শিশুদের ওপর বর্বরতার শেষ কোথায়?

মানবজমিন প্রকাশিত: ২৭ এপ্রিল ২০১৯, ০০:০০

ডেমরায় নুর-ই মদিনা মাদ্‌রাসার ছাত্র শিশু মো. মনির হোসেনকে মুক্তিপণের টাকা পাওয়ার আগেই হত্যা করা হয়েছে। ছেলেকে ফিরে পেতে মুক্তিপণের কিছু টাকাও জোগাড় করে নিয়ে গিয়েছিলেন মনিরের বাবা। নির্ধারিত জায়গায় টাকা নিয়ে সারা রাত বসে ছিলেন। ডেমরার ডগাইর নতুন পাড়ার সাইদুল হকের দুই মেয়ে ফাতেমা আক্তার (১২), মুন্নি আক্তার (৯) ও ছেলে মো. মনির হোসেন (৮) ডগাইর নতুনপাড়ার নূর-ই মদিনা মাদ্‌রাসায় লেখাপড়া করত। প্রতিদিনের মতো ৭ই এপ্রিল তারা সকাল সাতটায় মাদ্‌রাসায় যায়। বেলা ১১ টার দিকে মেয়ে মুন্নি বাসায় এসে বাবাকে জানায়, মনিরকে মাদ্‌রাসায় খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না। তখন সাইদুল হক তাঁর স্ত্রীসহ মেয়েদের নিয়ে মাদ্‌রাসায় এবং আশপাশে সম্ভাব্য সব জায়গায় ছেলেকে খোঁজাখুঁজি করেও তাকে পাননি। ছেলে নিখোঁজের তথ্য জানিয়ে এলাকায় মাইকিং করা হয়। ওই দিনই ডেমরা থানায় একটি সাধারণ ডায়েরি করেন তিনি। ঘটনার দিন রাতে অজ্ঞাতনামা ব্যক্তি সাইদুল হকের মোবাইল ফোনে কল করে মনিরের মুক্তি পণ হিসেবে তিন লাখ টাকা দাবি করে। মুক্তিপণের টাকা মসজিদুল-ই-আয়েশা জামে মসজিদের ভেতরে জানাজার খাটিয়ার নিচে রেখে আসার কথা বলে। টাকা না দিলে ছেলের লাশ পাবে না বলে হুমকি দেন ওই ব্যক্তি। বিষয়টি পুলিশকে জানালে, ডেমরা জোনের জ্যেষ্ঠ সহকারী পুলিশ কমিশনারের নেতৃত্বে ডেমরা থানা-পুলিশ সম্ভাব্য সকল জায়গায় ছেলেকে উদ্ধারে অভিযান চালায়। উদ্ধার অভিযানের একপর্যায়ে ৮ই এপ্রিল বিকাল পাঁচটার দিকে মসজিদুল-ই-আয়েশা জামে মসজিদের দ্বিতীয় তলা থেকে তৃতীয় তলায় ওঠার সিঁড়ির চৌকিতে সিমেন্টের বস্তার ভেতরে রশি দিয়ে প্যাঁচানো অবস্থায় মনিরের লাশ উদ্ধার করে পুলিশ। এ ঘটনায় ডেমরা থানায় একটি হত্যা মামলা হয়। হত্যার ঘটনায় জড়িত সন্দেহে তিনজনকে গ্রেপ্তার করেছে পুলিশ।ফরিদপুরে আড়াই বছরের এক শিশু ধর্ষণের শিকার হয়েছে। ৮ই এপ্রিল বিকাল সাড়ে চারটার দিকে ফরিদপুর সদরে এ ঘটনা ঘটে। গুরুতর অসুস্থ অবস্থায় শিশুটিকে উদ্ধার করে ফরিদপুর মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের মহিলা ওয়ার্ডে ভর্তি করা হয়। রিকশাচালক বাবার তিন মেয়ের মধ্যে শিশুটি মেজ। শিশুর পরিবার ও এলাকাবাসী সূত্রে জানা যায়, বিকালে শিশুটি বাড়ির পাশের একটি মাঠে খেলছিল। ওই সময় মিন্টু শেখ (১৯) নামের এক তরুণ শিশুটিকে পাশের একটি বাঁশঝাড়ে নিয়ে ধর্ষণ করে। শিশুর চিৎকারে এলাকার লোকজন এগিয়ে এলে মিন্টু পালিয়ে যায়। পরে এলাকাবাসীর সহায়তায় শিশুটিকে উদ্ধার করে সন্ধ্যায় ফরিদপুর মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নেয়া হয়। ৭ই এপ্রিল ব্রাহ্মণবাড়িয়ার কসবার ধর্মপুর গ্রামে ৬ষ্ঠ শ্রেণির এক স্কুলছাত্রীকে রাতভর ধর্ষণ শেষে ভোরে রাস্তায় ফেলে চলে যায় ধর্ষক ও তার সহযোগীরা। এ ঘটনায় ওইদিন সন্ধ্যায় কিশোরীর মা কসবা থানায় ধর্ষণের মামলা করেন। পুলিশ ওই কিশোরীর ব্রাহ্মণবাড়িয়া বিচারিক হাকিমের আদালতে ২২ ধারায় জবানবন্দি নেন। পরে তাকে ডাক্তারি পরীক্ষার জন্য ব্রাহ্মণবাড়িয়া সদর হাসপাতালে পাঠানো হয়। পুলিশ ও স্থানীয় সূত্র জানায়, কসবা সদরের একটি স্কুল ছুটি হওয়ার পর ৬ষ্ঠ শ্রেণিতে পড়ুয়া শিক্ষার্থী বাড়ি যাচ্ছিল। পথে ধর্মপুর গ্রামে আবদুর রশিদের ছেলে ফারুক মিয়া (২৮) একই গ্রামের শাহরিয়া এবং মিঠু পাঠানের সহযোগিতায় জোরপূর্বক অটোরিকশায় করে তাকে অজ্ঞাত স্থানে নিয়ে যায়। রাতে ফারুকের বাড়িতে এনে পুরনো একটি ঘরে আটকে রাতভর ধর্ষণ করে। স্কুল থেকে বাড়ি না ফেরায় বিকাল থেকে রাতভর বাড়ির লোকজন মেয়েটির সন্ধানে আত্মীয়স্বজনের বাড়িতে যোগাযোগ করেন শিক্ষার্থীর মা। পরদিন সোমবার সকালে ফারুক এবং তার সহযোগীরা মেয়েটিকে চলন্ত অটোরিকশা থেকে তার বাড়ির পাশে ফেলে চলে যায়। তার আর্তচিৎকার শুনে লোকজন তাকে উদ্ধার করে বাড়িতে নিয়ে যায়। শিশুটির মা ফারুকসহ তিনজনকে আসামি করে কসবা থানায় ধর্ষণের মামলা দায়ের করেন।সম্প্রতি শিশু নির্যাতন, ধর্ষণ, বলাৎকার, হত্যাসহ নানা ধরনের ঘটনা ঘটছে। এগুলোর বেশির ভাগই স্কুল, কলেজ, মাদ্‌রাসা, মসজিদ থেকে শুরু করে বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোতে হচ্ছে। এ বিষয়ে বিশেষজ্ঞরা আশঙ্কা প্রকাশ করেছেন। বিশেষজ্ঞদের মতে বিচারহীনতার সংস্কৃতির কারণে এগুলো বেশি হচ্ছে।  এ বিষয়ে অপরাধ বিজ্ঞানী তৌহিদুল হক মানবজমিনকে বলেন, সমসাময়িক সময়ে শিশু নির্যাতন বিশেষ করে শিক্ষার্থী নির্যাতন, অপহরণ, হত্যা, ধর্ষণ বেড়ে যাচ্ছে। এসব ঘটনার পেছনে দেশের প্রেক্ষাপটে মূলত তিন ধরনের কারণ আমরা দেখতে পাই। প্রথম কারন হচ্ছে, অতীতে এই ধরনের ঘটনার বিচার না হওয়ার সংস্কৃতি বা প্রবণতা। দ্বিতীয়ত, দেশে এই মুহূর্তে বিশেষ করে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোতে পরিচালনা কমিটিগুলোর অতি রাজনৈতিক প্রবণতা বা বৈচিত্র্য লক্ষণীয়। এই রাজনৈতিক প্রবণতার কারণে তারা একজন অসৎ ও চরিত্রহীন প্রিন্সিপালকে যেমন দায়িত্ব পালন করার সুযোগ দেয়। এর মধ্যে দিয়ে প্রিন্সিপালও পরিচালনা কমিটির অনেককেই বিভিন্ন ধরনের সুযোগ-সুবিধা দিয়ে থাকে। অপরাধমূলক এই মিউচুয়াল লেনদেন প্রক্রিয়ার কারণে এই সিন্ডিকেট গড়ে ওঠে। যে সিন্ডিকেট অপরাধীকে নিয়ন্ত্রণ করে এবং তার পক্ষে সাফাই গায়। তৃতীয়ত, এটি