আদিবাসী নারীকে কিছুতেই বোঝাতে পারছিলাম না, কোথা থেকে কীভাবে এলাম

মানবজমিন প্রকাশিত: ১১ ফেব্রুয়ারি ২০১৯, ০০:০০

দুই পাশে গহিন জঙ্গল। ঘুটঘুটে অন্ধকার। জন-মানবহীন। কখনো কখনো বন্য জীবজন্তুর ডাক। ভয়ঙ্কর। এরকম প্রতিকূল অবস্থাতেই জঙ্গলের ভেতরে কেটেছে তার ২৬ ঘণ্টা। তিনি  নাজমুন নাহার। বাংলাদেশি। লম্বা, স্লিম। পরনে জিন্সের প্যান্ট, টি-শার্ট। মাথায়-বুকে   লাল-সবুজের পতাকা। ঠোঁট-মুখে হাসি লেগেই আছে। এই অবস্থাতেই এশিয়া, ইউরোপ, আমেরিকা, আফ্রিকাসহ বিশ্বের প্রতিটি মহাদেশের ১২৫টি দেশে দেখা গেছে তাকে। বাংলাদেশের পতাকা, সংস্কৃতি, দেশকে বিশ্ববাসীর কাছে পৌঁছে দিতে বিরামহীন পথচলা তার। পাহাড়-পর্বত, জঙ্গল, সমতল, মরুভূমি, সমুদ্রে ছুটে চলেছেন তিনি। দেশের পতাকা নিয়ে বিশ্বভ্রমণ করে জুটছে ‘ফ্ল্যাগগার্ল’ তকমা। পরিব্রাজক হিসেবে ইতিমধ্যে জাতীয়-আন্তর্জাতিকভাবে আলোচনায় এসেছেন তিনি।১২৫তম দেশ হিসেবে তিনি ভ্রমণ করেন নাইজেরিয়া। তিনি বেশিরভাগ দেশই ভ্রমণ করেছেন সড়কপথে। একা একা। এ তালিকার মধ্যে রয়েছে পূর্ব আফ্রিকা, দক্ষিণ আফ্রিকা, পশ্চিম আফ্রিকা, দক্ষিণ আমেরিকা ও যুগোস্লাভিয়ার প্রতিটি দেশ। এছাড়াও সড়কপথে সফর করেছেন ইউরোপ ও এশিয়ার বেশিরভাগ দেশ। ভ্রমণ নিয়ে আছে সুখকর ও ভয়ঙ্করসহ নানা ধরনের অভিজ্ঞতা।ভ্রমণ করতে গিয়ে বারবার বিপদসঙ্কুল পথ পাড়ি দিয়েছেন। মৃত্যুর হাত ফসকে ফিরে এসেছেন। দীর্ঘ ২৬ ঘণ্টা পশ্চিম আফ্রিকার দেশ গিনির জঙ্গলে ছিলেন তিনি। যাচ্ছিলেন গিনি’র কোনাক্রিতে। সেখানকার গাড়িগুলো বেশ পুরনো, ব্যবহার অনুপযোগী। এরকম একটি গাড়িতে করেই যাচ্ছিলেন নাজমুন। গাড়িতে নয় জন যাত্রী। একমাত্র পর্যটক তিনি। উঁচু-নিচু পথ। গর্তে আটকে যায় গাড়ির চাকা। রাত তখন প্রায় তিনটা। হঠাৎ গাড়ি বন্ধ। ইঞ্জিনে সমস্যা। সরু রাস্তার দুই পাশে গভীর জঙ্গল। গাঢ় অন্ধকারে অন্য যাত্রীদেরও চেনা যাচ্ছিল না। কখনো কখনো বন্যপশুদের আওয়াজ ভেসে আসছিল। এরমধ্যেই খুঁজছিলেন যদিও কোথাও অন্তত একটা মানববসতি পাওয়া যায়। গাড়িতে আসা অচেনা মানুষদের সঙ্গে হাঁটছিলেন নাজমুন। শরীর তখন ক্লান্ত। দীর্ঘপথ হাঁটার পর একটি শনের ঘর দেখতে পান। খোলামেলা ওই ঘরে আশ্রয় নেন তিনি। সহ্য করতে হয়েছে মশা ও পোকামাকড়ের আক্রমণ। সকালে ঘরের মালিক এক বয়স্ক আদিবাসী নারী চমকে উঠেন তাকে দেখে। একে-অপরের ভাষা বুঝেন না। নাজমুন কিছুতেই বুঝাতে পারছিলেন না কোত্থেকে, কীভাবে এলেন। নানা