দীর্ঘদিন থেকেই দেখছি—বিশেষজ্ঞ ও গবেষকরা বলছেন, ডেঙ্গু মোকাবিলায় জনগণকে সম্পৃক্ত করে উদ্যোগ গ্রহণ করতে হবে। এলাকাভিত্তিক কার্যক্রম গ্রহণ করতে হবে। শুধু ডেঙ্গুর মৌসুমেই তোড়জোড় নয়, সারা বছরই সচেতনতামূলক কার্যক্রম চালাতে হবে। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থারও একই ধরনের নির্দেশনা রয়েছে। কিন্তু সিটি করপোরেশন বা স্থানীয় মন্ত্রণালয় কিংবা স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় বিশেষজ্ঞদের এসব কথা কেন কানে তুলছে না? যেন কানে তুলো ভরে নিজেদের স্বপ্ন পূরণের কাজে ব্যস্ত সংশ্লিষ্ট দপ্তরের কর্তাব্যক্তিরা।
এরই মধ্যে রাজধানীর সব হাসপাতালের ডেঙ্গু ইউনিট রোগীতে ভর্তি। শয্যা না থাকায় মেঝেতে, বারান্দায়, সিঁড়ির পাশে—সব জায়গায় ডেঙ্গু রোগী। এত এত রোগী যে চিকিৎসকরাও হিমশিম খাচ্ছেন।
এই যে এত মৃত্যু, এত আক্রান্ত, মানুষের মাঝে ভয়-আতঙ্ক, তাতে কার-ই বা কি আসে যায়! সাধারণ মানুষকে নিয়ে ভাবার সময় কোথায়? এখন তো আর ভোটের প্রয়োজন হয় না! আবার বিরক্ত হয়ে জনগণ ভোট বর্জন করলেও কিছু যায় আসে না! আর সামনে কি হয় তাই দেখায় যেন মগ্ন দায়িত্বশীল ব্যক্তিরা। কেননা প্রধান দুই দলের খেলা শুরু হয়েছে। এখন সময় কেবল ক্ষমতার পালাবদল দেখার! ক্ষমতা থাকছে? নাকি যাচ্ছে? কি হতে যাচ্ছে?
দুই বছর আগে ডেঙ্গু মোকাবিলায় যে ধরনের হইচই দেখা গিয়েছিল, এবার তা-ও দেখা যাচ্ছে না। এরই মধ্যে দক্ষিণ পাশের মেয়র বিদেশ ভ্রমণে গেছেন। অনেক দুষ্টু প্রশ্ন তুলেছেন, ডেঙ্গু থেকে বাঁচতেই এমন মুহূর্তে দেশ ছেড়েছেন তিনি। প্রশ্নটা মনে ধরেছে, না হলে যখন ডেঙ্গুকে পঙ্গু করায় ব্যস্ত থাকার কথা, তখন কেন বিদেশে ঘুরতে গেছেন! উত্তরের মেয়রকে দুই বছর আগে যতটা সক্রিয় দেখা গেছে, এবার তা দেখা যাচ্ছে না। হয়তো হয়রান হয়ে গেছেন।
করোনার সময় মন্ত্রী, সরকারি আমলা ও কর্তাব্যক্তিরা দাবি করেছিলেন, হঠাৎ করে উড়ে এসে জুড়ে বসেছে, তাই কিছু করতে পারছি না। সারা পৃথিবীই কুপোকাত। ওই সময় বাংলাদেশের অর্থনীতির ফাঁকা বুলি ও স্বাস্থ্যব্যবস্থাকে উলঙ্গ করে দিয়েছিল কোভিড-১৯। কিন্তু ডেঙ্গু তো বছর বছর আসছে। গত বছর থেকে ১২ মাসই ডেঙ্গুর দেখা মিলছে। অতিথির মতো হঠাৎ আসেনি। ডেঙ্গুতে তো সারা পৃথিবী কুপোকাত নয়, তাহলে আমরা কেন কুপোকাত? তা-ও আবার ইচ্ছেকৃতভাবে! কারণ ডেঙ্গুর বাহক এডিস মশার বংশবিস্তার রোধে কর্তৃপক্ষের ভূমিকা সন্দেহজনক। কার্যকর উদ্যোগ নেই, কেবল মৌসুম এলে জরিমানা করা হয়।
চলতি বছর ডেঙ্গুতে আক্রান্তের সংখ্যা ও মৃতের সংখ্যা অতীতের রেকর্ড ছাড়িয়েছে। কিন্তু এ নিয়ে সিটি করপোরেশন, স্থানীয় মন্ত্রণালয় বা স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের তেমন কোনো উদ্বেগ নেই। সাধারণ মানুষের মৃত্যুতে কার-ই বা কি যায় আসে। অবশ্য পকেট কাটতে কিন্তু সমস্যা হয় না। পকেট কেটে দায়িত্বপ্রাপ্তদের বেতন বৃদ্ধি বা প্রণোদনার ব্যবস্থাও রয়েছে। আর উন্নয়নের নানান কাজের ভাগ-বাটোয়ারার কথা বলার প্রয়োজন নেই। ওসব করেই কূল পাওয়া যায় না। গবেষক, চিকিৎসকদের কথা শোনার সময় কই?
