ইসমাঈল ফরাজি হত্যার তিন মাস পার হয়েছে। কিন্তু আজও কাউকে গ্রেপ্তার করতে পারেনি আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যরা। হত্যাকাণ্ডের পর তার পরিবারের সদস্যরা যাত্রাবাড়ী থানায় একটি হত্যা মামলা করে। প্রায় দুই মাস তদন্ত করে পুলিশ হত্যাকাণ্ডের কোনো ক্লু উদঘাটন করতে পারেনি। মামলাটি এখন মহানগর গোয়েন্দা পুলিশে (ডিবি) হস্তান্তর করা হয়েছে। এক মাস ধরে মামলাটি পড়ে আছে ডিবির কাছে। কিন্তু ডিবির তদন্তেও মামলার তেমনকোন অগ্রগতি নেই। যাত্রাবাড়ি থানার উপ পরিদর্শক বিলাল আল আজাদ গতকাল মানবজমিনকে বলেন, কিছু দিন মামলার তদন্ত আমি করেছি। তখন বেশ অগ্রগতি ছিল। নিহত ওই ব্যক্তির সঙ্গে যারা কাজ করত তাদের শনাক্ত করার চেষ্টা করেছি। তিনি কাজের জন্য কমলাপুর এলাকা থেকে শ্রমিক নিতেন। সর্বশেষ তার সঙ্গে যারা কাজ করেছে তারা এখন সেখান থেকে পালিয়ে গেছে। তাদের সম্পর্কে তেমন কোন তথ্য পাওয়া যাচ্ছে না। তিনি বলেন, ধারণা করছি ফার্নিচার ডেলিভারি দিয়ে গ্রাহকের কাছ থেকে পাওয়া টাকা ইসমাঈল ফরাজি নিজের কাছে রাখতেন। পরে সুবিধামত সময়ে মালিকদের কাছে পৌঁছে দিতেন। তার সহকর্মীরা সেই টাকার লোভেই তাকে হত্যা করেছে। চলতি বছরের ২২ জানুয়ারি উত্তর যাত্রাবাড়ির সুতিখাল পাড়ের ১/১ই ভাড়া বাসায় খুন হন ইসমাঈল ফরাজি। তিনি ব্যবসার পাশাপাশি নিজেই ভ্যান চালিয়ে ফার্নিচার পৌঁছে দিতেন গ্রাহকের বাসায়। নিহত এই ব্যক্তির স্ত্রী ছাড়াও দুই ছেলে রয়েছে। বড় ছেলে নাদিম ফরাজি ফাস্ট সিকিউরিটি ইসলামি ব্যাংকের অফিস সহকারি পদে চাকরি করছেন। ছোট ছেলে নাজমুল ফরাজি লেখাপড়া করছেন। তাদের গ্রামের বাড়ি গাজীপুরের কালীগঞ্জের বড়গাঁও গ্রামে। দীর্ঘ দিন তারা বাসা ভাড়া করে ঢাকায় থাকেন। নিহতের বড় ছেলে নাদিম ফরাজি মানবজমনিকে বলেন, ওই দিন আমি গুলশানের অফিস থেকে ডিউটি শেষ করে রাত আটটার দিকে বাসায় আসি। তালা খুলে বাসায় প্রবেশ করে দেখি ঘরের পর্দাগুলো নিচে পড়ে আছে আর পর্দার স্ট্যান্ডটি বাকানোভাবে রয়েছে। একটু সামনে গিয়ে দেখি আমার শোবার ঘরের পর্দাও এলোমেলো। তড়িঘড়ি করে তালা খুলে ছিটকিনিতে হাত দিয়ে দেখি সেটি বাকাঁনো। টান দিয়েও দরজা খুলতে পারছিলাম না। তাই রান্না ঘরে বটি আনতে যাই। কিন্তু বটি রাখার স্থানে বটি না পেয়ে আমার সন্দেহ বাড়তে থাকে। রান্না ঘর থেকে ফিরে আসার সময় দেখি ডাইনিং রুমে বটি পড়ে আছে। বটি এনে ছিটকিনি সোজা করে ঘরে প্রবেশ করে দেখি আমার ঘরের সবকিছু ঠিকঠাক আছে। নাদিম বলেন, ফের বাবার ঘরে গিয়ে দেখি বাবার নামাজের টুপিটা পড়ে আছে খাটের ওপর। সাধারনত এটি থাকে