দ্বাদশ সংসদ জাতীয় নির্বাচনকে সামনে রেখে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ ও সংসদের বাইরে থাকা বিএনপি বিপরীতমুখী অবস্থানে অনড় রয়েছে। পাল্টাপাল্টি কর্মসূচিকে কেন্দ্র করে তৈরি হচ্ছে অনিশ্চয়তা ও সংকট। সরকার পতনের এক দফা দাবিতে ২৭ জুলাই ঢাকায় মহাসমাবেশের ঘোষণা আগেই দিয়েছে বিএনপিসহ সরকারের বাইরে থাকা একাধিক দল। এবার একই দিন ঢাকায় ‘শান্তি সমাবেশে’র ডাক দিয়েছে যুবলীগ, স্বেচ্ছাসেবক লীগ ও ছাত্রলীগ। এর মাধ্যমে আওয়ামী লীগ সহিংসতার পাঁয়তারা করছে বলে অভিযোগ করেছে বিএনপি। যদিও আওয়ামী লীগ বলছে, দলটির পক্ষ থেকে সংঘাতের কোনো শঙ্কা নেই।
বিশ্লেষকরা বলছেন, দেশ ও রাজনীতির জন্য এই বিপরীতমুখী সংঘাতপূর্ণ অবস্থান কোনোভাবেই কাম্য নয়। এটি দেশের মানুষকে আতঙ্কিত করছে, দুর্ভোগে ফেলছে। রাজনীতি সম্পর্কে মানুষ ভুল ধারণা করছে।
এর আগে ১৮ ও ১৯ জুলাই বিএনপির এক দফা দাবিতে পদযাত্রা এবং আওয়ামী লীগের শান্তি ও উন্নয়ন শোভাযাত্রা কর্মসূচির সময় দেশের বিভিন্ন জায়গায় হামলা ও সংঘর্ষ হয়েছে। ওই দুই দিনে দুই জন নিহত এবং আহত হয়েছেন অনেকে। এর এক সপ্তাহ পর ২৭ জুলাই ঢাকায় মহাসমাবেশের ডাক দেয় বিএনপি। একই দিন শান্তি সমাবেশের ঘোষণা দিলো আওয়ামী লীগের তিন সংগঠন। শান্তি সমাবেশের স্থান ঠিক হলেও বিএনপির মহাসমাবেশের স্থান এখনও নির্ধারিত হয়নি।
সমাবেশ বা অন্য কোনো কর্মসূচির মাধ্যমে মুখোমুখি অবস্থান নেওয়া রাজনীতির জন্য খুবই দৃষ্টিকটূ বলে মনে করছেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক ড. সাব্বির আহমেদ। তিনি প্রিয়.কমকে বলেন, ‘যেহেতু বিএনপির সমাবেশের তারিখ আগে ঘোষণা হয়েছে, আওয়ামী লীগ চাইলে অন্যদিন করতে পারত। তাহলে বিষয়টা মানুষও ভালোভাবে দেখত।’
আলাদা দিনে সমাবেশ করলে সবচেয়ে ভালো হতো জানিয়ে ড. সাব্বির আহমেদ বলেন, ‘সংঘাতের আশঙ্কা সাধারণত নির্ভর করছে জায়গার ওপর। দুই দল কোন লোকেশনে সমাবেশ করবে, তারওপর। যদি আলাদা আলাদাভাবে হয় যে, এক দল উত্তর সিটিতে অন্য দল দক্ষিণ সিটিতে এবং পুলিশের যথেষ্ট প্রস্তুতি থাকে তাহলে সংঘাতের আশঙ্কা থাকে না। কিন্তু যদি মুখোমুখি হয় বা কাছাকাছি জায়গায় সমাবেশ হয় তাহলে সংঘাতের আশঙ্কা খুব স্বাভাবিক। যা কখনও কাম্য নয়।’
তিনি বলেন, ‘২৪ জুলাইয়ের সমাবেশকে পিছিয়ে বিএনপির সমাবেশের দিন নিয়ে যাওয়াটা এক ধরনের দৃষ্টিকটূ। এর মধ্য দিয়ে রাজনীতি সম্পর্কে জনগণ ভুল ধারণা হচ্ছে যে, এভাবে আসলে কী অর্জন করতে চায়? আওয়ামী লীগেরই বা লাভ কী?’
