কর্মমুখী মানুষের চাপে ফেরিতে তিল ধারণের ঠাঁই নেই। কারখানায় কাজে যোগ দিতে ঢাকার পথে তারা। শনিবার রাজবাড়ীর দৌলতদিয়া ঘাট থেকে তোলা। ছবি: স্টার মেইল

ভয়াবহ পরিস্থিতির দিকে যাচ্ছে বাংলাদেশ?

করোনার সংক্রমণ রোধে চলমান বিধিনিষেধের মধ্যে হঠাৎ করে শিল্প-কারখানা খোলার সিদ্ধান্ত অব্যবস্থাপনা ও পরিকল্পনাহীনতার উদাহরণ বলে মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা। আর গণপরিবহন বন্ধ থাকায় কারখানার কর্মীরা যেভাবে ঢাকায় ফিরছেন, তাতে করোনার সংক্রমণকে আরও মারাত্মক পরিস্থিতির দিকে যাওয়ার সুযোগ তৈরি করে দেওয়া হয়েছে।

তানজিল রিমন
জ্যেষ্ঠ প্রতিবেদক
প্রকাশিত: ৩১ জুলাই ২০২১, ২৩:৩৮ আপডেট: ০১ আগস্ট ২০২১, ১২:৩৯
প্রকাশিত: ৩১ জুলাই ২০২১, ২৩:৩৮ আপডেট: ০১ আগস্ট ২০২১, ১২:৩৯


কর্মমুখী মানুষের চাপে ফেরিতে তিল ধারণের ঠাঁই নেই। কারখানায় কাজে যোগ দিতে ঢাকার পথে তারা। শনিবার রাজবাড়ীর দৌলতদিয়া ঘাট থেকে তোলা। ছবি: স্টার মেইল

দেশে মহামারী করোনা সংক্রমণ এখন বিপজ্জনক পর্যায়ে। কোভিড-১৯ ভাইরাসের সংক্রমণ নিয়ন্ত্রণে চলছে ‘কঠোর’ বিধিনিষেধ। জরুরি সেবা ছাড়া সবধরনের অফিস-আদালত, শিল্প-কারখানা বন্ধ রয়েছে। এরই মধ্যে হঠাৎ করে শিল্প-কারখানা খোলার সিদ্ধান্তে ঢাকার বাইরে থাকা শ্রমিক-কর্মচারীরা গণপরিবহন বন্ধ থাকা সত্ত্বেও চাকরি বাঁচাতে ফিরতে বাধ্য হচ্ছেন। এক্ষেত্রে স্বাস্থ্যবিধি মানার সুযোগ থাকছে না। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এর মধ্য দিয়ে করোনা মহামারীর ভয়াবহ পরিস্থিতির দিকে যাচ্ছে বাংলাদেশ। এতে স্বাস্থ্যব্যবস্থা ভেঙে পড়বে। পরিস্থিতি সামাল দেওয়া সম্ভব হবে না।

৩১ জুলাই শনিবার ঢাকার প্রবেশমুখ গাবতলী, মহাখালী, যাত্রাবাড়ী এবং মুন্সিগঞ্জের মাওয়া-শিমুলিয়া ঘাটে দেখা গেছে, হাজার হাজার মানুষ ঢাকায় ফিরছেন। গণপরিবহনের চলাচল না থাকায় তাদের ভেঙে ভেঙে বিভিন্ন গাড়ির সহায়তায় ফিরতে হচ্ছে। ট্রাক, মাইক্রোবাস, প্রাইভেটকার, পিকআপ ভ্যান, রিকশাভ্যান, রিকশা ও সিএনজিচালিত অটোরিকশার পাশাপাশি হেঁটে তারা ঢাকায় ফিরছেন। এতে স্বাস্থ্যবিধি মানা হচ্ছে না। ফলে সহজেই করোনা সংক্রমিত ব্যক্তির কাছ থেকে ভাইরাস ছড়িয়ে পড়ছে অন্যদের মাঝে।