ওয়্যারড্রবের ভেতরে। জায়নামাজটা ওয়্যারড্রবের ওপরে এমনভাবে পড়ে আছে দেখে মনে হল কেউ নিচ থেকে ছুঁড়ে মেরেছে। সবকিছু ঠিকঠাক করে আমি ফ্রেশ হওয়ার জন্য ওয়াশরুমে যাবো। ঠিক তখনই আমার চোখ পড়ে খাটের নিচে। হঠাৎ দেখি খাটের নিচে একটি হাত দেখা যাচ্ছে। কোন কিছু না ভেবেই আমি হাত ধরে টান দেই। তারপরও দেখি খাটের নিচে বাবার মরদেহ পড়ে আছে। তারপর প্রতিবেশি ও আমার বন্ধুদের খবর দেই। তাদের সহযোগিতায় বাবার মরদেহ খাটের ওপরে তুলি। তিনি বলেন, বাবার গলায় শক্ত করে গামছা পেঁছানো ছিল। এছাড়া তিনি যেখানে টাকা রাখতেন সেখানে কোন টাকা পয়সা ছিল না। তালা ভেঙ্গে খুনীরা সব কিছু নিয়ে গেছে। তারপর খবর পেয়ে যাত্রাবাড়ি থানা পুলিশ, গোয়েন্দা পুলিশ ও র্যাব সদস্যরা সেখানে আসেন। মরদেহ নিয়ে ময়নাতদন্ত করানো হয়। ঘটনার রাতেই আমি যাত্রাবাড়ি থানায় অজ্ঞাতদের আসামি করে একটি হত্যা মামলা করি। নাদিম আরো বলেন, বাবা প্রতিদিন ভোরবেলা বাসা থেকে বের হয়ে যেতেন আর ফিরতেন গভীর রাতে। তার সঙ্গে আমার মাঝে মধ্যে দেখা হত। ঘটনার কয়েকদিন আগ থেকে তার সঙ্গে ১৩/১৪ বছর বয়সি একটা ছেলে ছিল। ওই ছেলেটি কাজ করে বাবার সঙ্গেই ঘুমাত। তবে ঘটনার দিন দুপুর ১২টার দিকে স্থানীয় একটি হোটেলে নাস্তা করার সময় ওই ছেলে ছাড়াও তার সঙ্গে আনুমানিক ১৯ বছর বয়াস আরেক ছেলে ছিল। তার শারীরিক ফিটনেসও বেশ ভালো ছিল বলে হোটেল কর্মচারিরা জানিয়েছে। নাদিম বলেন, ঘটনার দিন সকাল ৭টার দিকে আমার সঙ্গে বাবার শেষ কথা হয়। তিনি আমাকে ঘুম থেকে ডেকে তুলে বলেছিলেন আমি অফিসে যাবো কিনা, তিনি বের হচ্ছেন গেট যেন তালা দিয়ে দেই। তারপর আমি রেডি হয়ে অফিসে চলে যাই। দুপুরে আমার চাচা ওয়াদুদ ফরাজি আমাকে ফোন করে বলেন, তোর বাবার মোবাইল নম্বর বন্ধ পাওয়া যাচ্ছে আর কোন নম্বর আছে কিনা। তখন আমি বলি উনি একটাই নম্বর ব্যবহার করেন। এরপর আমি নিজেও তার মোবাইল ফোনে কল দিয়ে দেখি সেটি বন্ধ । ধারনা করে নেই চার্জ না থাকার কারনে হয়তো বন্ধ। মামলার তদন্ত সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, নিহত ইসমাঈল হোসেনের ব্যক্তিগত মোবাইল ফোনের কল লিস্ট পর্যালোচনা করে দেখা গেছে তিনি ওই দিন দুটি মোবাইল নম্বরে কথা বলেছেন। এই দুটি নম্বরের একটি হল এক ফার্নিচার ব্যবসার মালিক ও আরেকটি এক ম্যানেজারের। তাদের সঙ্গে যোগাযোগ করে জানা গেছে ইসমাঈলকে তারা ফোন করে বলেছিলেন কখন কাজে আসবে। তখন তিনি বলেছিলেন বাসায় গিয়ে নামাজ পড়ে বের হচ্ছি। তদন্ত কর্মকর্তারা আরও বলছেন, দুপুর ১টার মধ্যেই ইসমাঈলকে খুনীরা হত্যা করে টাকা পয়সা নিয়ে পালিয়ে গেছে।