প্রয়াণ দিবসে হুমায়ূন স্মৃতি

মানবজমিন প্রকাশিত: ১৯ জুলাই ২০১৯, ০০:০০

২০০১ এর জুন থেকে আমি দেশান্তরী। ২০০৭ এর নভেম্বর পর্যন্ত দেশে ফিরতে পারিনি। প্রথমে বাংলাদেশ থেকে জাপান। জাপান থেকে আমেরিকা। আমেরিকা থেকে কানাডা। এক দেশ থেকে আরেক দেশ। লম্বা জার্নি। জীবনটা কাটছিলো মোটামুটি দৌঁড়ের ওপর। কতো কতো প্রিয় জিনিস যে ফেলতে ফেলতে গেলাম! কতোজন যে আমার হাতছাড়া হয়ে গেলো! কতোজন যে আমার হাতটি ছেড়ে দিলো! কিন্তু একজনের সঙ্গে সম্পর্কটা আমার ছিন্ন হলো না। তিনি হুমায়ূন আহমেদ।আমি যেদিন সন্ধ্যায় দেশ ছাড়ি সেদিন বিমানে আমার সঙ্গে ছিলো হুমায়ূনের বই। টোকিওর একটি হাসপাতালে আমার স্ত্রী শার্লির অপারেশন হলো। প্রতিদিন সকালে হাসপাতালে যাই ফিরে আসি রাত বারোটায়। বারোটার পর আর ওখানে থাকার নিয়ম নেই। কড়া ডোজের পেইন কিলার ইনজেকশন নিয়ে শার্লি হাসপাতালের বেডে ঘুমিয়ে থাকে। আমি ওর পাশে সারাদিন বসে থাকি। আমার সঙ্গে থাকে হুমায়ূনের বই।কানাডার ইউনিভার্সিটিতে আমার কন্যা নদীর ক্লাশ কিংবা পরীক্ষার কারণে ওকে পৌঁছে দিয়ে ওখানেই গাড়ি পার্ক করে তিন চার ঘন্টা অপেক্ষা করতে হবে। আমার একটুও বিরক্তি লাগে না কারণ আমার সঙ্গে থাকেন হুমায়ূন আহমেদ। এখন প্রতি বছর কানাডা থেকে বাংলাদেশে যেতে অটোয়া-হিথ্রো-দুবাই-ঢাকার দীর্ঘ ক্লান্তিকর বিমান যাত্রায় আমার সমস্ত ক্লান্তি মোচনে সঙ্গী হিশেবে উপস্থিত থাকেন হুমায়ূন আহমেদ। ফিরতি পথেও ধ্রুব এষের অসাধারণ প্রচ্ছদের ভেতর থেকে হুমায়ূন আহমেদ যেনো পরম মমতায় তাঁর হাতটি বাড়িয়ে দেন—এনিমেশন মুভিটা দেখার পরে একটা ব্রেক নাও, তারপর নো চিন্তা, আমি তো আছিই...।হুমায়ূন আহমেদকে ছাড়া আমাদের ঈদ হয় না। ঈদের রাতে টিভিতে হুমায়ুনের নাটক না দেখলে বাঙালির কি ঈদ পরিপূর্ণ হয়? আমার এক নিত্যশুভার্থীর কল্যাণে ঢাকার ঈদ সংখ্যাগুলো দ্রুতই চলে আসে কানাডায়, আমার হাতে। গত ঈদের আগে আগেও পেয়েছিলাম বিশাল একটা ওজনদার প্যাকেট। প্যাকেটের ভেতর প্রথম আলো, আনন্দ আলো, অন্যদিন, সাপ্তাহিক, আর ইত্তেফাক। অন্যদিনের হিমু, ইত্তেফাকের মিসির আলী, প্রথম আলোর মেঘের ওপর বাড়ি আর আনন্দ আলোর কবি সাহেব পড়েছি সবার আগে। তারপর বাকিদের বাকি লেখাগুলো।