করোনার সংক্রমণ রোধে গত ২৩ জুলাই থেকে ‘কঠোর’ বিধিনিষেধ চলছে, যা ৫ আগস্ট পর্যন্ত চলবে। এই সময়ে সরকারি-বেসরকারি অফিস, তৈরি পোশাক কারখানাসহ সব ধরনের শিল্প-কারখানা বন্ধ থাকার কথা ছিল। কিন্তু ব্যবসায়ীদের অনুরোধের পর ৩০ জুলাই মন্ত্রিপরিষদ বিভাগের এক প্রজ্ঞাপনে জানানো হয়, ১ আগস্ট সকাল ৬টা থেকে রপ্তানিমুখী সকল শিল্প ও কল-কারখানা আরোপিত বিধি-নিষেধের আওতা বহির্ভূত থাকবে।

অভিযোগ রয়েছে, ঈদে ঢাকার বাইরে যাওয়া কর্মীদের ফোন করে আসতে বলেছে বিভিন্ন কারখানা কর্তৃপক্ষ। যেকোনোভাবে কারখানায় আসতে হবে, না আসতে পারলে চাকরি থাকবে না বলেও হুমকি দেওয়া হয়েছে। আর এই পরিস্থিতিতে চাকরি বাঁচাতে গণপরিবহন বন্ধ থাকা সত্ত্বেও করোনার ঝুঁকি নিয়ে ঢাকা আসতে হচ্ছে তাদের। তবে শনিবার সন্ধ্যায় পোশাক প্রস্তুত ও রপ্তানিকারকদের সংগঠন বিজিএমইএ বিবৃতিতে জানিয়েছে, বিধিনিষেধ পুরোপুরি প্রত্যাহার না হওয়া পর্যন্ত গ্রামে অবস্থানরত কোনো পোশাকশ্রমিক-কর্মচারী কারখানায় কাজে যোগদান করতে না পারলে তার বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা নেওয়া হবে না। 

এ ছাড়া ঢাকার বাইরের শ্রমিকদের পোশাক কারখানায় যোগ দেওয়ার কোনো বাধ্যবাধকতা নেই বলে জানিয়েছেন জনপ্রশাসন প্রতিমন্ত্রী ফরহাদ হোসেনও। এক্ষেত্রে শ্রমিকদের চাকরি চলে যাওয়া নিয়ে কোনো চিন্তা করতেও মানা করেন তিনি। 

অন্যদিকে সন্ধ্যায় প্রথমে বাংলাদেশ অভ্যন্তরীণ নৌপরিবহন কর্তৃপক্ষের (বিআইডব্লিউটিএ) পক্ষ থেকে জানানো হয়, শ্রমিকদের যাতায়াতের কথা বিবেচনা করে আগামীকাল ১ আগস্ট রোববার বেলা ১২টা পর্যন্ত যাত্রীবাহী লঞ্চ চলাচলের সিদ্ধান্ত হয়েছে। পরে রাত সাড়ে ৮টার দিকে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী জানান, পরিস্থিতি বিবেচনায় শনিবার রাত থেকে রোববার পর্যন্ত সারা দেশ থেকে শ্রমিকদের ঢাকা নিয়ে আসার জন্য বাস চলাচলের অনুমতি দেওয়া হয়েছে।

এদিকে বিধিনিষেধের মধ্যে শিল্প-কারখানা খোলার বিষয়ে স্বাস্থ্য অধিপ্তরের আপত্তি ছিল। বরং চলমান বিধিনিষেধ বাড়ানো যায় কি না, সেটা ভাবছিল। স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের মুখপাত্র অধ্যাপক ডা. রোবেদ আমিন প্রিয়.কমকে বলেন, “স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় বা স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের রিকমেন্ডেশন কখনোই ছিল না শিল্প-কারখানা খোলার ব্যাপারে। উল্টা বিধিনিষেধ আরও বাড়ানো যায় কি না, সেটা ভাবা হচ্ছে।”

