ক্লাস নাইনে পড়ার সময় গল্প লেখা প্রতিযোগিতায় ২ হাজার টাকা পুরস্কার পেয়েছিলেন তানভীর। ছবি: শাছুল হক রিপন, প্রিয়.কম

‘কখনো তারকা হতে চাইনি, এ ইন্ডাস্ট্রির শ্রমিক হতে চেয়েছি’

সৃজনশীলতার নানা অঙ্গনে কাজ করেন তানভীর তারেক। তিনি একাধারে গীতিকার, সুরকার, সংগীতপরিচালক, সংগীতশিল্পী, সাংবাদিক ও উপস্থাপক।

তাশফিন ত্রপা
ফিচার লেখক
প্রকাশিত: ২৯ ডিসেম্বর ২০১৮, ১২:২০ আপডেট: ৩১ ডিসেম্বর ২০১৮, ১২:৪০
প্রকাশিত: ২৯ ডিসেম্বর ২০১৮, ১২:২০ আপডেট: ৩১ ডিসেম্বর ২০১৮, ১২:৪০


ক্লাস নাইনে পড়ার সময় গল্প লেখা প্রতিযোগিতায় ২ হাজার টাকা পুরস্কার পেয়েছিলেন তানভীর। ছবি: শাছুল হক রিপন, প্রিয়.কম

(প্রিয়.কম) সৃজনশীলতার নানা অঙ্গনে কাজ করেন তানভীর তারেক। তিনি একাধারে গীতিকার, সুরকার, সংগীতপরিচালক, সংগীতশিল্পী, সাংবাদিক ও উপস্থাপক। ২০১১ সালে ‘সিটিসেল-চ্যানেল আই মিউজিক অ্যাওয়ার্ড’- এর সেরা সংগীতপরিচালকের পুরস্কার পান।

প্রিয়.কমের সঙ্গে আলাপ হয় তানভীরের। সেই আলাপে উঠে আসে দেশের বরেণ্য মানুষের হাত ধরে বেড়ে ওঠা তানভীরের জীবন, বিনোদন ও সাংবাদিকতার নানা জানা ও অজানা কথা।

প্রিয়.কম: কেমন আছেন?

তানভীর: ভালো। আপনি কেমন আছে?

প্রিয়.কম: আমিও ভালো। সাংবাদিকতা ও উপস্থাপনায় মানুষের ইন্টারভিউ নিয়ে থাকেন, আজ আমি আপনার ইন্টারভিউ নিচ্ছি।

তানভীর: হ্যাঁ, এ প্রজন্মের সাংবাদিকরা আসলে বেশ গুছিয়ে কাজ করে। আমাদের সময় এতো গুছানোর বিষয় ছিল না। প্রযুক্তির সঙ্গে সঙ্গে সাংবাদিকতাও অনেক ভার্চুয়াল হয়ে গেছে। এখন যখন দু-চারটা প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়ের গেস্ট শিক্ষক হিসেবে লেকচার দিলে আমি তাদের বলি, ‘আমি কিন্তু তোমাদের মতো এতো সার্টিফিকেট নিয়ে এ পেশায় আসিনি। বাস্তব শিক্ষা আসলে অনেক বড় বিষয়।’

প্রিয়.কম: ইদানিং কি করছেন?

তানভীর: ইদানিং ‘জাগো’ এফএম রেডিও চ্যানেলে ‘রাতআড্ডা উইথ তানভীর’ নামে একটি শো করছি। এটা প্রতি সোমবার রাত ১০ টা থেকে ১২টা পর্যন্ত চলে। ‘এটিএন নিউজ’-এ ‘ইয়াং নাইট লাভ বক্স’ নামে আরেকটি অনুষ্ঠান করছি। এটি রাত ১ টা ২০ মিনিটে লাইভ প্রচার হয়। ‘এশিয়ান টেলিভিশ’ন-এ ‘সেলিব্রিটি লাউঞ্জে’ নামে একটি অনুষ্ঠান করছি। পাশাপাশি ‘ইত্তেফাক’-এ সাংবাদিকতা। কেউ যখন অনুষ্ঠান দেখতে চান। তখন বেশির ভাগই আমার কাছে ইউটিউবের লিঙ্ক চেয়ে থাকেন। যেহেতু সবাই ইউটিউবের লিঙ্কই চাচ্ছেন, তাই আমিও ভাবলাম ইউটিউব নিয়েই কাজ করি। (হাসতে হাসতে) ইউটিউবে দুইটা চ্যানেল খুলেছি। একটাতে ৯০ হাজারের বেশি সাস্ক্রাইবার। এটাতে এখন বেশ মজা পাচ্ছি।

