আজকের আধুনিক বিশ্বে শুধু পুরুষ নয়, নারীরাও সংগ্রাম করে এগিয়ে যাচ্ছেন। এই সংগ্রামে বিজয়ী হয়ে নিজের জীবন সাজানোর পাশাপাশি অনেকের প্রেরণার জোগান দিচ্ছেন তারা। এক সময় সমাজের অধিকাংশ নারী-ই রক্ষণশীলতার অজুহাতে আবার কেউ নিরাপত্তার অজুহাতে নিজেকে গুঁটিয়ে রাখতেন। এখন সেইদিন আর নেই, বাধা ডিঙ্গিয়ে অভিষ্ট লক্ষে পৌঁছাচ্ছেন নারীরা। তারা দৃঢ় মনোবল, সাহস, বুদ্ধি ও পরিশ্রমের সমন্বয়ে নিজেই গড়ছেন নিজের জগৎ। তেমনি জীবন সংগ্রামে জয়লাভ করে এগিয়ে যাচ্ছেন বিয়ানীবাজারের পাঁচ জয়িতা। তাদের মধ্যে অর্থনৈতিক সাফল্য অর্জন করেছেন মেওয়ার পারুল বেগম, শিক্ষা ও চাকরি ক্ষেত্রে সাফল্য অর্জন করেছেন শিল্পী রাণী দত্ত, সফল জননী নারী শাহজাদী সুলতানা বেগম, নির্যাতনের বিভীষিকা মুছে ফেলে নতুন উদ্যমে জীবন শুরু করা মোছাঃ রুবিনা আক্তার রুবি ও সমাজ উন্নয়নে অসামান্য অবদান রাখা নারী তাজিরুন বেগম। তাদের জীবনযুদ্ধের গল্প হার না মানার..। পারুল বেগম: ছোটবেলা থেকে জীবনের সঙ্গে যুদ্ধ করে বড় হওয়ার শিক্ষা পেয়েছেন। বিভিন্ন প্রতিকূলতা এবং সংসারের অনটনের কথা চিন্তা করে অনেকটা কিশোর বয়সেই মামা তার বিয়ে দিয়ে দেন। বিয়ের সময় তার শ্বশুর-শাশুড়িকে পড়ালেখা করানোর কথা বললে তারা রাজি হন। কিন্তু বিয়ের পর তার আর লেখাপড়া করা হয়নি। স্বামীর ক্ষুদ্র ব্যবসায় তার সংসারের চাকা ধীরলয়ে ঘুরতে থাকে। তবে কিছুদিন পর ব্যবসায় ক্ষতি হওয়ায় তাও বন্ধ হয়ে যায়। পরে স্বামীর পরামর্শে কিছু ছাত্রছাত্রীকে প্রাইভেট পড়ানো শুরু করেন পারুল বেগম। স্বামীও যোগ দেন রাজমিস্ত্রির কাজে। এ সময় স্থানীয় একটি এনজিও থেকে ঋণ নিয়ে পুরাতন সেলাই মেশিন ক্রয় করেন। এভাবে তার আয় বাড়তে থাকে। কিছুদিন পর স্থানীয় ইউপি চেয়ারম্যান ৫ হাজার টাকা মাসিক বেতনে তাকে এলাকার অন্যান্য মেয়েদের সেলাই কাজ শুরুর দায়িত্ব দেন। এভাবে দুই বছর পেরিয়ে গেলে ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচনে সংরক্ষিত ওয়ার্ডের নারী সদস্য পদে নির্বাচন করে জয়লাভ করেন তিনি। বর্তমানে তার নিজ খামারে ২৫টি মুরগী, ২৩টি ছাগল ও ৮টি গরু রয়েছে। এ ছাড়াও তার একটি মোবাইল সার্ভেসিং এর দোকান রয়েছে। তিনি উপজেলার মেওয়া গ্রামের মো. আবদুল হান্নানের স্ত্রী। শিল্পী রাণী দত্ত: ১৯৮৩ সালে ৫ম শ্রেণি পাশ করার পর যোগাযোগ সুবিধা না থাকা এবং দারিদ্র্যতার কারণে তার লেখাপড়া বন্ধ হওয়ার উপক্রম হয়। তখন নিজের ইচ্ছা আর মায়ের চেষ্টায় মাধ্যমিক বিদ্যালয়ে ভর্তি হন তিনি। বাবা ছিলেন সংসারের একমাত্র উপার্জনক্ষম ব্যক্তি। চরম প্রতিকূলতার মাঝেও ১৯৯০ সালে এসএসসি পাস করেন। কলেজে পড়াকালীন একটি