রাজধানীর গুলশানে অবস্থিত বাংলালিংকের প্রধান কার্যালয়। ছবি: প্রিয়.কম

বাংলালিংকে ‘গোপন ডাকে’ কর্মী ছাঁটাই

প্রিয়.কমের অনুসন্ধানে এমন তথ্য উঠে এসেছে।

রাকিবুল হাসান
নিজস্ব প্রতিবেদক
প্রকাশিত: ১৮ জুলাই ২০১৮, ২২:০০ আপডেট: ২০ আগস্ট ২০১৮, ১৯:৩২
প্রকাশিত: ১৮ জুলাই ২০১৮, ২২:০০ আপডেট: ২০ আগস্ট ২০১৮, ১৯:৩২


রাজধানীর গুলশানে অবস্থিত বাংলালিংকের প্রধান কার্যালয়। ছবি: প্রিয়.কম

(প্রিয়.কম) কর্মী ছাঁটাইয়ে বিশেষ কৌশলের আশ্রয় নিয়েছে মোবাইল অপারেটর বাংলালিংক। কর্মীদের ‘গোপনে ডেকে’ সাদা কাগজে সই নিয়ে চাকরি থেকে অপসারণ করছে প্রতিষ্ঠানটি।

প্রিয়.কমের অনুসন্ধানে এমন তথ্য উঠে এসেছে।

ছাঁটাইয়ের শিকার ও পদত্যাগ করা একাধিক কর্মী জানান, কর্মীদের অপসারণে পারফরম্যান্স ইমপ্রুভমেন্ট প্ল্যান তথা পিআইপির আশ্রয় নিয়েছে বাংলালিংক। মূলত পুরাতন কর্মীদের লক্ষ্য করে এই পরিকল্পনায় নেমেছে মোবাইল অপারেটরটি।

ওই কর্মীদের ভাষ্য, দুই বছর থেকে শুরু করে ছয় বছরের বেশি সময় ধরে কর্মরতদের গোপনে ডেকে পাঠানো হচ্ছে। এরপর তাদের সাদা কাগজে সই নেওয়া হচ্ছে। কারণ হিসেবে বলা হচ্ছে, তাদের পারফরম্যান্স খারাপ এবং তিন মাস তাদের নির্দিষ্ট কিছু ধাপে কাজ করতে হবে। সে সময়ের মধ্যে পারফরম্যান্স ‘শত ভাগ উন্নত’ না হলে চাকরিচ্যুত করা হবে।

পিআইপিতে অংশ নিয়ে চাকরি হারানো কর্মীরা জানান, যাদের পিআইপিতে ডেকে পাঠানো হচ্ছে, তাদের বলা হচ্ছে স্বেচ্ছায় চাকরি ছেড়ে দিলে তারা এক বা দুই মাসের বেতন পাবেন। আর পিআইপিকালীন থাকতে চাইলে এবং পারফরম্যান্স খারাপ হলে তাদের চাকরিচ্যুত করা হবে। সে ক্ষেত্রে বাড়তি কোনো সুবিধা দেওয়া হবে না।

খোঁজ নিয়ে জানা যায়, বাংলালিংক তাদের এই পরিকল্পনা শুরু করেছে ২০১৭ সাল থেকে। কিন্তু চলতি বছর এর কার্যক্রম ব্যাপক পরিসরে শুরু করে প্রতিষ্ঠানটি। এ বছরই ৩৫ জনের বেশি কর্মীকে এই পিআইপিতে অংশ নেওয়ার বিষয়ে চিঠি দেওয়া হয়।

বাংলালিংক সংশ্লিষ্ট একটি সূত্র জানায়, যারা এ ধরনের চিঠি পেয়েছেন, তাদের অধিকাংশই ‘মানসিক নির্যাতন সইতে না পেরে’ চাকরি ছেড়ে দিয়েছেন।

সিলবিহীন বাংলালিংকের পারফরম্যান্স ইমপ্রুভমেন্ট প্ল্যান বা পিআইপির কাগজ। গোপনীয়তার জন্য কিছু স্থান কালো করে দেওয়া হয়েছে।

যেভাবে চলে প্রক্রিয়া

সাবেক কর্মীরা জানান, পিআইপির প্রক্রিয়ায় যাদের নিয়ে আসা প্রয়োজন, তাদের প্রথমে লক্ষ্যবস্তু বানানো হয়। এর মধ্যে দুই-একজনের ডাক পড়ে। ডাক পাওয়াদের বলা হয়, এটি ৯০ দিনের প্রক্রিয়া। প্রতি মাসেই তাদের পারফরম্যান্স রিভিউ করা হবে।

প্রতি রিভিউতে পিআইপি প্যারামিটারে শত ভাগ পারফরম্যান্স নিশ্চিত করতে হবে কর্মীদের। যাদের পারফরম্যান্স সুবিধাজনক নয়, তাদের দুটি পথ বাতলে দেওয়া হয়। চাকরি ছেড়ে দিতে হবে অথবা বাংলালিংকের নিজস্ব প্রক্রিয়ায় ছাঁটাইয়ের শিকার হতে হবে।

এই প্রক্রিয়ায় কর্মীদের কাছ থেকে নেওয়া হয় সাদা কাগজে সই। দেখা গেছে, যে কাগজে সই নেওয়া হয়, সেটি বাংলালিংকের কোনো প্যাড নয়।