প্রিয়.কম: গান রচনা করেছেন। কখনও কী এমন হয়েছে? যে পাশের মানুষটি আপানার লেখা গানটি গাইছেন। অথচ আপনিই যে সেই গানের গীতিকার তা তিনি জানেন না।

তানভীর: আমার স্ত্রী অনিমা। ও একদিন বাপ্পা দার (বাপ্পা মজুমদার) একটি গান খুব গুনগুন করে গাইছিল। ও জানত না এটা আমার লেখা। যখন বললাম, ‘এটাতো আমার লেখা গান।’ ও অবাক হয়ে বলে, ‘কী বলো। এটা তোমার লেখা!’ ‘জীবনের সব চাওয়া পাওয়া হয় না ‘শিরনামের এ গানটি বাপ্পার দার একটি মিক্স অ্যালবামে বের হয়েছিল। এরকম প্রায় হয়ে থাকে। একবার যুক্তরাষ্ট্রের ফ্লোরিডার এক অনুষ্ঠানে গান গাইতে গিয়েছিলাম। সেদিন কিছু পুরানো গান গাইছিলাম। এমন সময় দর্শক আমার কাছে বাচ্চু ভাইয়ের (আয়ুব বাচ্চু) গাওয়া ‘দুখিনি রাত’ গানটি শুনতে চেয়েছেন। যা কিনা আমারই লেখা গান। তখন মনে হলো আসলেই কিছু জিনিস কখনো মরে না।’

প্রিয়.কম:শুনতে চাই সাংবাদিকতা প্রসঙ্গে।

তানভীর: ইন্টারমিডিয়েট শেষে সঞ্জীব দার সঙ্গে (প্রয়াত সংগীতশিল্পী ও সাংবাদিক সঞ্জীব চৌধুরী) ভোরের কাগজে লেখালেখি শুরু করি। এরপর ‘ভোরের কাগজ’, ‘আনন্দ ভুবন’-এ কাজ করা শেষে সম্ভবত ১৯৯৮ সালের শেষের দিকে বকুল ভাইয়ের (গীতিকার ও সাংবাদিক কবির বকুল) সঙ্গে ‘প্রথম আলো’তে যোগদান করি। এ পর্যন্ত মোট ছয়টি পত্রিকা হাউজে কাজ করেছি। এদের মধ্যে আছে আনন্দ ভুবন, ভোরের কাগজ, দৈনিক যুগান্তর, প্রথম আলো, আমার দেশ ও ইত্তেফাক।

তানভীরের উপস্থাপনা ক্যারিয়ারে আসার ব্যাপারটি ছিল কাকতালীয়।। ছবি: শাছুল হক রিপন, প্রিয়.কম

প্রিয়.কম: এবার জানতে চাইবো উপস্থাপনা প্রসঙ্গে।

তানভীর: তখন ‘আমার দেশ’ পত্রিকার বিনোদন সম্পাদক। সম্ভবত ২০০৬ সালের পর পলিটিক্যাল একটা ধ্বস নামে। পত্রিকাটি থেকে আমারা একটা টিম বের হয়ে আসি। এরপর ওই পত্রিকা অফিসে আগুনও লাগে। চাকরিটা তখন না থাকায়, কী করব ভেবে পাচ্ছিলাম না। ‘ইত্যাদি’র হানিফ সংকেত। আমাদের নিকট আত্মীয়। একদিন বললেন, ‘তুই উপস্থাপনা কর’ বললাম, ‘আমিতো কখনো এ কাজ করি নাই।’ বললেন, ‘শুন, এটিএন বাংলায় বলে দিচ্ছি। টক-শোগুলো করিস। মাসে কিছু হাত খরচ পাবি।’ তখন এটিএন বাংলার ‘টপচার্ট’ নামে একটি অনুষ্ঠানের হোস্ট হলাম। প্রথম দিকে এটিএন বাংলার বেশ কিছু প্রোগ্রামে উপস্থাপনা করতাম। এরপর ‘একুশে টেলিভিশন’-এ ‘মিডিয়া গসিপ’ শিরোনামের একটি অনুষ্ঠান শুরু করলাম। এ অনুষ্ঠানে প্রায় সাড়ে আট বছর উপস্থাপনা করেছি। টিআরপিতে (টেলিভিশন রেটিং পয়েন্ট) সর্বাধিক জনপ্রিয়তা পেয়েছে এটি। নির্মাতা তারেক মাসুদ ভাইয়ের সঙ্গে আবদার সুলোভ সম্পর্ক ছিল আমার। তিনি খুব বেশি টক-শোতে যেতেন না। একদিন ওনাকে আমার ‘মিডিয়া গসিপ’ অনুষ্ঠানে নিয়ে আসি। এটা ছিল একটু চটকদার ধরনের অনুষ্ঠান। তারেক ভাইয়ের মতো মানুষ এমন অনুষ্ঠানে আসবেন তা একুশে টেলিভিশনের অনেকেই ভাবতে পারেননি। একুশে টেলিভিশনে দীর্ঘদিন বেশ কিছু অনুষ্ঠান করেছি। এরপর বেশ কিছুদিন কলকাতার ‘জি-টিভি’ বাংলায় বেশ কিছু কাজ করেছি। উপস্থাপনায় আসার ব্যাপারটি ছিল অনেকটা কাকতালীয়।