ঊর্ধ্বমুখী করোনা সংক্রমণ এমনিতেই ঝুঁকিপূর্ণ অবস্থায় রয়েছে জানিয়ে তিনি বলেন, “এখন যদি শিল্প-কারখানা খুলে দেওয়া হয়, সব মানুষ যদি একসঙ্গে (যারা বাড়িতে ছিল তারা) আসা শুরু করে, তাহলে পরিস্থিতি ভয়াবহ হবে। সেটা চিন্তারও বাইরে।”

যেভাবে মানুষ ঢাকায় আসছে, এতে সংক্রমণ ও মৃত্যুর ঝুঁকি ভয়াবহ রকম বাড়বে বলে মনে করছেন ইনস্টিটিউট অব এপিডেমিওলজি, ডিজিজ কন্ট্রোল অ্যান্ড রিসার্চের (আইইডিসিআর) উপদেষ্টা অধ্যাপক ডা. মুশতাক হোসেন। তিনি প্রিয়.কমকে বলেন, “সংক্রমণ ও মৃত্যুর সংখ্যায় বাংলাদেশ এখনই বিপজ্জনক পর্যায়ে রয়েছে। এটা নিয়ন্ত্রণ না করা গেলে ভয়াবহ পরিস্থিতিতে পড়তে হবে।”

চলমান বিধিনিষেধে শিল্প-কারখানা খোলার সিদ্ধান্ত নেওয়া ঠিক হয়নি জানিয়ে তিনি বলেন, “বিধিনিষেধের পরিধি আরও বাড়াতে হবে। এক্ষেত্রে অনেকেরই অসুবিধা হচ্ছে, ঘরে খাবার নেই, তাদের সহায়তা দিয়ে হলেও বিধিনিষেধ চালু রাখতে হবে। না-হলে আমরা আর সামাল দিতে পারব না। সামাল দেওয়ার সক্ষমতা নেই। যে উদ্দেশ্যে বিধিনিষেধ তুলে নেওয়া হবে, সেটাও ব্যর্থ হবে।”

করোনা সংক্রমণ রোধে শুরু থেকেই ব্যবস্থাপনা ও পরিকল্পনার ঘাটতি ছিল এবং এখনো রয়েছে বলে মনে করেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বিএসএমএমইউ) সাবেক উপাচার্য অধ্যাপক ডা. মো. নজরুল ইসলাম। তিনি প্রিয়.কমকে বলেন, “এসব হলো মিস ম্যানেজমেন্টের উদাহরণ। ম্যানেজমেন্টের ঘাটতির কারণেই দেশে করোনার ঝুঁকি বেড়ে গেছে। আগে থেকে যদি প্ল্যান করে মানুষকে জানিয়ে সিদ্ধান্ত নিত, তাহলে এই পরিস্থিতি হতো না। ওরা (কারখানার কর্মী) তো কমপ্লেইন করছে, না যেতে পারলে চাকরি চলে যাবে। এই যে চাকরি যাওয়ার ভয়, এটা তো এমনি এমনি হয় না। ফলে তারা এখন গাদাগাদি করে ট্রাকের ভেতরে অনেক লোক একসঙ্গে আসছে, এতে ভাইরাস ট্রান্সমিশনের ঝুঁকি অনেক বেশি।”

স্বাস্থ্য অধিদপ্তর জানিয়েছে, শেষ ২৪ ঘণ্টায় (শুক্রবার সকাল ৮টা থেকে আজ শনিবার সকাল ৮টা পর্যন্ত ) করোনায় সংক্রমিত হয়ে ২১৮ জনের মৃত্যু হয়েছে। আর নতুন রোগী শনাক্ত হয়েছে ৯ হাজার ৩৬৯ জন। এই সময় মোট ৩০ হাজার ৯৮০ জনের নমুনা পরীক্ষা করা হয়। রোগী শনাক্তের হার ৩০ দশমিক ২৪ শতাংশ। এ নিয়ে করোনা সংক্রমিত শনাক্ত রোগীর সংখ্যা দাঁড়িয়েছে ১২ লাখ ৪৯ হাজার ৪৮৪ জনে এবং মৃত্যু হয়েছে ২০ হাজার ৬৮৫ জনের।