২৭ জুলাই বিএনপির মহাসমাবেশকে কেন্দ্র করে সহিংসতার আশঙ্কা প্রকাশ করেছেন দলটির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর। তিনি বলেন, ‘যুবলীগের কর্মসূচি ছিল ২৪ জুলাই। আমাদের কর্মসূচি ঘোষণার পর যুবলীগ ২৭ জুলাই তাদের কর্মসূচি নিয়ে গেছে। সংঘাতপূর্ণ অবস্থার তৈরি করতেই তারা এটা করেছে, তা পরিষ্কার।’
এ দিন কোনো ধরনের সহিংসতার ঘটনা ঘটলে দায় সরকারকে নিতে হবে বলেও মন্তব্য করেন মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর। তিনি আরও বলেন, ‘আমরা এখন পর্যন্ত যতগুলো আন্দোলন করেছি, প্রতিটি আন্দোলন শান্তিপূর্ণ ছিল। আমাদের দুজন লোক নিহত হয়েছেন, ৯ হাজার মিথ্যা মামলা করেছে, তারপরও আমরা শান্তিপূর্ণভাবে জনগণকে সঙ্গে নিয়ে এগিয়ে যাচ্ছি। আমরা আশা করব, ভয়াবহ সংঘাতপূর্ণ পরিস্থিতি পরিহার করবে আওয়ামী লীগ ও যুবলীগ এবং সরকার এটা নিশ্চিত করবে।’
সমাবেশ নিয়ে আওয়ামী লীগের পক্ষ থেকে কোনো ধরনের সংঘাতের আশঙ্কা নেই বলে জানিয়েছেন দলটির সাধারণ সম্পাদক এবং সড়ক পরিবহন ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের। তিনি বলেন, ‘সংঘাতের উসকানি আমরা কখনো দেবো না। আমরা পাওয়ারে আছি। আমরা শান্তিপূর্ণভাবে দেশ চালাতে চাই। শান্তিপূর্ণ নির্বাচন চাই।’
গত ২২ জুলাই ঢাকার সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে বিএনপির ৩ সংগঠন ছাত্রদল, যুবদল ও স্বেচ্ছাসেবক দলের ‘তারুণ্যের সমাবেশ’ থেকে নতুন কর্মসূচি ঘোষণা করা হয়। প্রধানমন্ত্রীর পদত্যাগ, সংসদ ভেঙে দেওয়া এবং নির্বাচনকালীন নিরপেক্ষ সরকার গঠনসহ ১ দফা দাবিতে বিএনপির যুগপৎ আন্দোলনের অংশ হিসেবে গণতন্ত্র মঞ্চ, গণফোরাম, ১২-দলীয় জোট, এলডিপিও সমাবেশ করার ঘোষণা দেয়। এর তিন দিন পর আজ আওয়ামী লীগের ৩ সংগঠনের ‘শান্তি সমাবেশে’র ঘোষণা এলো, যেটি ২৪ জুলাই হওয়ার কথা থাকলেও পিছিয়ে ২৭ জুলাই নেওয়া হলো।
বিএনপির সমাবেশের পাল্টা সমাবেশ করছেন কি না—এমন প্রশ্নে যুবলীগের সাধারণ সম্পাদক মাইনুল হোসেন খান নিখিল বলেন, ‘বাংলাদেশ একটি গণতান্ত্রিক দেশ। রাজনৈতিক দল হিসেবে সহাবস্থানে থেকে শান্তিপূর্ণ কর্মসূচি করব।’
মাইনুল হোসেন খান নিখিল বলেন, ‘যে গোষ্ঠী বাংলাদেশের বিরুদ্ধে, বাংলাদেশের অগ্রগতির বিরুদ্ধে, বিশেষ করে বঙ্গবন্ধু কন্যার বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র করে যাচ্ছে- সেই গোষ্ঠী হলো বিএনপি-জামায়াত। তারা একটি দেশবিরোধী শক্তি। সেই বিএনপি-জামায়াতের হত্যা-ষড়যন্ত্র, নৈরাজ্যের প্রতিবাদে আওয়ামী যুবলীগ, আওয়ামী স্বেচ্ছাসেবক লীগ ও ছাত্রলীগের উদ্যোগে আগামী ২৭ জুলাই জাতীয় মসজিদ বায়তুল মোকাররমের দক্ষিণ গেটে শান্তি সমাবেশ অনুষ্ঠিত হবে।’
পাল্টা সমাবেশের কর্মসূচি আওয়ামী লীগের রাজনৈতিক দৈন্যতা বলছেন বিএনপির ভাইস চেয়ারম্যান শামসুজ্জামান দুদু। তিনি প্রিয়.কমকে বলেন, ‘আওয়ামী লীগের আসলে দেশকে আর কিছু দেওয়ার নাই। যখনই বিএনপি এবং আন্দোলনমুখী দলগুলো কোনো কর্মসূচি ঘোষণা করছে, তার ২৪ ঘণ্টার মধ্যেই আওয়ামী লীগ বা তাদের অঙ্গ সংগঠন পাল্টা কর্মসূচি ঘোষণা করেছে। আসলে আওয়ামী লীগ রাজনৈতিকভাবে দেওলিয়া হয়ে গেছে। তাদের নিজস্ব কোনো কর্মসূচি নেই।’