প্রিয়.কম: সাংবাদিকতা ও উপস্থাপনা এ দুই পেশার মধ্যে থাকা যেকোনো একটি পার্থক্যের কথা বলেন...

তানভীর: একবার অনেক বছর পর নানা বাড়ি ঈশ্বরদীতে যাই। তখন একুশে টেলিভিশনে উপস্থাপনা করতাম। আমি যেহেতু ওখানকার ছেলে এবং ছেলেবেলায় ওখানে পড়াশুনা করেছি। তাই তখন উপস্থাপক হিসেবে আমাকে ওখানে একটা সংবর্ধনা দেওয়া হয়। তত দিনে আমার সাংবাদিকতারও প্রায় ১২/১৩ বছর পার। কিন্তু সাংবাদিক হিসেবে সংবর্ধনা পাইনি। (হাসতে হাসতে) তখন উপলব্ধি করেছি, পর্দায় চেহারা দেখালে অনেক সুযোগ সুবিধা আর একটু আলাদা খাতির যত্নও পাওয়া যায়।

প্রিয়.কম: লেখালেখি করে জীবনের প্রথম উপার্জন ও অর্জনের মুহূর্তটি নিয়ে জানতে চাই।

তানভীর: তখন ক্লাস নাইনে পড়ি। ‘যায়যায়দিন-এর গল্প লেখা প্রতিযোগিতায় সেরা পুরস্কার হিসেবে ২ হাজার টাকা পাই। যা ছিল লেখালেখি করে প্রথম টাকা পাওয়া। সে দিনের অনুভূতি ভাষায় প্রকাশ করা যাবে না। ছোটবেলায় আমাদের বরিশাল মফস্বলের ভোরের কাগজের পাঠক ফোরাম সংঠনের সভাপতি ছিলাম। সে সময় সেরা সংগঠক হিসেবে পুরস্কারও পাই। মফস্বল থেকে ভোরের কাগজে লেখা পাঠাতাম। তখন ভোরের কাগজের ফিচার সম্পাদক ছিলেন সঞ্জীব দা। সেই সূত্রে ঢাকার প্রেসক্লাব থেকে একদিন সঞ্জীব দা টেলিফোন করে ছিলেন। সেদিন আমার পাঠানো লেখাগুলোর মূল্যায়ন করে অনুপ্রেরণা দেওয়ার জন্যই তিনি ফোন করেছিলেন। তখন দশম শ্রেণিতে পড়তাম। এতো বড় একজন মানুষ আমাকে ফোন করেছেন! এই ভেবে সে রাতেতো আমার আর ঘুমই আসে নাই।

প্রিয়.কম: মফস্বল থেকে ঢাকায় এসে প্রতিষ্ঠিত সাংবাদিক হয়ে ওঠার সংগ্রাম নিয়ে যদি কিছু বলতেন।