অধ্যাপক ডা. মো. নজরুল ইসলাম, অধ্যাপক ডা. মুশতাক হোসেন ও অধ্যাপক ডা. রোবেদ আমিন

অধ্যাপক ডা. মো. নজরুল ইসলাম (বাঁ থেকে), অধ্যাপক ডা. মুশতাক হোসেন ও অধ্যাপক ডা. রোবেদ আমিন

রোগী শনাক্তের হার এখন ৩০ শতাংশেরও বেশি। প্রতিদিন খবর পাওয়া যাচ্ছে, করোনা রোগী নিয়ে হাসপাতাল থেকে হাসপাতালে গিয়ে শয্যা পাচ্ছেন না স্বজনরা। জেলাগুলো থেকে রোগী নিয়ে ঢাকায় আসলেও হাসপাতালে ঠাঁই হচ্ছে না। এই অবস্থায় লকডাউন শিথিল করলে স্বাস্থ্যব্যবস্থা ভেঙে পড়ার আশঙ্কা রয়েছে বলে জানান স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা।

ডা. রোবেদ আমিন বলেন, “এমনিতে আমাদের হাসপাতালগুলোতে জায়গা-ই নাই, এখন নতুন করে যদি সংক্রমণ বৃদ্ধি পায়, তাহলে রাস্তাঘাট থেকে মানুষ হাসপাতালে ঢুকতেও পারবে না।”

স্বাস্থ্য অধিদপ্তর, করোনাভাইরাস সংক্রান্ত জাতীয় কারিগরি পরামর্শক কমিটি ও বিশেষজ্ঞরা বিধিনিষেধ বাড়ানোর কথা বললেও শনিবার জনপ্রশাসন প্রতিমন্ত্রী ফরহাদ হোসেন আভাস দিয়েছেন, ৫ আগস্টের পর চলমান বিধিনিষেধ শিথিল হতে পারে।

বিধিনিষেধের কোনো বিকল্প নেই বলে মনে করছেন আইইডিসিআর-এর সাবেক প্রধান বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা ড. মুশতাক হোসেন। তিনি প্রিয়.কমকে বলেন, “বিধিনিষেধ কার্যকর রাখতেই হবে। এখন বিধিনিষেধ কার্যকর রাখতে গিয়ে যারা ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন, তাদের পাশে দাঁড়াতে হবে। সরকারিভাবে ও সামাজিকভাবে—দুই ভাবেই তাদের পাশে দাঁড়াতে হবে। তাদের সহায়তা করতে হবে। যার ঘরে খাবার নেই, তার কাছে খাবার পৌঁছে দিতে হবে। না হলে মানুষ যখন এক জায়গা থেকে আরেক জায়গায় যায় তখন সংক্রমণ বাড়বেই। চলাচলের সময় পথের মধ্যে ভাইরাস মিক্সিং হয়, এতে নিজেরাও সংক্রমিত হয়, তাদের কাছ থেকে অন্যরাও সংক্রমিত হয়।”

উন্নত দেশে যেভাবে বিধিনিষেধ কার্যকর হয়, বাংলাদেশে সেভাবে হয় না। ফলে বিধিনিষেধ দিয়েও করোনা সংক্রমণ রোধ সম্ভব হয়নি বলে মনে করছেন অধ্যাপক নজরুল ইসলাম। তিনি বলেন, “স্বাস্থ্যবিধি মানার কোনো বিকল্প নেই। বাংলাদেশের আর্থসামাজিক অবস্থার প্রেক্ষাপটে চীন বা ইতালির মতো লকডাউন সম্ভব না। করোনা ঠেকানোর প্রধান কাজ হচ্ছে- শতভাগ মানুষকে মাস্ক পরতে হবে, শারীরিক দূরত্ব রাখতে হবে এবং নিয়মিত হাত ধুতে হবে। এই তিনটি কাজ শতভাগ করতে পারলে লকডাউনের প্রয়োজন নেই।”