শুধুমাত্র বাংলাদেশে নয় বৈশ্বিকভাবে এর প্রভাব রয়েছে। বাংলাদেশ হিউম্যান রাইটস ফাউন্ডেশনের প্রধান নির্বাহী এডভোকেট এলিনা খান বলেন, শিশুরা এমনিতেই খুব অসহায়। তারা সবকিছু বলতে পারে না। আবার অনেক সময় তাদের প্রতিরোধক্ষমতা কম থাকে। এবং তাদের এই না পারার সুযোগটা নিয়ে থাকে অভিযুক্ত বা দোষী ব্যক্তিরা। ঘনবসতি এলাকাগুলোতে শিশুরা বেশি নির্যাতন বা এবিউজের শিকার হচ্ছে। এক্ষেত্রে শিশুর প্রতি যে আলাদা করে নজর দেয়া বা দেখা এটার সুযোগ থাকে না। শিশুদের প্রতি মানবিক মূল্যবোধ সম্পর্কে তারা খুব কম শেখে বা জানে। আমরা দেখেছি যে, খেটে খাওয়া ব্যক্তিদের সন্তানদের ওপর এই ধরনের শিশু নির্যাতন, ধর্ষণ, বলাৎকার ও হত্যা ইত্যাদি আগ্রাশন বেশি ঘটে। শিশুদের প্রতি মায়া, মমতা, স্নেহ ও ভালোবাসা কোথায় যেন চলে যাচ্ছে। এর কারণ হচ্ছে গুণগত মানের যে শিক্ষা সেটা আমরা পাচ্ছি না। মসজিদের ইমামদেরকে নিয়োগ দেয়ার সময় তাদের মানবিক মূল্যবোধ এবং শিক্ষার মাত্রার বিষয়টি সঠিকভাবে বিবেচনায় আনা হচ্ছে না। একইসঙ্গে আমাদের বেকারত্বের বিষয়টি এখানে জড়িত। কর্মহীন মানুষগুলো মোবাইল ফোন ও ইন্টারনেট ব্যবহার করে বিভিন্ন খারাপ জিনিস দেখে এ ধরনের কাজে তারা লিপ্ত হয়। যেটার ওপর কোনো সরকারি নিয়ন্ত্রণ নেই। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজবিজ্ঞান বিভাগের চেয়ারম্যান অধ্যাপক নেহাল করিম বলেছেন, এসব ঘটনা হঠাৎ করে বেড়েছে এটা বলা যাবে না। কারণ বিভিন্ন ধরনের ইলেকট্রনিক এবং প্রিন্ট মিডিয়ার কারণে এখন আমরা এসব বিষয়ে জানতে পারছি। এগুলো আগেও হয়েছে। এবং এই সমস্যা পৃথিবীব্যাপী। তবে এর সংখ্যাগত, ধরনগত এবং মানগত পার্থক্য রয়েছে। শিশু নির্যাতনের অন্যতম কারণ হচ্ছে তাদের নির্যাতন, জিম্মি, ধর্ষণ করলে সুবিধা অনেক। প্রথমত শুধুমাত্র কম খরচে দু’একটি লজেন্স বা লোভনীয় পণ্য দিয়ে শিশুদের প্রলোভন দেখিয়ে নির্যাতন করা সহজ। যারা এগুলো করে তারা বিকৃতরুচিসম্পন্ন এবং নিম্নশ্রেণির লোকজন। তাদের কোনো সংস্কৃতিবোধ, মার্জিতবোধ ইত্যাদি কাজ করে না। শিশুরা খুব আবেগপ্রবণ ও দুর্বল হওয়াতে অপরাধীরা খুব চটজলদি কাজ করতে পারে। কাজেই শিশুদের প্রতি এই নির্যাতনের জন্য দায়ী আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সীমাবদ্ধতা, রাজনৈতিক প্রভাব এবং আইন থাকা সত্ত্বেও প্রয়োগ না থাকায় এসব ঘটনা ঘটছে। এখন এসিড নিক্ষেপের ঘটনা হয় না। কারণ আইন এবং এর প্রয়োগ আছে বলে। অন্য কোনো ক্ষেত্রে ওভাবে আইন না থাকায় ঘটনাগুলো বেশি ঘটছে।
সম্পূর্ণ আর্টিকেলটি পড়ুন

ট্রেন্ডিং

সংবাদ সূত্র

News

The Largest News Aggregator
in Bengali Language

Email: [email protected]

Follow us