তানভীর: ইন্টারমিডিয়েট শেষ, বাবা অসুস্থ হয়ে পড়েন। ঢাকায় আসার সময় পারিবারিক টানাপোড়নের মধ্যে সময় পার করছিলাম। হতাশ হয়ে পড়ি। মফস্বলের ছেলে এ শহরে টিকতে পারব কিনা। বুঝতে পারছিলাম না। এরইমধ্যে ঢাকায় ৬/৭ মাস পার হয়ে গেছে। এক বন্ধুর বাসায় লজিং থাকছিলাম। খুঁজে বেড়াচ্ছিলাম উপার্জনের রাস্তা। কিন্তু কার কাছে যাব? কেই বা সাহায্য করবে? একটা দ্বিধাদ্বন্দ কাজ করছিল। সুযোগ খুঁজে গেলাম সঞ্জীব দার কাছে। ওনাকে সব খুলে বলার পর তিনি বললেন, ‘এতো দিন দেখা করিসনি কেন? টিউশনি কর আর আমার এখানে লেখালেখি কর। লেখালেখির বিল খুব কম পাবি। তবে একটা পরিচিতির গ্রাউন্ড হবে।’ বললাম, ‘আমি গান লিখতে চাই।’ বললেন,’ এখনতো তোর পরিচিতি দাঁড়ায়নি। গান লিখলে তুই পয়সা পাবি না। তোকেতো এখন উপার্জন করতে হবে।’ এরপর ভোরের কাগজে ফ্রি অব কস্ট-এ আমার ‘পড়াতে চাই’ বিজ্ঞাপন ছাপা হল। কিছু টিউশানি পাই। পড়ানো শুরু করলাম আর ভোরের কাগজে লেখালেখি। পাশাপাশি বুয়েটে ভর্তি পরীক্ষার কোচিং করছিলাম। আমার কাজিন ও আত্মীয়দের বেশিরভাগই ইঞ্জিনিয়ার। আমি ছিলাম টেলেন্টপুলে বৃত্তি পাওয়া। পারিবারিক টানাপোড়নের কারণে বুয়েটের ভর্তি পরীক্ষায় ওয়েটিং লিস্টে ঠাঁই হয়। এদিকে আমার তিন কাজিন বুয়েটে টিকে যায়। আমি না টেকাতে মা ভীষণ কষ্ট পায়। তখন সঞ্জিব দা আমাকে বুঝিয়ে বলেন, ‘বুয়েটের ইঞ্জিনিয়ারের কাছে মানুষ আসে স্বার্থে। দেখ আনিসুল হক বুয়েট ছেড়ে এসেছেন সাংবাদিকতায়।’

সংগীতশিল্পী আইয়ুব বাচ্চুর সঙ্গে বাবা-ছেলের মতো সম্পর্ক ছিল তানভীর তারেকের। ছবি: শাছুল হক রিপন, প্রিয়.কম

প্রিয়.কম: যেভাবে সংগীতে ক্যারিয়ার শুরু করলেন?

তানভীর: ভোরের কাগজে বিভিন্ন অ্যাসাইনমেন্ট করতাম। তখন পত্রিকায় নাম ছাপা হওয়াটাই এক অবাক বিষ্ময়। আর প্রচুর লিখতাম। কোনো অ্যাসাইনমেন্ট-ই না করতাম না। কারণ যত লেখা তত পয়সা। টাকাটা খুব প্রয়োজন ছিল। কারণ বাড়ি থেকে বাবার টাকা পাঠানোর কোনো অবস্থা ছিল না। এমন সময় সঞ্জীব দা বাচ্চু ভাইয়ের ( আয়ুব বাচ্চু) সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দেন। সে দিন প্রথম বাচ্চু ভাইয়ের কাছে যাওয়া। যেহেতু সঞ্জীব দা আগেই আমার নাম বলে রেখেছিলেন। তাই বাচ্চু ভাইয়ের কাছে যাওয়ার পর তিনি আমকে দেখে বললেন, ‘ও আচ্ছা সঞ্জীব পাঠিয়েছে।’ আমি তখন বাচ্চু ভাইকে বললাম, ‘আমি গান লিখব।’ বলেন, ‘গান লিখে হবে না। তোরতো সংসার চালাতে হবে। ‘সাউন্ডটেক’-এ যা। ওখানে বাবুল ভাই (অডিও প্রযোজনা প্রতিষ্ঠান সাউন্ডটেকের কর্ণধার সুলতান মাহমুদ বাবুল) আছে। বাবুল ভাইকে বলে দিচ্ছি।’ এরপর ওখানে গিয়ে মিউজিক অ্যারেঞ্জার হিসেবে কাজ সেখা শুরু করি। এরপরতো নিজেই গানের প্রোডিউসার হয়ে গেলাম। গান লেখা শুরু করলাম, সুরকার দিয়ে সুর করা আর কম্পজার দিয়ে কম্পোজ করানো শুরু করলাম। তখনও পর্যন্ত সংগীত পরিচালনার কাজটি আয়ত্তে আসেনি। প্রথম অ্যারেঞ্জমেন্টের অ্যালবামের নাম ‘বন্ধুরে’। এটি ছিল তানভীর তারেকের কথায় ও এস আই টুটুলের সুরে। এটি এস আই টুটুল, বাপ্পা মজুমদার, তন্ময় তানসেন’সহ প্রায় ৮ থেকে ১০ জন শিল্পীর মিক্স অ্যালবাম। এর পর ‘দুঃখিনী রাত’ নমে বড় বাজেটের একটি অ্যালবাম বের করি। এ অ্যালবামে ছিলেন আইয়ুব বাচ্চু, বাপ্পা মজুমদার, এস আই টুটুল ও আসিফ আকবর। এরপর প্রায় ২৩ টা অ্যালবামের কাজ করি। সব কয়টি অ্যালবামের গানের কথা ছিল আমার। শেষের দিকে আবার গানের সুর করাও শুরু করলাম। মিউজিক কম্পোজিশন, গিটার বাজানো ও পিয়ান বাজানো এগুলো হাতে কলমে শিখিয়েছেন আজিজুর রহমান টিংকু। বলতে গেলে আমি তার সহকারী ছিলাম। আমি আরেকজনের সহকারী ছিলাম। তিনি হচ্ছেন আনজাম মাসুদ। একটা সময় বিটিভিতে ‘আজকাল’ নামে তার একটা অনুষ্ঠান প্রচার হত।