কানাডায় একান্ত পারিবারিক পরিবেশে আমাদের বাড়িতে পালিত হয় প্রিয়জনদের জন্মদিন। সেটাও আবার সপ্তাহ ব্যাপী। যেমন সত্যজিৎ সপ্তাহ। অমিতাভ সপ্তাহ। বিশেষ সেই সপ্তাহে সাতদিন ধরে আমাদের বাড়িতে চলে সত্যজিতের বই পুনঃপাঠ এবং সত্যজিতের ফিল্মগুলোর প্রদর্শনী। প্রতিরাতে একটা করে। হীরক রাজার দেশে দিয়ে শুরু আর শেষ হয় পথের পাঁচালি দিয়ে। অমিতাভের ক্ষেত্রে তাঁর অভিনীত ছবিগুলো দেখি। প্রতিরাতে একটা করে। শোলে দিয়ে যার শুরু হয়। একই পদ্ধতিতে চলে চার্লি চ্যাপলিন আর মিঃ বিন সপ্তাহ। তবে সবচে আনন্দের সঙ্গে উদযাপিত হয় হুমায়ূন সপ্তাহটি। এই সময় আমার সঙ্গে আমার স্ত্রীও থাকেন দর্শকের আসনে। বাকিদের বেলায় দর্শক আমি একাই।১৯৯৪ সালে অবসর থেকে প্রকাশিত আমার বই ‘ভূতের জাদু’ আমি উৎসর্গ করেছিলাম হুমায়ূন আহমেদকে। বইটির প্রকাশক আলমগীর রহমানকে সঙ্গে নিয়ে বইটি তাঁর হাতে অর্পণ করতে গিয়েছিলাম। তিনি তখন হাতিরপুলের ল্যাবএইডসংলগ্ন এপার্টমেন্টে থাকেন। তিনি নিজে ফ্লোরে বসতেন। অতিথিদেরও ফ্লোরেই বসাতেন। আমাদেরও ফ্লোরে বসিয়ে অনেক কথা বলেছিলেন সেদিন। উৎসর্গ পাতাটা খুলে মিষ্টি করে হেসেছিলেন। কন্যাদের ডেকে আনন্দ শেয়ার করেছিলেন।১৯৯৫ সালে আমার সম্পাদিত ছোটদের কাগজ পত্রিকাটিতে ‘কালো জাদুকর’ নামে একটি ধারাবাহিক উপন্যাস লিখেছিলেন হুমায়ূন। আসলে আমাদের সাহিত্যে হুমায়ূন নিজেই একজন জাদুকর। অসামান্য জাদুকর। এমন সম্মোহনী শক্তি নিয়ে আর কেউ আসেননি। আমরা আমাদের সময়ে একজন হুমায়ূন আহমেদকে পেয়েছি। এটা অনেক বড় প্রাপ্তি। (‘কালো জাদুকর’ তিনি শেষ করেননি ছোটদের কাগজে।)২কতো স্মৃতি এই মানুষটাকে ঘিরে!১৯৮৫ সালের শেষ দিকের কথা। তখন দেশে কম্পিউটার আসেনি সুতরাং কম্পিউটার কম্পোজ বলে কোনো জিনিস ছিলো না। ছিলো হ্যান্ড কম্পোজ আর মনো টাইপ। নবাবপুর রোডের মডার্ণ টাইপ ফাউন্ড্রির মালিক নাজমুল হক ‘অনিন্দ্য প্রকাশন’ নামে নতুন একটি প্রকাশনা সংস্থা চালু করেছিলেন। আমীরুল আর ওর বন্ধু হাবিব ওয়াহিদ আমার সঙ্গে নাজমুল হকের পরিচয় করিয়ে দিলো। অনিন্দ্য প্রকাশন থেকে হুমায়ূন আহমেদের উপন্যাস ‘এইসব দিনরাত্রি’ বেরুবে। ছোটদের জন্যে আমার প্রথম গল্পের বই ‘নিখোঁজ সংবাদ’ও বেরুবে ওই প্রকাশনা সংস্থা এবং ওই মডার্ণ প্রেস থেকেই। প্রায় সারাদিনই কেটে যায় প্রেসের ভেতরেই। প্রুফ দেখা। মেকাপ করা। অনেক কাজ। রোজ দেখা হয় হুমায়ূন ভাইয়ের সঙ্গে। তাঁকে একটা নড়বড়ে হোন্ডায় বসিয়ে ওখানে নিয়ে আসেন দৈনিক বাংলার সাংবাদিক সালেহ চৌধুরী। পাশাপাশি টেবিলে বসে আমরা কাজ করি। মাঝে মধ্যেই হুমায়ূন ভাই রঙ্গ-তামাশায় মেতে ওঠেন। তবে বেশির ভাগ সময়ই ঘাড় গুঁজে একটানা লেখেন অথবা প্রুফ সংশোধন করেন বা ফাইনাল প্রিন্টঅর্ডার দেন।