কায়দায় শারীরিক ভাষা ব্যবহার করে তিনি বুঝাতে সক্ষম হন। ক্ষুধায় কাতর তিনি। পেট চোঁ চোঁ করছে। ওই নারী তাকে কাঁচা বাদাম খেতে দেন। সেখানে পানি সংকট। গাছ থেকে রসালো ফল এনে তা খেয়ে তৃষ্ণা মেটাতে চেষ্টা করেন। ঘুমানোর জন্য খাট নেই। দুই গাছের সঙ্গে দড়ি দিয়ে তৈরি জালের বিছানায় ঘুমানোর চেষ্টা করেন। নাজমুন জানান, জঙ্গলে কয়েক আদিবাসী পরিবারের বসতি ছাড়া আর কোনো ঘর নেই। দীর্ঘ ২৬ ঘণ্টা পর গাড়ি ঠিক হয়। ফোনে চার্জ নেই, যোগাযোগ না থাকায় হোটেল বুকিং নিঃসন্দেহে বাতিল। এবার আরো দুশ্চিন্তা। আবু মোহাম্মদ নামে এক যুবক তাকে আশ্রয় দেন বাড়িতে। মাটিতে একটা ছোট কাপড় বিছিয়ে থাকতে দেয়া হয় তাকে। কোনাক্রিতে তখন প্রচণ্ড গরম। মধ্যরাতে গরমে অসুস্থ হয়ে যান তিনি। নাজমুন বলেন, প্রচণ্ড হিটে মধ্যরাতে হার্ট এটাক হওয়ার মতো অবস্থা হয়েছিল। পশ্চিম আফ্রিকা ভ্রমণ না করলে আমার জানা হতো না মানুষের বেঁচে থাকার কঠিন বাস্তবতা। অনেক দুর্গম এলাকায় দেখেছি, রুগ্‌ন-ধুলোমাখা, পরনে কাপড় নেই, খাবারের অভাব, কিশোরীদের শরীরে এক টুকরো কাপড়। এসব দৃশ্য আমাকে কাঁদিয়েছে। আরো কাঁদিয়েছে যখন তাদের ইতিহাস জানতে পেরেছি। তাদের এক সময় জাহাজে করে বাক্সে ভরে কৃতদাস হিসেবে নিয়ে যাওয়া হতো বিভিন্ন দেশে, মরে গেলে জাহাজ থেকে ফেলে দেয়া হতো।  তারা কঠোর পরিশ্রম করে। আমি বুরকিনা ফ্রাসো, ঘানা, টোগো, বেনিনে দেখেছি অনেক মেয়েরা পেছনে বাচ্চাকে বেঁধে বাইক চালাচ্ছে। এসব দেখে দেখে মনের গভীর থেকে ভাবতে শিখছি আমরা সবাই এক পৃথিবীর অভিন্ন মানুষ। গত ১৩ই জানুয়ারি বিকাল ৫টায় বাদাগরি হয়ে সেমে বর্ডার ক্রস করে নাইজেরিয়ায় পৌঁছে বাংলাদেশের পতাকা উড়ান তিনি। নাজমুন বলেন, পনেরো দেশে সড়কপথে শত শত ঘণ্টার জার্নি একা একা। প্রচণ্ড গরম। ৪৮ ডিগ্রি তাপমাত্রায় পুড়েছি। এরমধ্যে কখন টানা ২৬ ঘণ্টা না খেয়ে ছিলাম। গহিন জঙ্গলের মধ্যে আদিবাসীদের সঙ্গে রাত্রি যাপন করেছি। খাবার হিসেবে কখনো ইয়াম আলু, কখন হোয়াইট অরেঞ্জ খেয়েছি। তিনি জানান, সিয়েরা লিওন থেকে লাইবেরিয়া আসার পথে ১১টি ভয়ঙ্কর কূপ পার হতে হয়েছে। রাস্তা কোথাও ভয়ঙ্কর উঁচু, খাড়া, কোথাও পিচ্ছিল, কোথাও ভয়ানক ধুলোমাখা, কোথাও রাস্তায় পড়ে থাকা গাছের ডালপালা সরিয়ে তবেই চলতে হয়েছে। সিয়েরা লিওনের বউ শহর থেকে বর্ডার শহর জেন্ডামা পর্যন্ত প্রায় ছয় ঘণ্টার এই পথের স্মৃতি নাজমুনের ভ্রমণযাত্রার ইতিহাসে ভিন্ন রকম অভিজ্ঞতা দিয়েছে বলে মনে করেন তিনি।