথিবীর কোন কিছুই আপনার প্রিয় মানুষগুলির চাইতে জরুরী নয়। অর্থ, ক্ষমতা, ক্যারিয়ার ইত্যাদি আরও শতেক জিনিসের পেছনে ছুটি আমরা প্রতিদিন। অনুভব করতে পারি না যে সবচাইতে দামী জিনিসটা আমার পাশেই আছে- প্রিয়জন, প্রিয়জনদের ভালোবাসা! আজকে যে ভালোবাসার সুযোগটুকুন হেলায় হারাচ্ছি, কাল সেই সুযোগের জন্য মাথা কুটে মরতে হতেও পারে। জীবন তাই কেবল বর্তমানেই... যে বর্তমানে প্রিয় মানুষটাকে ভালোবাসার এক বিন্দু সুযোগ হেলায় হারাতে নেই!
শেষ কথা
আমাকে অনেকেই জিজ্ঞাসা করে, "আপু, আপনি আর ভাইয়া এত ভালো থাকেন কীভাবে? আপনাদের দেখলেই মনে হয় অনেক সুখী, কখনো ঝগড়া হয় না।!"... ভুল! একদম ভুল। নিখুঁত দাম্পত্য বলে কিছু নেই। আমাদেরও ঝগড়া হয়, খুব হয়। কিন্তু আমরা কখনো সেই ঝগড়াকে বেঁচে থাকতে দিই না। আজকের ঝগড়াকে কখনো আমরা পৌঁছাতে দিই না আগামীকাল পর্যন্ত। মতবিরোধ যতই হোক, কখনোই দূরত্ব এত হতে দিই না যে পরস্পরকে ভালবাসতে পারবো না। আমরা এমনভাবে বাঁচি, যেন এটাই একসাথে থাকার শেষ সময়, ভালোবাসার এই একটি মাত্র সুযোগ। সবটুকু ভালোবাসা আমরা বর্তমানেই বাসি, ভবিষ্যতের করবো ভেবে কিচ্ছু তুলে রাখি না। কারণ...
কারণ ভালোবাসার জন্য খুব ছোট্ট এই জীবন। খুব ছোট্ট!
আজকে ক্ষমা চান, আজকে সময় দিন, আজকে ভালবাসুন।
আর যদি খুব রাগ হয় জীবনসঙ্গীর প্রতি, মনে মনে চিন্তা করে দেখুন- মৃত্যু এসে যদি তাঁকে ছিনিয়ে নিয়ে যায়, আপনি সহ্য করতে পারবেন তো?
ভেবে দেখুন... ভেবে দেখুন...
অনেক অহেতুক রাগ-অভিমান মিটে গিয়ে সম্পর্কগুলো আরও আপন হয়ে উঠবে। ঝগড়া আর মতবিরোধের কারণগুলোকে খুব তুচ্ছ মনে হবে জীবনের সামনে। প্রিয় মানুষটির সাথে প্রতিটি মুহূর্ত আরও গভীর হয়ে উঠবে, হবে আরও অর্থবহ।
বোকা মেয়ের ডায়রির অন্যান্য পর্ব পড়তে ক্লিক করুন
পাঠকের মন্তব্য(০)
মন্তব্য করতে লগইন করুন