অসাধারণ রসিক মানুষ হুমায়ূন ভাই। কাজের ফাঁকে আমরা আড্ডা দেই জম্পেশ। প্রকাশক নাজমুল হকের ছিলো বিশাল বপু। একটা বড় চেয়ারে বসে থাকতেন। আমাদের কথায় নাজমুল হাসতেন অদ্ভুত ভঙ্গিতে। চেয়ারে বসা অবস্থায় নাজমুল তার হাত দুটি ভাঁজ করে বিশাল ভূঁড়ির ওপর রাখতেন। তার হাসি শুরু হতো পেটের নিচ দিক থেকে। প্রথমে পেটের নিচের অংশে একটা কাঁপুনি তৈরি হতো। তারপর কাঁপুনিটা একটা দুলুনি হয়ে ধিরে ধিরে পেটের ওপর দিকে উঠতে উঠতে প্রায় বুকের কাছে এসে দুলতে থাকতো। পেটের ওপর ভাঁজ করে রাখা দুই হাতের কব্জিতে তখন একটা রিদম তৈরি হতো। নাজমুল ভুট্টা অর্ডার দিতেন। কয়লাপোড়া ভুট্টা খেতে খেতে আমরা হুমায়ূন ভাইয়ের রসিকতা উপভোগ করতাম। হুমায়ূন ভাই খুব আগ্রহ নিয়ে খেতেন এই ভুট্টাপোড়া। দীর্ঘদিন আমেরিকায় পড়াশুনা ও বসবাসকারী এই নাজমুল আমাদের প্রকাশনা জগতের ইতিহাসে নতুন ইতিহাস সৃষ্টি করেছিলেন। সালেহ চৌধুরীর নড়বড়ে হোন্ডায় হুমায়ুণ ভাইকে আসতে যেতে দেখে তিনি এক কাণ্ড করলেন। হুমায়ূন ভাইকে রয়্যালিটির টাকা দেই-দিচ্ছি দেই-দিচ্ছি করে কিছুদিন ঘুরিয়ে হঠাৎ একদিন শাদা একটা গাড়ি কিনে দিয়েছিলেন হুমায়ূন ভাইকে। হুমায়ূন ভাই সবাইকে চমকে দেন কিন্তু নাজমুল চমকে দিলেন স্বয়ং হুমায়ূন ভাইকেই! বলেছিলেন--এটাই আপনার রয়্যালিটি! হুমায়ূনের আহমেদের জীবনে সেটাই ছিলো প্রথম গাড়ি। সেই গাড়িতে চড়ে হুমায়ূন ভাইয়ের সঙ্গে রামপুরা টিভি ভবনেও গিয়েছি অনিন্দ্য প্রকাশনীর কাজ সেরে। প্রকাশক কর্তৃক লেখককে গাড়ি দেয়ার ঘটনা আমাদের দেশে সেটাই ছিলো প্রথম এবং শেষ ঘটনা। বাদবাকি প্রকাশকদের চক্ষু উঠেছিলো কপালে। সে অন্য কাহিনি। ঘটনায় ফিরে আসি।এক বিকেলে নাজমুলের প্রেসের সেই জম্পেশ আড্ডায় বিটিভি প্রযোজক ও লেখক আলী ইমাম সম্পর্কে জ্ঞানগর্ভ ভাষণ দিচ্ছি। হুমায়ূন ভাই খুব মনোযোগ দিয়ে শুনছেন। আলী ইমাম ভাইয়ের অসাধারণ একটা গুণের কথা বললাম। গুণটি হচ্ছে—টাইম ধরে ঘুমানো। আলী ইমাম চাইলে কাজের ফাঁকে দশ কিংবা পনেরো মিনিটের একটা সলিড ঘুম দিতে পারেন। তিনি নিজের ইচ্ছে মাফিক কাজটা করেন। কেউ তাকে জাগিয়ে দেয়না। ঘড়িতে এলার্মও বাজেনা। কিন্তু আলী ইমাম