প্রিয়.কম: শুনতে চাইব প্রেম, বিয়ে আর সংসার নিয়ে।

তানভীর: বিয়েটা ছিল প্রেমের। আট বছর আগের কথা। শিল্পকলায় রবীন্দ্র সংগীতশিল্পী মিতা হকের আয়োজনে এক অনুষ্ঠানে যাই। ওখানে গিয়ে প্রথম আমার সঙ্গে অণিমার দেখা। আমি অনিমাকে দেখে বললাম, ‘আজ আপনার প্রোগ্রাম আছে? আজ গান গাইবেন কিনা।’ আমাকে কোনো পাত্তাই দিল না। বলল, ‘হ্যাঁ। আছে। গাওয়ার সময় তো দেখবেনই। এতো কথা বলার আর কী আছে।’ আমি যে জার্নালিস্ট, কথা বলাটাই যে আমার কাজ, ও তখন তা জানত না। এরপর আমি তার পেছন পেছন অনুষ্ঠানের গ্রিন রুমে যাই। গ্রিম রুমের সবাইত আমাকে চিনতেন। অনিমা গ্রিম রুমে হঠাৎ আমাকে দেখে অবাক ! দেখেই ও বলে, ‘আপনি এখানে এসেছে?’ বললাম, ‘আমিতো এখানেই থাকি। সামনে বসি না।’ বলল, ‘আপনি কে?,’ এরপর এক কথা দু কথা। ফেসবুকে আরও বিস্তারিত পাঠ দুজনার । আমাদের প্রথম ডেট ছিল টিএসসিতে। খুব অল্প দিনের মধ্যে ‘চ্যানেল আই’ ভবনের ছাদে বসে আমরা বিয়ের সিদ্ধান্ত নিই। ও রাজি। কিন্ত ওর পরিবার রাজি ছিল না বলে ভয় পাচ্ছিল। এরপর আমারা ফরিদুর রেজা সাগর ভাইয়ের সঙ্গে বিষয়টি নিয়ে কথা বলি। চ্যানেল আইয়ের আমীরুল ভাই খুব সাহস দেয়। সাগর ভাই একদিন বললেন, ‘আমি, সুবর্ণা (সুবর্ণা মোস্তাফা), আফজাল (আফজাল হোসেন) সবাই মিলে যাব। দেখি কে মেয়ে দিবে না?’ অবশেষে আমাদের বিয়ে হল। বিয়ের রিসেপশনটি পুরোটা তত্ত্বাবধান করেন আমীরুল ইসলাম। বিয়ের এক সাপ্তাহ পর অণিমা ওদের বাসায় বিষয়টা জানায়। ওর বাবা শুনে ভীষণ ক্ষিপ্ত হয়। এভাবে নানা ট্র্যাজেডি ও অ্যাডভেঞ্চারের মধ্য দিয়ে আমাদের বিয়েটা হয়। এখনতো আমার মা আমার চেয়ে আমার স্ত্রীকে বেশি বিশ্বাস করে। আমাদের ছেলের নাম অমিয় তানভীর। ও কেজি ওয়ানে পড়ে।

প্রিয়.কম: সামনে কোনো নতুন বই বের করছেন কিনা?