কিন্তু বাংলাদেশে এখন পর্যন্ত স্বাস্থ্যবিধি মানার জন্য কোনো কার্যকর পদক্ষেপের উদ্যোগ নেওয়া হয়নি বলে মনে করেন অধ্যাপক নজরুল ইসলাম। করোনাভাইরাস সংক্রান্ত জাতীয় কারিগরি পরামর্শক কমিটির এই সদস্য প্রিয়.কমকে বলেন, “মাঝে মাঝে টেলিভিশনে একটু বিজ্ঞাপন দেওয়া ছাড়া আর কি করা হয়েছে? মানুষকে স্বাস্থ্যবিধি মানানোর কোনো চেষ্টাই করা হয়নি। প্রশাসন, র‌্যাব-পুলিশ, স্বাস্থ্য অধিদপ্তর থেকে কোনো চেষ্টাই নেই। শুধু শুধু মানুষকে দোষ দিয়ে লাভ নেই।”

“বরং যেন স্বাস্থ্যবিধি মানা সম্ভব না হয়, বারবার সেই সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে। আগের ঈদের সময় ছুটি হয়েছে কিন্তু গণপরিবহন বন্ধ ছিল। এবারের ঈদে যে লকডাউন তুলে দেওয়া হয়েছিল, সেটা ভালো একটা কাজ ছিল। সবাই ঠিকমতো স্বাস্থ্যবিধি মেনে বাড়ি যেতে পেরেছে। ট্রাকে দুইশ মানুষ একসঙ্গে না গিয়ে তো বাসে ৪০ জন যাওয়া ভালো’, যোগ করেন এই অধ্যাপক।

রোগীকে নিয়ে হাসপাতাল থেকে হাসপাতালে ঘুরেও মিলছে না শয্যা।

ব্যাপকভাবে করোনা সংক্রমণ ছড়িয়ে পড়লে নতুন করে শক্তিশালী ভ্যারিয়েন্ট সৃষ্টি হয়ে থাকে, যেটা যুক্তরাজ্য, ব্রাজিল, দক্ষিণ আফ্রিকা বা ভারতে দেখা গেছে। বিধিনিষেধের মধ্যে যেভাবে মানুষজন ঢাকায় আসছে, এতে করে বাংলাদেশেও ক্ষতিকর ভ্যারিয়েন্ট তৈরি হতে পারে। ডা. মুশতাক হোসেন বলেন, “যেখানেই সংক্রমণ বেশি ছড়াবে, সেখানেই ভাইরাসটা অদল-বদল হয়ে নতুন ভ্যারিয়েন্টে পরিণত হবে। ভারতে যদি আমরা দেখি, সেখানে প্রথমে মিউটেশন হয়েছে, পরে কুম্ভমেলার মাধ্যমে নতুন ভ্যারিয়েন্ট সৃষ্টি হয়েছে, যেখানে প্রায় কোটিখানেক মানুষ সারা ভারত থেকে আসছিল এবং ছড়িয়ে পড়েছিল। কাজেই বাংলাদেশে যদি এমন হয়, তাহলে আমরা অবাক হবো না। মিউটেশন যে হচ্ছে না, তা নয়, বাংলাদেশেও মিউটেশন হচ্ছে। তবে ক্ষতিকর মিউটেশন যেটা, সেটা হলে খুব অবাক হবো না। কারণ ক্ষতিকর মিউটেশনের জন্য সব ঝুঁকিপূর্ণ পরিস্থিতিই রয়েছে এখানে।”