ঠিক ঠিক জেগে ওঠেন সময় মতো। দশ মিনিট চাইলে দশ মিনিট। বারো মিনিট চাইলে বারো। এমনও হয়েছে, সারারাত ছবি দেখে ভোর সাড়ে পাঁচটায় আমরা শুতে গেছি। আলী ইমাম বললেন, সকাল সাতটায় রেডিওতে আমার প্রোগ্রাম আছে। আমি পৌণে এক ঘন্টা ঘুমাবো। তারপর উঠে গোসল করে রেডিওতে চলে যাবো। তোমরা ঘুমিয়ে থেকো। এসে নাস্তা করবো একসঙ্গে। এবং ঠিক ঠিক তাই-ই হলো। আমরা(আমি, আমীরুলসহ আরো চার পাঁচজন)ঘুমিয়ে আছি। আর আলী ইমাম টাইমলি জেগে লাইভ রেডিও প্রোগ্রাম শেষ করে আমাদের এসে জাগালেন।তো হুমায়ূন ভাই এই গল্পটাকে বিশ্বাস করলেননা। তিনি বললেন, তোমাদের চমকে দেবার জন্যে এটা হয়তো আলী ইমামের একটা টেকনিক। ও হয়তো ঘুমাতেই যায়নি। সারারাত জেগেই ছিলো। কিংবা দশ মিনিটের কথা বলে ও হয়তো ঘুমায়ইনা। ঘুমের ভান করে পড়ে থাকে। তারপর সময় মতো জেগে উঠে চমকে দেয় তোমাদের। এই প্রবণতাটার একটা ইংরেজি নামও বললেন হুমায়ূন ভাই। এই মুহূর্তে নামটা মনে নেই।এর কয়েকদিন পর। সেই মডার্ণ প্রেস। তখন প্রায় সন্ধ্যা। পাশের টেবিলে হুমায়ূন ভাই খসখস করে লিখে চলেছেন। হঠাৎ দেখা গেলো হুমায়ূন ভাইয়ের লেখা বন্ধ। কলম বন্ধ করে অনেকক্ষণ ঝিম মেরে বসে রইলেন তিনি। তারপর চশমাটা খুলে চোখ মুছলেন। জিজ্ঞেস করলাম, কী ব্যাপার হুমায়ূন ভাই!হুমায়ূন ভাই চোখ মুছতে মুছতে বললেন, এইসব দিনরাত্রির শেষ লাইনটা এইমাত্র লিখলাম। একটা পরিবারের সঙ্গে এইমাত্র আমার এতোদিনের সম্পর্ক শেষ হয়ে গেলো।ঘটনাটা আলী ইমামকে বললাম। সব শুনে আলী ইমাম বললেন, ওটা হুমায়ূন ভাইয়ের একটা টেকনিক। তোমাদের চমকে দেবার জন্যে হুমায়ূন ভাই কাজটা করেছেন। ( হেহ্‌ হেহ্‌ হে...)৩ তখন বাংলাদেশে কোনো প্রাইভেট টিভি চ্যানেল ছিলো না। টিভি বলতে বাঙালির ছিলো সবেধন নীলমনি বিটিভি। এবং বিটিভির শাদাকালো আমলে বাঙালির একজন হুমায়ূন আহমেদ ছিলো। সেই হুমায়ূন আহমেদকে নিয়ে মধ্যবিত্ত বাঙালি খুব সুখি ছিলো। বাঙালি মধ্যবিত্তের আনন্দ-বেদনার অপরূপ রূপকার ছিলেন হুমায়ূন আহমেদ। বিশেষ করে মধ্যবিত্ত বাঙালির ঈদ উৎসব হুমায়ূন আহমেদকে ছাড়া আনন্দময় হতো না, পরিপূর্ণতা পেতো না। মধ্যবিত্ত বাঙালির ঈদ উৎসবে পোলাও-কোর্মা, ফিন্নি-শেমাই এবং নতুন জামা-কাপড়ের সঙ্গে হুমায়ূনের ঈদের নাটকও ছিলো একটি অপরিহার্য অনুষঙ্গ। ঈদের সারা দিনের নানান সামাজিক-পারিবারিক আমন্ত্রন-নিমন্ত্রন, সৌজন্য-সাক্ষাৎ, ভোজের