তানভীর: তিনটা বইয়ের পরিকল্পনা করেছি। বাচ্চু ভাইয়ের সঙ্গে আমার কিছু স্মৃতি আছে। ৯০ দশকের বেড়ে ওঠার একটা চিত্র তুলে ধরা হবে। যারা ৯০ দশকের রক ব্যান্ড সম্পর্কে জানতে চান তাদের জন্য এটা একটা বড় খোরাক হবে। এতে আমার নেওয়া বাচ্চু ভাইয়ের প্রায় ২৭ টা দীর্ঘ ইন্টারভিউ থাকবে। শেষ দিকে আমারা যারা বাচ্চু ভাইয়ের সহযোদ্ধা ছিলাম তাদেরকে সঙ্গে নিয়ে বইটির মোড়ক উন্মোচন করব। আরেকটা বই বের করব ‘চার বেলা’ নামের। যেখানে থাকবেন চার দিগন্তের চার বিখ্যাত মানুষ। যাদের সঙ্গে খুবই অন্তরঙ্গ সম্পর্ক ছিল আমার। তারা হচ্ছেন তারেক মাসুদ, সংগীতে আবদুল লতিফ স্যার। কবিতায় জয় গোস্বামী ও সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়। আরেকটা বড় গল্পগ্রন্থ বের করব। বইটিরর নাম এখনো ঠিক করিনি। চেষ্টা করছি এ ডিসেম্বর ও জানুয়ারির মধ্যে বইগুলো প্রকাশ করার। বই প্রকাশের শুরুটা খুব বেশি দিনের নয়। গত পাঁচ বছরে মোট আটটি বই বের হয়েছে। আমার লেখা ‘লীলামহল’ নামের একটি উপন্যাস আছে। এটা আমার খুব প্রিয় একটা বই। ‘একলা কোলাহল’ নামে এরেকটি বই আছে। এটাও আমার খুব পছন্দের বই। এটা মুক্তিযুদ্ধের প্রেক্ষাপট নিয়ে লিখেছি।

গিটার শিখতে গিয়ে সংগীতশিল্পী লাকি আখন্দের কাছ থেকে একটি গিটার উপহার পেয়েছিলেন। ছবি: শাছুল হক রিপন, প্রিয়.কম

প্রিয়.কম: প্রায়ত সংগীতশিল্পী লাকি আখন্দের সঙ্গে থাকা আপনার স্মৃতি নিয়ে কিছু বলুন।

তানভীর: ভোরের কাগজে লিখি তখন। ঠিক করলাম গিটার শিখবো। সে সময় বিশ্বসাহিত্য কেদ্রের উল্টা দিকে লাকি আখন্দ স্যার গিটার শেখাতেন। পিচ্চি সাংবাদিক হিসেবে লাকি ভাই আমাকে চিনতেন, খুব আদর করতেন। গিটার শেখার আগ পর্যন্ত ভাই বলতাম। গিটার শেখার পর থেকে আমি ওনাকে স্যার বলেই ডাকি। সে সময় গিটারের স্টুডেন্টদের কাছ থেকে ১২ শ টাকা করে নিতেন। বড় লোকের ছেলে মেয়েরা তার কাছে গিটার শিখত। একদিন বললাম, ‘আমি আপনার কাছে গিটার শিখবো।’ বললেন, ‘চলে আয়।’ কাজিনের একটা গিটার নিয়ে চলে গেলাম ওনার গিটারের ক্লাসে। ভাইয়ের সহকারী বললেন, ‘প্রথম সপ্তাহের পরের সপ্তাহে অগ্রীম টাকা জমা দিতে হবে।’ তখন আমার এতো টাকা পয়সা ছিল না। এত টাকা দিতে পারব না বলে পরের সপ্তাহে আর গেলাম না। পরের সপ্তাহ যাইনি বলে খালার বাসায় ফোন করেন লাকি ভাই। ফোনে জিজ্ঞেস করেন, ‘তুমি আসো নাই কেন?’ বললাম, ‘আমিতো আসলে এতো টাকা দিতে পারব না’। বললেন, ‘কে টাকা চেয়েছে?’ বললাম ‘আপনার সহকারী’। বললেন, ‘আসো। আমি ওকে সামনে নিয়ে বলে দিব, ও যেন আর তোমার কাছে টাকা না চায়।’ পরের সপ্তাহে তিনি আমাকে একটা গিটার দেন। আমার দুর্ভাগ্য সেই গিটারটা হারিয়ে ফেলেছি। এক বন্ধু নাটরে থাকতো। ও আমার কাছ থেকে গিটারটা নিয়ে যায়। হারিয়ে ফেলে। সম্ভবত বেচে দেয়। কারণ ও ড্রাগ এডিক্টেড ছিল। ওকে রিহ্যাবেও রাখা হয়েছিল। শেষ জীবনের শেষ তিন চার দিন আমরা তার বাসায় ছিলাম। সঙ্গে ছিল আমার বন্ধু তানভীর শাহীন। তখন আমেরিকায় থেকে বাংলাদেশে এসেছিল। মারা যাওয়ার দু তিন দিন আগে থেকেই লাকি স্যার বলতেন, ‘তোরা দুজন আজ দুপুরে আমার সাথে ভাত খাবি। আমাকে ডাকলে আমি যেতাম। গেলে আর ছাড়তেন না। নানা কথাই না বলতেন তিনি।