প্রায় একই কথা বললেন ডা. রোবেদ আমিন। তিনি বলেন, “সংক্রমণ বাড়লে নতুন ভ্যারিয়েন্ট হবে, এটা আমরা দেখেছি বিভিন্ন দেশে। ভ্যারিয়েন্ট আসলে চলছেই, কিন্তু সব ভ্যারিয়েন্ট যে কনসার্ন হয়, তা না। কিছু কিছু ভ্যারিয়েন্ট আছে, যেগুলো শক্তিশালী হয়ে সিরিয়াস প্রবলেম তৈরি করে। কিছু কিছু আরও আরও দুর্বল হয়ে নিষ্ক্রিয় হয়ে পড়ে। এক্ষেত্রে আগে থেকেই কিছু বলা যায় না। সময়ই বলে দেবে।”

এই মুহূর্তে করণীয় কী—এমন প্রশ্নে মহামারী বিশেষজ্ঞ ড. মুশতাক হোসেন বলেন, “যত লোক শনাক্ত হচ্ছে, তাদের সবাইকে ফলো-আপে আনাটা জরুরি। চিকিৎসা দেওয়ার পাশাপাশি করোনা শনাক্ত রোগীদের খোঁজ-খবরে রাখা। সাধারণত যারা শনাক্ত হচ্ছে, তাদের সবাইকে হাসপাতালে যেতে হয় না। খুব কম লোককেই হাসপাতালে যেতে হয়। এখন যারা বাসায় থেকে চিকিৎসা নিচ্ছেন বা আইসোলেশনে থাকছেন, তাদের অবস্থা যেন খারাপ না হয়, সেইদিকে নজর দিকে হবে। কারণ তাদের অবস্থা খারাপ হলে হাসপাতালে চাপ বাড়বে। এজন্য শনাক্ত প্রত্যেকের ফলো-আপ করতে হবে। প্রয়োজনে টেলিমেডিসিনের আওতায় এনে তাদের পরামর্শ দিতে হবে যে, কীভাবে গুরুতর অসুস্থতা থেকে নিজেকে রক্ষা করতে হবে এবং তাদের মাধ্যমে যেন অন্যদের মাঝে না ছড়ায় সেসব বিষয়ে নিয়মিত খোঁজ রাখতে হবে।”

“অনেকেরই আইসোলেশনে থাকার মতো আলাদা ঘর নেই, তাদের আলাদা রাখার জন্য উদ্যোগ নিতে হবে। তাদের জন্য কমিউনিটি আইসোলেশন সেন্টার করতে হবে, আক্রান্তদের সেখানে থাকার ব্যবস্থা করা হবে। তাহলে রোগের সংক্রমণ অনেকটাই কমে যাবে। আর সংক্রমণ কমলে মৃত্যুও কমে যাবে”, বলেন তিনি।

চাকরি হারানোয় ভয়ে করোনার ঝুঁকি নিয়েই ঢাকার পথে অনেকে।

শনাক্ত করার মধ্য দিয়ে কাজ শেষ করলে বিপদ বাড়বে মনে করেন মুশতাক হোসেন। এই চিকিৎসক বলেন, “শনাক্ত করেই যদি আমাদের কাজ শেষ মনে করি, তাহলে কিন্তু কাজের কাজ কিছু হবে না। বরং শনাক্ত ব্যক্তি পরবর্তীতে নিজে অসুস্থ হয়ে হাসপাতালে আসবে এবং অন্যদের মাঝে ছড়াবে, এতে স্বাস্থ্যব্যবস্থা আরও নাজুক হয়ে পড়বে। চিকিৎসার পাশাপাশি স্বাস্থ্য বিভাগের বড় কাজ হলো এটা। চিকিৎসার কেন্দ্রে যদি ভিড় কমাতে হয়, তাহলে রোগীর সংখ্যা কমাতে হবে। ফলে যারা রোগী তাদের ফলোআপ করতে হবে এবং যাদের আলাদা থাকার জায়গা নেই, তাদের জন্য ব্যবস্থা করতে হবে।”