আয়োজন এবং অতিথি আপ্যায়নের বিচিত্র ঝক্কি-ঝামেলার পর সন্ধ্যায় টিভি সেটের সামনে আয়েস করে বসে বাঙালি অপেক্ষা করতো হুমায়ূনের নাটকের। সন্ধ্যার পর রাস্তায় লোক চলাচল কমে যেতো। একজন হুমায়ূন আহমেদের একটি টিভি নাটক দেখার জন্যে বাঙালির সম্মিলিত অপেক্ষার সেই চিত্রটি ছিলো অকল্পনীয়। না, শুধু রাজধানী ঢাকার চিত্র ছিলো না এটা। পুরো বাংলাদেশেরই ছিলো একই অবস্থা। হুমায়ূন আহমেদের ঈদের নাটকটি ছিলো মধ্যবিত্ত বাঙালির অন্যতম প্রধান বিনোদন মাধ্যম। ফাঁকা রাস্তা। হুমায়ূনের নাটক চলছে বিটিভিতে। বিভিন্ন বাড়ির খোলা জানালা দিয়ে পরিবারের সদস্যদের সম্মিলিত আনন্দময় হাস্যধ্বনি শোনা যেতো। মাঝে মাঝেই অট্টহাসির উল্লাসধ্বনিও জানান দিতো যে হুমায়ূন আহমেদ নামক একজন জাদুকরলেখক-নাট্যকারের ঈদের নাটকটি বাঙালি উপভোগ করছে। একই ঘটনার পূনরাবৃত্তি ঘটেছে বছরের পর বছর।ঈদের বিশেষ নাটক ছাড়াও হুমায়ূনের কোনো সাপ্তাহিক কিংবা ধারাবাহিক নাটক প্রচারের রাতেও একই পরিস্থিতি। রাস্তা ফাঁকা। বাড়ির অধিকাংশ সদস্যই টিভি সেটের সামনে। শুধু হাসির নাটক নয়, হুমায়ূনের দুঃখের বা কষ্টের নাটকও বাঙালি মধ্যবিত্তের চিত্তকে হরণ করতো অনায়াস দক্ষতায়। বিটিভিতে তাঁর প্রথম ধারাবাহিক নাটক ‘এইসব দিনরাত্রি’ তো ইতিহাস সৃষ্টিকারী। এই নাটকের ছোট্ট মেয়েটি—টুনি, ক্যান্সারে যার মৃত্যু হচ্ছে, কিন্তু দর্শক সেটা মেনে নিতে পারছে না। ছোট্ট প্রিয় মেয়েটিকে মেরে না ফেলতে দর্শকরা কতো ভাবেই না অনুরোধ জানালো নাট্যকার হুমায়ূনকে! কিন্তু হুমায়ূন জেদী। তিনি টুনিকে মেরেই ফেললেন। ফলে, তাঁর বিরুদ্ধে কোথাও কোথাও মিছিল হলো। ব্যানারে লেখা—টুনির কেনো মৃত্যু হলো/হুমায়ূন আহমেদ জবাব চাই।বিটিভিতে হুমায়ূনের আরেকটি ধারাবাহিক নাটক ‘কোথাও কেউ নেই’ প্রচারের সময়েও ঘটেছে একই কাণ্ড। এই নাটকে ‘বাকের ভাই’ নামের চরিত্রটির ফাঁসি হয়ে যাচ্ছে। বাকের ভাইয়ের ফাঁসি রুখতেও মিছিল হলো। পত্রিকায় সে খবর ছাপাও হলো। জেদী হুমায়ূন বাকের ভাইকেও বাঁচালেন না। নাটকের প্রয়োজনে বাকেরকে মরতেই হবে। হুমায়ূন তাকে মারলেনই। দর্শকদের দাবিকে গুরুত্ব না দিয়ে নাটক বা গল্পের দাবিকেই মিটিয়েছেন নাট্যকার হুমায়ূন আহমেদ। বাংলাদেশে টিভি নাটকের ইতিহাসে এইরকম ঘটনা আর কোনো লেখক-নাট্যকারের ক্ষেত্রে ঘটেনি।