কাগজের উপরের মধ্যভাগে ইংরেজি অক্ষরে লেখা রয়েছে পারফরম্যান্স ইমপ্রুভমেন্ট প্ল্যান (পিআইপি) এবং এর নিচে লেখা রয়েছে গোপনীয়। এর নিচে যাকে এই পিআইপি চিঠি দেওয়া হয়, তার নাম ও অন্যান্য তথ্য। তারও নিচে পিআইপি সম্পর্কে কিছু তথ্য, ওই কর্মীর কোন কোন ক্ষেত্রে দুর্বলতা রয়েছে, তা লিপিবদ্ধ থাকে।

চিঠিতে তিনটি ঘর রয়েছে। সেখানে ইমপ্রুভমেন্ট গোলস, অ্যাক্টিভিটি গোলস ও এক্সপেকটেশনস নামে পয়েন্ট রয়েছে।

কর্মীদের কাছ থেকে যে কাগজে সই নেওয়া হচ্ছে, সেখানে বাংলালিংক কর্তৃপক্ষের কারো সইয়ের স্থান রাখা হয়নি। কাগজে শুধু কর্মীর সই নেওয়া হয়। কাগজটির অনুলিপি কপি কর্মীকে দেওয়া হয় না। তার পরিবর্তে কর্মীকে কাগজের ছবি তুলে নিতে বলা হয়।  

পিআইপিতে ডাক পাওয়া কয়েকজন কর্মী প্রিয়.কমকে জানান, তারা যখন বাংলালিংকে নিয়োগ পান, সেখানে পিআইপির বিষয়ে কোনো কিছু লেখা ছিল না। এ ছাড়া তাদের পারফরম্যান্সের বিষয়ে আগে থেকেও কোনো কিছু জানানো হয়নি। সেই সঙ্গে পিআইপিসংক্রান্ত যারা নোটিশ পান, তাদের কাজে পারদর্শী হওয়ার জন্য প্রশিক্ষণও দেওয়া হয় না।

কর্মীদের ভাষ্য, সাদা কাগজে সই নেওয়ার কারণ জানতে চাইলে সদুত্তর দেয়নি কর্তৃপক্ষ। লোকলজ্জার ভয়ে বিষয়টি কাউকে বলতেও পারছেন না তারা। ‘এই নির্যাতন’ সইতে না পেরে অসুস্থ হয়ে পড়েছেন তারা।

বাংলালিংকের ভাষ্য

এ বিষয়ে জানতে চেয়ে ১৫ জুলাই দুপুরে বাংলালিংক কর্তৃপক্ষের কাছে প্রিয়.কমের পক্ষ থেকে ইমেইল করা হয়। ইমেইলে পিআইপি ও এর বৈধতা নিয়ে জানতে চাওয়া হয়। শ্রম মন্ত্রণালয় থেকে এ বিষয়ে বাংলালিংক কর্তৃপক্ষ কোনো অনুমতি নিয়েছে কি না এবং সিলযুক্ত বাংলালিংকের প্যাড ব্যবহার না করে সাদা কাগজে সই নেওয়ার বিষয়টিও জানতে চাওয়া হয়।

কিন্তু ১৮ জুলাই, রবিবার সন্ধ্যায় পিআইপি থাকার কথা স্বীকার করে সেটি কর্মীদের স্বতঃস্ফূর্ত অংশগ্রহণের মধ্য দিয়ে সম্পন্ন হয় বলে দাবি করে বাংলালিংক কর্তৃপক্ষ।

মেইলে বাংলালিংকের করপোরেট কমিউনিকেশন্স বিভাগের জ্যেষ্ঠ ব্যবস্থাপক আংকিত সুরেকা বলেন, ‘বাংলালিংক দেশের প্রচলিত সকল আইন ও নীতিমালা অনুসরণ করে কার্যক্রম পরিচালনা করে আসছে। কর্মকর্তাদের দক্ষতা মূল্যায়ন করার জন্য প্রতিটি বৃহৎ ও স্বনামধন্য প্রতিষ্ঠানের নিজস্ব কিছু পদ্ধতি আছে। সেইরূপ বাংলালিংকেও প্রত্যেক কর্মকর্তাকে তার নির্দিষ্ট কেপিআই (কী পারফরমেন্স ইনডিকেটর) অনুযায়ী বার্ষিক মূল্যায়ন করা হয়।

এ ছাড়াও প্রযোজ্য ক্ষেত্রে পিআইপিতে (পারফরম্যান্স ইমপ্রুভমেন্ট প্ল্যান) কর্মকর্তাদের স্বতঃস্ফূর্ত অংশগ্রহণের মাধ্যমে সুনির্দিষ্ট পদ্ধতি অবলম্বন করে তাদের কাঙ্ক্ষিত দক্ষতা বৃদ্ধিতে সহায়তা করা হয়। এ ক্ষেত্রে কর্মকর্তারা যেমন নিজেরা উপকৃত হন, তেমনি প্রতিষ্ঠানের উন্নয়নে অবদান রাখতে পারেন। বাংলালিংকের সকল পর্যায়ের কর্মকর্তাদের জন্য এই সুনির্দিষ্ট পদ্ধতিটি প্রযোজ্য।’

প্রিয় টেক/আজহার

পাঠকের মন্তব্য(০)

মন্তব্য করতে করুন


আরো পড়ুন

loading ...