অবশ্য সুস্থভাবে বেঁচে থাকার আশা করা বোকামি। আপনি নিজে যত সচেতন থাকেন, ডেঙ্গুর হাত থেকে মুক্তি পাওয়া প্রায় অসম্ভব। কারণ আপনি সচেতন, কিন্তু আপনার প্রতিবেশী তো সচেতন না। ঘরের ভেতর, নির্মাণাধীন ভবনে, থানার ডাম্পিং স্টেশনে, বাড়ির ছাদে মশার বংশবৃদ্ধির নিরাপদ আস্তানাগুলোকে গুড়িয়ে দেওয়ার দায়িত্ব যার যার, তার তার? কিন্তু ‘আমরা ডেঙ্গুর চেয়েও শক্তিশালী’ এমনটা মনে করা মানুষ যদি নিজে সচেতন না হয়, সেজন্য করণীয় কী? তাদের বাধ্য করার দায়িত্ব কার? আর মশা জন্ম নেওয়ার পর শুধু প্রতিবেশীর বাড়িতেই অবস্থান করবে না। যদি প্রেমিক বা প্রেমিকার অনশনের মতো ওই বাড়িতেই অবস্থান করত, তাহলে হয়তো বা কাজে দিত। কিন্তু মশার প্রেমও লুটেরাদের মতো সর্বত্র! জন্ম হোক যথাতথা, কর্ম সর্বময়! হয়তো বা নিজেদের সঙ্গে মিল রয়েছে বলেই মশার বংশকে ধ্বংস করার পরিকল্পনা নেই! ফলে মশার বংশবৃদ্ধি প্রতিরোধে প্রতিটি পাড়া-মহল্লার লোকজনকে সম্পৃক্ত করার মতো জরুরি বিষয়ে কে মাথা ঘামাবে। ধুর!
ঢাকায় তবু সিটি করপোরেশনের শো-অফ চোখে পড়ে! কিন্তু এই বিষয়ে ঢাকার বাইরে ভয়াবহ অবস্থা। ঈদে বাড়ি গিয়ে দেখেছি, পৌরসভার যে ড্রেন রয়েছে, সেটা সম্ভবত কোনোদিন পরিষ্কার করা হয় না। সেখান থেকে গন্ধ ছড়াচ্ছে, কোথাও কোথাও ড্রেন থেকে ময়লা পানি সড়কে উপচে পড়ছে। ড্রেনের আশপাশে কোথাও ৩০ সেকেন্ড চুপ করে দাঁড়িয়ে থাকা যায় না, কারণ শত শত মশা হাজির হুল ফোটানোর জন্য। সেখানে কখনও মশা মারার জন্য কিছু করা হয়েছে বলে কেউ জানাতে পারেনি।
আবার ঢাকায় মশা মারতে সিটি করপোরেশনকে কামান ব্যবহার করতেও দেখা যায়! ধোঁয়া উড়িয়ে ভো-ভো মেশিন চালানো থেকে শুরু করে আকাশে ড্রোনও উড়িয়েছে। কিন্তু কাজের কাজ কিছু হচ্ছে না। হওয়ার মতো কাজ আসলে করা হয় না। মাঝে মাঝে লোকদেখানো জরিমানা করা হয়। তারপর ফটোসেশন হয়, গণমাধ্যমে জরিমানার খবর প্রকাশ হয়। কেবল আমলে নেওয়া হয় না বিশেষজ্ঞদের কোনো পরামর্শকে!
হয়তো সিটি করপোরেশন বা স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয়ের কর্তাব্যক্তি বসে আছেন টেলিফোনের পাশে! কখন প্রধানমন্ত্রী ফোন দিবেন বা ডেকে পাঠাবেন, তারপর তারা কার্যকর উদ্যোগ নিবেন। আমার ধারণা, প্রধানমন্ত্রী যদি ফোন দেন বা ডেকে পাঠান কিংবা প্রকাশ্যে হুকুমজারি করেন, সে হুকুম বাস্তবায়ন না করার সাহস কার-ই বা আছে। তখন কর্তাব্যক্তিরা নিশ্চিত মাঠে নামবেন সর্বশক্তি প্রয়োগ করে। এবং মশার বংশবৃদ্ধিও হয়তো নিয়ন্ত্রণে চলে আসবে। কিন্তু ফোন কি আসবে? ডেঙ্গু নিয়ন্ত্রণে আনতে মানুষের প্রাণ বাঁচাতে প্রধানমন্ত্রী কি নির্দেশনা দেবেন?
সরকারের কার্যকর উদ্যোগে ৬০০ টাকার কাঁচা মরিচ এখন ১০০ টাকা—কয়েক দিন আগে এমন প্রচারণায় নেমেছিলেন আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীরা। এমন প্রচারণার মতো দেখার ইচ্ছে জাগে, সরকার বা আওয়ামী লীগ কিংবা প্রধানমন্ত্রীর উদ্যোগের কারণে মশার বংশ ধ্বংস হয়েছে।
পাহাড় সমান উন্নয়নের মাঝে সামান্য মশার কাছে হার মানছে সরকার। তা-ও আবার টানা প্রায় ১৫ বছর ক্ষমতায়, তবুও এক পুঁচকে মশাকে নিয়ন্ত্রণে আনতে পারছে না! উন্নয়নের পাহাড়ের ভাঁজে ভাঁজে যেন মশারা তৈরি করে নিয়ে অভয়ারণ্য! দুর্গম পাহাড় বা সুন্দরবনের ভয়াল দস্যুদের নিয়ন্ত্রণে আনতে পারলেও মশাদের অভয়ারণ্যে ঢুকতে পারেনি সরকার! ফলে আরও শক্তিশালী হয়ে উঠছে মশাবাহিনী! মশার কাছে সরকারের এ পরাজয় মেনে নিতে কষ্ট হয়। যে কষ্ট মেনে নেওয়া যায় না। যদিও মেনে নেওয়া ছাড়া উপায় নেই।
[সম্পাদকীয় নীতিমালার সঙ্গে লেখকের মতামতের মিল না-ও থাকতে পারে। প্রকাশিত মতামতের দায়ভার লেখকের।]
পাঠকের মন্তব্য(০)
মন্তব্য করতে লগইন করুন