এক্ষেত্রে প্রশাসনের সহায়তা নিতে হবে জানিয়ে মুশতাক হোসেন বলেন, “মেডিকেল ম্যানেজমেন্ট এবং পাবলিক হেলথ ম্যানেজম্যান্ট—দুটোর সমন্বয় করে রোগীদের পাশে থাকতে হবে। আর এটা করতে পারলে অনেকে শনাক্ত হতে এগিয়ে আসবে। খোঁজ নিলে দেখবেন, অনেকেই শনাক্ত করতে যায় না। অর্থাৎ টেস্ট করতে যায় না। কারণ করোনা ধরা পড়লে তাকে সামাজিকভাবে নিগৃহীত হওয়ার ভয় থাকে, সঙ্গে কে খাওয়াবে, কে ওষুধ দিবে, কাজে যেতে না পারলে পয়সা নাই, এসব বিষয় তো আছেই। কাজেই শনাক্ত রোগীদের ব্যবস্থাপনাটা এই মুহূর্তে খুবই গুরুত্বপূর্ণ।”

তবে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের মুখপাত্র ডা. রোবেদ আমিন প্রিয়.কমকে বলেন, “প্রতিদিন হাজার হাজার মানুষ স্বাস্থ্য অধিদপ্তরে ফোন করছে। যারা অসুস্থ হয়ে পড়ছেন, ফোন করছেন, তাদের টেলিমেডিসিন সেবা দেওয়া হচ্ছে অনেক দিন থেকেই। কী করতে হবে, কী করা যাবে না—প্রায় সবই তো মানুষকে বলা হয়েছে। প্রতিদিনই একই কথা বলা হচ্ছে। কিন্তু শুনছে কতজন। এখন মানুষজনকে আসলে সচেতন হতে হবে।”

মানুষের মধ্যে সচেতনতা তৈরির কোনো চেষ্টাই করা হয়নি। অথচ কথায় কথায় মানুষকে দোষ দেওয়া হচ্ছে জানিয়ে অধ্যাপক নজরুল ইসলাম বলেন, “অনেকেই কিন্তু স্বাস্থ্যবিধি মানছে। যারা পারছে না, তারা এর গুরুত্ব সম্পর্কে জানে না। এই জানানোর কাজটা করতে হবে। মন্ত্রণালয়, প্রশাসন, র‌্যাব-পুলিশ, জনপ্রতিনিধি, ভলান্টিয়ার সবাইকেই কাজ করতে হবে। সেই কাজ কী করা হচ্ছে?”

“ব্যক্তি পর্যায়ে মানুষ যেন মাস্ক পরে, হাত ধোয় ও দূরত্ব বজায় রাখে, সেটা নিশ্চিত করতে কাজ করতে হবে। স্বাস্থ্যবিধি মানতে মানুষের দ্বারে দ্বারে পৌঁছাতে হবে। ঢাকা থেকে গ্রাম পর্যন্ত প্রতিটি স্তরে ব্যাপকভাবে কাজ করতে হবে। না হলে লকডাউন দিয়েও কাজ হবে না”, বলেন অধ্যাপক নজরুল ইসলাম।

তিনি বলেন, “পাশাপাশি আক্রান্ত ব্যক্তিদের আইসোলেশনে রাখতে হবে। যেসব পরিবারে আলাদাভাবে রাখা সম্ভব না, সেখানে সামাজিকভাবে কাউকে বা সরকারকে এগিয়ে আসতে হবে। যেকোনোভাবে তাকে আলাদা রাখতে হবে এবং পরিবারের সদস্যদের আইসোলেশনে থাকতে হবে, যেহেতু তারা সংস্পর্শে এসেছিল। প্রয়োজনে সেই পরিবারে ওষুধ, নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্য পৌঁছে দিতে হবে। একটা শৃঙ্খলের মধ্যে আনতে হবে সবকিছু। তাহলেই করোনাকে নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব।”

পাঠকের মন্তব্য(০)

মন্তব্য করতে করুন


আরো পড়ুন

loading ...