এরপর বাংলাদেশে প্রাইভেট টিভি চ্যানেল এসেছে। হুমায়ূন আহমেদকে বিভিন্ন চ্যানেল পাকড়াও করেছে। নাটক চাই। তিনিও লিখেছেন।হুমায়ূনের নাটক ছাড়া তো ঈদের আনন্দ পূর্ণ হবার নয়!বাঙালির ঈদ বিনোদনের আরেকটি অনুষঙ্গ হচ্ছে বিভিন্ন পত্রিকার ঈদ সংখ্যা। আর ঈদ সংখ্যারও প্রধান আকর্ষণ সেই একই ব্যাক্তি, হুমায়ূন আহমেদ। কোনো পত্রিকার ঈদ সংখ্যায় হুমায়ূন আহমেদের একটি উপন্যাস থাকা মানেই সেটি বিপুল পরিমানে বিক্রি হবার ক্ষেত্রে একটি নিশ্চিন্ত গ্যারান্টিসিল। সুতরাং হুমায়ূনের একটি উপন্যাসের জন্যে পত্রিকার মালিক-সম্পাদকের ছুটোছুটির অন্ত ছিলো না।হুমায়ূনের উপন্যাস ছাড়া তো ঈদ সংখ্যাও পরিপূর্ণ নয়!বাংলা একাডেমীর একুশের বইমেলা হুমায়ূন আহমদকে ছাড়া কি কল্পনা করা যায়? একজন হুমায়ূন আহমেদকে সামনা সামনি এক ঝলক দেখতে, তাঁর লেখা একটি বই কিনতে এবং বইতে তাঁর একটি অটোগ্রাফ পেতে বাঙালি ভিড় করেছে বইমেলায়। সেই ভিড় সামাল দিতে কর্তৃপক্ষকে পুলিশি সহায়তা নিতে হয়েছে প্রতিবছর। একবার তো এক মহাপরিচালক(সৈয়দ আনোয়ার হোসেন) হুমায়ূন আহমেদকে নিষেধই করেছিলেন যেনো তিনি বইমেলায় না আসেন! কী হাস্যকর!!একুশের বইমেলায় বছরের পর বছর একটি নির্দিষ্ট বইয়ের স্টলের সামনে আমরা দেখেছি সহস্র পাঠকের জমাট অপেক্ষা। প্রায় প্রতিদিন। উদ্দেশ্য—হুমায়ূনের সাম্প্রতিক বইটি সংগ্রহ করা! বাংলাদেশে আর কোনো লেখকের ক্ষেত্রে এমনটি কখনোই ঘটেনি। হুমায়ূনের বই ছাড়া তো একুশের বইমেলাও পরিপূর্ণ নয়!তাঁর মতো আর কে পেরেছে বাঙালি মধ্যবিত্তের সুক্ষ্মাতিসুক্ষ্ম অনুভূতিগুলোতে এতোটা মমতার সঙ্গে আলো ফেলতে? তারচে বেশি কে চিনেছে মধ্যবিত্ত বাঙালির চিরদিনের টানাপোড়েনগুলোকে? বাঙালি মধ্যবিত্তের আনন্দ-বেদনা আর হাসি-কান্নার সঙ্গে একজন হুমায়ূন আহমেদ জড়িয়ে আছেন চারটি দশক ধরে একই ধারাবাহিকতায়! সমান দক্ষতায় বাঙালিকে তিনি হাসিয়েছেন। কাঁদিয়েছেন। হুমায়ূন আহমেদ নামটা একাকার হয়ে মিশে আছে বাঙালির হাসিতে। বাঙালির অশ্রুতে। হুমায়ূনহীন ঈদের টিভি, হুমায়ূনহীন ঈদ সংখ্যা আর হুমায়ূনহীন একুশের বইমেলাকে বাঙালি কী ভাবে উদযাপন করবে!আজ অশ্রুসিক্ত নয়নে বিদায় জানাচ্ছি বাঙালির প্রিয় কথক হুমায়ূন আহমেদকে।রচনাকাল/ অটোয়া, কানাডা, ২০জুলাই২০১২
সম্পূর্ণ আর্টিকেলটি পড়ুন
ট্রেন্ডিং

সংবাদ সূত্র

News

The Largest News Aggregator
in Bengali Language

Email: [email protected]

Follow us