প্রিয়.কম: উপস্থাপনা, সাংবাদিকতা, গান কম্পোজ, সুরা করা গান লেখা পাশাপাশি বইও লিখছেন। এতো কিছুর মাঝে আপনি আসলে কী হতে চেয়ে ছিলেন?

তানভীর: নিজেকে কখনো বাড়িয়ে উপস্থাপন করিনি। কখনো তারকা হতে চাইনি। এ ইন্ডাস্ট্রির মানুষ হতে চেয়েছি। আমি এ ইন্ডাস্ট্রিরই মানুষ। এ ইন্ডাস্ট্রি অনেক কিছু দিয়েছে। বাচ্চু ভাই, তপন দা ( তপন মাহমুদ), বকুল ভাই, লাকি স্যার, সঞ্জীব দা এনারাই আমাকে হাতে কলমে বড় করেছেন। থাকার জায়গা নাই, দুপুরে খাবার নাই। অনারাই সব কিছুতে এগিয়ে এসেছেন। অনেক মানুষের আদর পেয়েছি । শহরের মানুষগুলো আমাকে লালন করেছেন। বাচ্চু ভাই আমার জীবনের কত বড় অংশিদার তা আমি বুঝাতে পারব না। ওনার সঙ্গে সম্পর্কটা ছিল একে বাবা-ছেলের মতো। আমার জীবনে আত্মীয় স্বজনের কোনো ভূমিকা নাই। বলছি না বড় বড় টাকা ওয়ালা আত্মীরা আমাকে একদমই দেখেন নি। কিন্তু ঢাকা শহরে অনেক নিকট আত্মীয়ের বাসা থেকে বাবাকে চোখে জল নিয়ে ফিরে যেতে দেখেছি। পারিবারিক অনেক ব্যাপার থাকে। অনেক আক্ষেপের গল্প থাকে। আমি নাম বলবো না। আত্মীয়তার সূত্রও বলব
না। আমার খুব কাছের এক আত্মীয়ের বাড়িতে একবার বাবা নিয়ে গেলেন। তার বাড়িতে ছেলেকে রাখবেন বলে। দেখা গেল, আমাকে তাদের বাসায় রাখলে কী কী সমস্যা হতে পারে এসব বুঝাতে লাগলেন।। বাবাকে অপমান হতে ফিরে যেতে দেখে আমি বাবাকে সেদিন বলে ছিলাম, ‘তুমি আর কখনো কোনো আত্মীয়ের বাসায় তোমার ছেলেকে রাখার জন্য অনুরোধ করতে যাবা না।’ আজ বাবা নেই। বাবার ফিরে যাওয়ার ব্যাপারগুলো এখনো মনে আছে। সবচেয়ে কষ্টের বিষয় হলো বাবা আমার হাসিমুখ, নির্ভার মুখটা না দেখেই চলে গেছেন।

প্রিয়.কম: জানতে চাই নিজের পছন্দের দুটি কাজের কথা

তানভীর: ‘ওরা আমার মুখের কথা’, ‘আমার ভাইয়ের রক্তে রাঙানো’-এর মতো অসংখ্য জনপ্রিয় গানের গীতিকার ও সুরকার আবদুল লতিফ। তার জীবনের ওপর ১৭ কী ১৮ দিন শুট করে ওই প্রামাণ্যচিত্রটি নির্মাণ করেছি। ওই প্রামাণ্যচিত্রটি এটিএন বাংলায় প্রচার হয়েছিল। সম্ভবত প্রচারের পরের বছরই তিনি মারা যান। প্রায় ১০ বছর আগে ‘ভালোবাসা তোমার জন্য’ শিরোনামের একটি গান লিখেছিলাম। গানটি গেয়েছিলেন বাচ্চু ভাই ও ফাহমিদা আপা। এই গানটিও আমার খুব পছন্দের।