ভ্রমণ করতে গিয়ে মরু ঝড়ের কবলে পড়েছিলেন নাজমুন। মৌরিতানিয়ার সাহারা মরুভূমিতে তপ্ত মরুঝড়ের কবলে পড়ে ধারালো বালির আঘাতে ক্ষতবিক্ষত হয়েছেন। সেনেগালের রোজ লেকে যাওয়ার পথে প্রত্যন্ত গ্রামাঞ্চলে পথ হারিয়েছিলেন। প্রায় তিন ঘণ্টা জঙ্গলের ভেতর দিয়ে হাঁটাহাঁটি করেছেন। এক ভয়ঙ্কর অভিজ্ঞতা। একইভাবে সেন্ট লুইতে একাকী পথ হারিয়ে অন্ধকারে আট কিলোমিটার পায়ে হেঁটে আবু নামক এক যুবকের সহযোগিতায় বাস স্টেশন খুঁজে পান তিনি। পরিব্রাজক এই নারী জানান, ছোটবেলায় দেখলেই ধরতে মন চাইতো। কিন্তু ধরতে চাইলেই পাখি উড়ে যেত। তখন আমার মনে হতো আমিও যদি এভাবে উড়তে পারতাম। তখন থেকেই আমার ইচ্ছা, আমি বিশ্ব ভ্রমণ করবো। ওই সময়ে মানচিত্র দেখতাম খুব। কোন দেশের সঙ্গে কোন দেশ লেগে আছে তা দেখতাম। কোথাকার মুদ্রার নাম কি, রাজধানীর নাম কি, দেখতে কেমন- এরকম নানা কৌতূহল কাজ করতো। তখন থেকেই বিশ্ব ভ্রমণের স্বপ্ন আমাকে পেয়ে বসে।২০০০ সালে ইন্ডিয়া ইন্টারন্যাশনাল অ্যাডভেঞ্চার প্রোগ্রামে অংশগ্রহণের মাধ্যমে তার প্রথম বিশ্বভ্রমণ শুরু। তখন তিনি ভারতের ভুপালের পাঁচমারিতে যান। এটিই তার জীবনের প্রথম বিদেশ ভ্রমণ। বিশ্বের আশিটি দেশের ছেলেমেয়ের সামনে তখন তিনি বাংলাদেশের জাতীয় পতাকা উত্তোলন করেন। সেই থেকে ফ্ল্যাগগার্লের যাত্রা শুরু। এরই ধারাবাহিকতায় ২০১৭ সালে ৯৩তম দেশ হিসেবে ভ্রমণ করেছেন নিউজিল্যান্ড। ২০১৬ ও ২০১৭ সালে টানা ঘুরেছেন ৩৫টি দেশ। ২০১৮ সালের এপ্রিল থেকে জুন পর্যন্ত ঘুরেছেন পূর্ব ও দক্ষিণ আফ্রিকার ১২টি দেশ। ২০১৮ সালের ১লা জুন পূর্ব আফ্রিকার জিম্বাবুয়েতে ভ্রমণ করে একশ’ দেশ ভ্রমণের মাইলফলক সৃষ্টি করেন। পতাকা হাতে নিয়ে জাম্বিয়ার সীমান্তবর্তী লিভিংস্টোনে অবস্থিত পৃথিবীর বিখ্যাত ভিক্টোরিয়া জলপ্রপাতের ব্রিজ দিয়ে হেঁটে জিম্বাবুয়েতে পৌঁছান নাজমুন। ওই বছরের অক্টোবরে ১১০তম দেশ হিসেবে ভ্রমণ করেন মধ্য এশিয়ার ইরান। নভেম্বর থেকে গত  জানুয়ারি পর্যন্ত সড়কপথে ঘুরেছেন পশ্চিম আফ্রিকার ১৫টি দেশ। এ তালিকায় যুক্ত হয়েছে সাহারা মরুভূমি ও উত্তর আটলান্টিকের পাশ ঘেঁষে যাওয়া সব দেশগুলো। ১৮ই নভেম্বর  সুইডেন থেকে আটলান্টিক মহাসাগরের দ্বীপ গ্রান্ড ক্যানারিয়া হয়ে  তিনি শুরু করেছিলেন মৌরিতানিয়া, সেনেগাল, গাম্বিয়া, মালি, গিনি বিসাও, গিনি কোনাক্রি, সিয়েরা লিওন, লাইবেরিয়া, আইভরিকোস্ট, বুরকিনা