কিন্ডারগার্টেনে খণ্ডকালীন শিক্ষক হিসেবে একবছর চাকরি করেন। এ সময় তিনি পরিবার কল্যাণ সহকারী পদে চাকরি পান। একই কলেজ থেকে তিনি বিএ পাস করেন। বর্তমানে তিনি একটি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের সহকারী শিক্ষিকা হিসেবে চাকরি করছেন। শিল্পী রাণী দত্ত উপজেলার চারখাই ইউনিয়নের বিলুয়া গ্রামের অমরেশ চন্দ্র দেবের স্ত্রী। শাহজাদী সুলতানা বেগম: খুব কষ্টে এসএসসি পাস করে পরিবার-পরিকল্পনা বিভাগে চাকরি নেন। কিন্তু পারিবারিকভাবে চাকরি ছেড়ে দিতে বাধ্য হন তিনি। বোন জামাই তখন হুমকি দেন-চাকরি না ছাড়লে বোনকে ছেড়ে যাবেন। চাকরি ছেড়ে দেয়ার পর এক বেকার যুবকের সঙ্গে তার বিয়ে হয়। পরে অবশ্য তার স্বামী কুয়েতে পাড়ি জমান। সেখানে খাপ খাওয়াতে না পেরে শূন্য হাতে বাড়ি ফিরেন স্বামী। সংসারের হাল ধরেন শাহজাদী। এক সময় দিন বদলাতে শুরু করে তার। রুবিনা আক্তার রুবি: আর্থিক অনটনের সংসারে ১০ম শ্রেণিতে পড়াবস্থায় তার বিয়ে দেয়া হয়। বিয়ের পর নতুন সংসার ভালো চলছিল। হঠাৎ স্বামী মানসিকভাবে অসুস্থ হয়ে পড়েন। এ কারণে তার সৌদি আরব যাওয়া হয়নি। এটা মেনে নিতে না পেরে শ্বশুরবাড়ির লোকজন রুবিকে দোষারোপ শুরু করেন। শুরু হয় তার ওপর শারীরিক ও মানুষিক নির্যাতন। এতে তিনি বাপের বাড়ি চলে আসেন। পরবর্তীতে বৈরাগীবাজারের একটি মহিলা সংস্থায় প্রশিক্ষক হিসেবে কাজ করেন তিনি। তখন তাকে সম্মানী হিসেবে মাসিক ৪ হাজার টাকা দেয়া হতো। তিনি এই কাজের পাশাপাশি এলাকায় স্বর্ণকারের দোকানে কাজ নেন। পুঁজি কম ও আয় বেশি হওয়ায় পূর্বের জুয়েলারি দোকানের কর্মচারীর অভিজ্ঞতা কাজে লাগিয়ে তিনি নিজেও এরকম একটি দোকান দেন। তার দোকানে এখন ৬ জন কর্মচারী কাজ করছে। তাজিরুন বেগম: মাত্র ১৫ বছর বয়সে আততায়ীর হাতে বাবা মারা যাওয়ার পর ৭ ভাই ও ১ বোনকে নিয়ে শুরু হয় তার সংগ্রাম। দুইবার তার লেখাপড়া বন্ধ হওয়ার উপক্রম হয়। স্কুলের শিক্ষক ও ইউপি চেয়ারম্যানের সহায়তায় এইচএসসি পাস করেন। এ সময় বাড়িতে সেলাই কাজের পাশাপাশি স্থানীয় ইউনিয়ন অফিসে সহকারী হিসেবে মাস্টার রোলে যোগ দেন। প্রতি শনিবার সূর্যের হাসি ক্লিনিকের প্রতিনিধি হিসেবে দরিদ্র অসহায় মা ও বোনদের চিকিৎসা সেবা প্রদান করেন। বর্তমানে তিনি একটি বাড়ি একটি খামার প্রকল্পের সভাপতি, বৈরাগীবাজার মহিলা সমিতির সভাপতি, কমিউনিটি স্যাটেলাইট ক্লিনিক পরিচালনা কমিটির সভাপতি হিসেবে মানুষের কল্যাণ করে যাচ্ছেন। তিনি নিজস্ব অর্থায়নে দুই কক্ষ বিশিষ্ট পাকাঘর, ১০ শতক জমি ক্রয় করেছেন। তিনি সমাজ উন্নয়নে কাজ করে জয়িতা মনোনয়ন পেয়েছেন। তিনি লাউতা ইউনিয়নের পাড়িয়াবহর গ্রামের মৃত কালা মিয়ার মেয়ে।