প্রিয়.কম: সামনে কী কী কাজ করার পরিকল্পনা করছেন।

তানভীর: গত বছরও করেছি। এবছরও করব। তরুণ লেখকদের নিয়ে সাহিত্য সম্মেলন ও আড্ডা। তিন দিনের জন্য বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্র বা যে কোনো একটা অডিটরিয়ামে ২০ জন সাংবাদিক ও ছোটভাইদের সাথে আড্ডা। আর আমার তত্ত্বাবধানে কিছু মিউজিশিয়ানদের সাথে একদিন এক বেলা। সঙ্গে থাকবেন কিছু সিনিয়র মানুষদের সঙ্গে বিনিময় করা। দিন শেষে আমারা তাদের সার্টিফিকেট ও ক্রেস্ট দিব। এরকম একটা পরিকল্পনা আছে। আশা করছি এটা আগামী বছর থেকে শুরু করব। এর আগে সাহিত্য সামালোচক সৈয়দ মনজুরুল ইসলাম ও শাকুর মজিদকে সংবর্ধনা দিয়েছি। এটা আসলে তেমন কিছু না। যে কয়েকটা সেক্টরে কাজ করেছি সে কয়েকটা সেক্টরের তরুণদের নিয়ে কাজ করতে চাই। তাদের একটা কিছু দেবার চেষ্টা করবো। যাতে তারা এ সন্ধ্যাটা মনে রাখে। এতে কিছু না কিছু হলেও তার প্রাপ্তি হবে। ইউটিউবের জন্য কিছু কনটেন্ট বানাচ্ছি। একদমই সাধারণ মানুষের জীবন উঠে আসবে। যা সাধারণত দেখতে পাইনা। যেমন একটা রিকশাওয়ালা বা চটপটিওলারা জীবন। তিনি কিভাবে তার জীবনের বিনোদন খুঁজে পান? তার জীবনের আনন্দ কী? তিনি কী সিনেমা দেখেন? বিকেলে ঘুরতে যান? এমন বিষয়গুলো নিয়ে ৫০/৬০ ভিডিও নির্মাণ শেষে হলেই তা ইউটিউবে প্রকাশ করব। এরকম হাজারটা পরিকল্পনা মাথায় নিয়ে রোজ ঘুমাতে যায়। প্রতিদিন কাজ করতে করতে ভাবি। জীবনটা এত ছোট। কতকিছুই করা হয়ে উঠবে না। এভাবে আফসোসের দিন গুনতে গুনতে একদিন চলে যাব। জীবনে খুব বেশি প্রত্যাশা নেই বলে আমি যখন যে অবস্থায় থাকি, সে অবস্থানেই সুখী। এই সরল জীবনই আমার পছন্দের। পাগলের মতো কাজ করে যেতে চাই। এমনই অগোছালো দিনরাত থাকুক আমার জীবনে। কারণ আমি সবকিছু নিজের আনন্দের জন্যই করি। অনেকেই আমায় বুঝাতে আসে, এতসব করে কোনোদিকে অনেক বড় কিছু হওয়া যায় না। আমি তাদের হাসিমুখে বলি সবাই অনেক বড় হলে ছোট মাঝারী থাকবে কে । আমি না সমাজের সেই ভারসম্যেও শ্রমিক হয়েই একটা জীবন কাটিয়ে দিবো। কারণ যারা এসব কথা আমাকে শোনায়, তাদের দেখি প্রতিনিয়ত নিজের অবস্থান মজবুত করার জন্য কত গবেষণা, পরিকল্পনা, চক্রান্ত। আমার ভেতরে ওসবের বালাই রাখতে চাই না। আজ সারাদিন এই যেমন প্রিয়.কমে দারুণ এক আড্ডা দিলাম। আমি খুশী। কাল সকালে আরেকটা কাজ করব। এভাবে একদিন থেমে যাব। কাছের কেউ আমার জানাজায় হয়তো শরীক হবেন। কেউ বা না। দিন বাড়তে বাড়তে ভুলে যাবে সব। তাই প্রতিদিন নিজের জন্য খরচ করতে চাই।

প্রিয় বিনোদন/গোরা 

পাঠকের মন্তব্য(০)

মন্তব্য করতে করুন


আরো পড়ুন

loading ...