ফ্রাসো, গানা, টগো, বেনিন, নাইজার ও নাইজেরিয়া ভ্রমণের মাধ্যমে পৃথিবীর মানচিত্রের সবচেয়ে কঠিন পথযাত্রা। নাজমুন নাহার এবারের যাত্রা শুরু করেছেন পশ্চিম আফ্রিকার দেশ মৌরিতানিয়ার রাজধানী নোয়াকচট থেকে। শেষ করছেন নাইজেরিয়ার লাগোস শহরে। এর মাধ্যমে তার শেষ হলো পশ্চিম আফ্রিকার সাহারা মরুভূমি ও গোল্ড কোস্ট লাইনের প্রতিটি দেশ ভ্রমণ। বাংলাদেশের পতাকা বহন করে বিশ্বভ্রমণ করতে গিয়ে জুটেছে সম্মাননা। দেশপ্রেমের জন্য প্রশংসিত হয়েছেন সর্বত্র। জাম্বিয়া সরকারের গভর্নর হ্যারিয়েট কায়েনা আনুষ্ঠানিকভাবে নাজমুন নাহারকে ফ্ল্যাগগার্ল উপাধি দেন। ভ্রমণের অনুপ্রেরণা পেয়েছেন দাদা ও বাবার কাছ থেকেই। নাজমুন বলেন, সাহস পেয়েছি বাবার কাছ থেকেই। পরীক্ষায় খারাপ করলেও মাথা মুছে দিয়ে বলতেন পরের বার ভালো করবে, মন খারাপ করো না। প্রতিটি মুহূর্তে তার যত্ন, তার খেয়াল, তার উৎসাহ ছিল অনেক বেশি। তিনি অনেক গল্প শুনাতেন, সাফল্যময় মানুষের গল্প, বিভিন্ন দেশ ভ্রমণের গল্প। এছাড়াও আমার দাদা মৌলভী আহাম্মদ উল্লাহ ভ্রমণপিয়াসু মানুষ ছিলেন। তিনি আরবের অনেক দেশেই ভ্রমণ করেছেন ১৯২৬ থেকে ১৯৩১ সাল পর্যন্ত তিনি ঘোড়ায় চড়ে, জাহাজে করে ভ্রমণ করতেন। এছাড়াও দেশ-বিদেশের বিভিন্ন লেখকের ভ্রমণ সংক্রান্ত বই পাঠে অনুপ্রেরণা পান তিনি। তার আকর্ষণের বিষয় পৃথিবীর মানচিত্র। নাজমুন বিশ্ব ভ্রমণ করছেন। আর বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্তে তুলে ধরছেন বাংলাদেশ ও দেশের ইতিহাস-সংস্কৃতিকে। সমপ্রতি তিনি ঘানা ইন্টারন্যাশনাল মিশন স্কুল, গাম্বিয়ার সানায়াং আপার স্কুলসহ পশ্চিম আফ্রিকার বিভিন্ন দেশের ১৭টি স্কুলে শিক্ষার্থীদের সঙ্গে বাংলাদেশের ইতিহাস ও সংস্কৃতির কথা তুলে ধরেন।লক্ষ্মীপুর সদরের গঙ্গাপুরের ব্যবসায়ী মোহাম্মদ আমিন ও তাহেরা আমিনের আট সন্তানের মধ্যে সবার ছোট নাজমুন। তিনি লেখপাড়া করেছেন রাষ্ট্রবিজ্ঞানে, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে। পরবর্তীতে উচ্চ শিক্ষার জন্য যান সুইডেনে। এমনকি দক্ষিণ কোরিয়ায় মানবাধিকার বিষয়েও কোর্স করেছেন তিনি। তার পেশা গবেষণা। এ থেকে যা আয় হয় সবই ব্যয় করেন ভ্রমণে। পুরো বিশ্ব ভ্রমণ করে সর্বত্র বাংলাদেশের ইতিহাস ও সংস্কৃতি পৌঁছে দিতে চান প্রতিটি মানুষের কাছে।
সম্পূর্ণ আর্টিকেলটি পড়ুন

সংবাদ সূত্র

News

The Largest News Aggregator
in Bengali Language

Email: [email protected]

Follow us