তিনি বলেন, ‘গণতন্ত্র পুনঃপ্রতিষ্ঠার জন্য ও ভোটাধিকার প্রতিষ্ঠার জন্য আন্দোলন করছে বিএনপি এবং সমমনা ৩৬টি দল। তার প্রেক্ষিতে আওয়ামী লীগ পায়ে পা বাড়িয়ে ঝগড়া বাঁধানোর পরিকল্পনায় রয়েছে।’
আওয়ামী লীগের কর্মসূচিকে স্বাভাবিক মনে করেন না শামসুজ্জামান দুদু। ছাত্রদলের সাবেক এই সভাপতি বলেন, ‘আমরা যে শান্তিপূর্ণ আন্দোলন করছি, তাতে তারা উসকানি দেওয়ার চেষ্টা করছে। তারা এক দিন আগে বা পরেও সমাবেশ করতে পারত। আমরা ২০ লাখ মানুষ নিয়ে করলে তারা ২০ কোটি নিয়ে সমাবেশ করুক। কিন্তু তা নয়, তারা আসলে আমাদের বাধাগ্রস্ত করতেই এসব করছে।’
‘মোড়ে মোড়ে পুলিশ বসিয়ে, মোবাইল চেক করে নিম্নশ্রেণির কাজ করছে। আওয়ামী লীগের মতো একটা দল এভাবে শেষ হয়ে যাবে চিন্তার ক্ষেত্রে, কর্মসূচির ক্ষেত্রে, সেটা ভাবা যায় না।’ মন্তব্য করেন তিনি।
আওয়ামী লীগ সংঘাতের পাঁয়তারা করছে—মির্জা ফখরুল ইসলামের অভিযোগের বিষয়ে আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক সম্পাদক এস এম কামাল হোসেন প্রিয়.কমকে বলেন, ‘আওয়ামী লীগ শান্তিপ্রিয় দল। দেশে পদযাত্রার নামে বিএনপিই সন্ত্রাস করছে। মির্জা ফখরুল মিথ্যাচার করছেন, অপপ্রচার করছেন।’
তিনি বলেন, ‘চট্টগ্রামে তারুণ্যের সমাবেশের নামে বঙ্গবন্ধুর ম্যুরাল ভাঙচুর করেছে। সেখানে তো কেউ তাদের বাধা দেয়নি। বঙ্গবন্ধুর ম্যুরাল ভাঙচুর করলে মানুষ প্রতিবাদ জানিয়েছে। পদযাত্রার নামে চট্টগ্রামের আওয়ামী লীগের প্রার্থী মহিউদ্দিনের নির্বাচনী কার্যালয়ে হামলা চালিয়েছে। বগুড়ায় যে পথে পদযাত্রা করার কথা ছিল, সেই পথে যায়নি। একটা বালিকা বিদ্যালয়ের শতাধিক ছাত্রী আহত হয়েছে, ১০ জন পুলিশ আহত হয়েছে। কাজেই সন্ত্রাস তো তারা করছে।’
একই দিন সমাবেশ হলে সংঘাতের আশঙ্কা থাকে কি না—এমন প্রশ্নের উত্তরে এস এম কামাল হোসেন বলেন, ‘১২ জুলাই বিএনপি পল্টনে সমাবেশ করেছে, আমরা (আওয়ামী লীগ) বায়তুল মোকাররমের দক্ষিণ গেটে সমাবেশ করেছি। কই সেদিন তো ঢাকা শহরে কোথাও কোনো সংঘাত হয়নি।’
আওয়ামী লীগ বা তাদের অঙ্গ সংগঠন আলাদা দিনে সমাবেশ করতে পারত কি না—জানতে চাইলে কামাল হোসেন বলেন, ‘অন্যদিন কেন সমাবেশ করব? ওদের (বিএনপি) নৈরাজ্য ঠেকাতেই তো আমরা সমাবেশ করছি। এই দেশে কাউকে আর সন্ত্রাসী কার্যক্রম করতে দেওয়া হবে না।’
বিএনপিকে প্রতিটি মুহূর্ত চ্যালেঞ্জের মুখে রাখতেই পাল্টা কর্মসূচি দিচ্ছে বলে মনে করছেন ড. সাব্বির আহমেদ। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগের এই অধ্যাপক প্রিয়.কমকে বলেন, ‘সম্ভবত বিএনপিকে প্রতিটি মুহূর্তই চাপের মুখে রাখতে চায় আওয়ামী লীগ। দলটিকে দুর্বল করতে চায়। কিন্তু এটা খুব একটা বাস্তবসম্মত চিন্তা নয়, এতে মনে হয় না, বিএনপি দুর্বল হবে। দলটি তার আগের অবস্থানেই থাকবে।’
ক্ষমতাসীন দল হিসেবে আওয়ামী লীগ আলাদা দিনে সমাবেশ ডেকে দায়িত্বশীলতার পরিচয় দিতে পারত বলে মনে করছেন ড. সাব্বির আহমেদ।
পাঠকের মন্তব্য(০)
মন্তব্য করতে লগইন করুন