প্রতিবাদের আরেক নাম মিজানুর রহমান। সুপেয় পানির দাবিতে ঢাকা ওয়াসা ভবনের সামনে দাঁড়িয়ে তার অভিনব প্রতিবাদ নজর কেড়েছে সবার। গোটা দেশে এখন তিনি প্রতিবাদের প্রতিচ্ছবি। তবে তার এ প্রতিবাদ নতুন নয়। এক দশক ধরে জুরাইনের মানুষের সুখ-দুখে নানা অধিকার আদায়ে নিজেকে বিলিয়ে দিয়েছেন তিনি। কখনো কখনো পরিবারসহ হাজির হয়েছেন মিছিলে-সমাবেশে। তাই মিজানুর রহমান জুরাইনবাসীর কাছে এক প্রতিবাদী কণ্ঠস্বর। শুধু জুরাইনের সুখ-দুঃখ নয়, বাংলাদেশের নানা সংকট, আন্দোলন-সংগ্রামে হাজির থাকেন মিজান। নিজে একা নন, প্রতিবাদের আওয়াজ তোলেন পরিবারের সদস্যদের নিয়ে। মিছিল, মানববন্ধন কিংবা লংমার্চের মতো নানা আয়োজনে স্ত্রী-কন্যাদের নিয়ে মানুষের কথা বলে যাচ্ছেন জুরাইনের মিজানুর রহমান। সুন্দরবন রক্ষার আন্দোলন, কোটা সংস্কার ও নিরাপদ সড়ক আন্দোলনেও সরব ছিলেন পঞ্চাশ ছুঁই ছুঁই মিজান। সুন্দরবন বাঁচাতে ২০১৭ সালে এক আন্দোলনে শিক্ষার্থীদের বাঁচাতে বুক পেতে দেন পুলিশের জল কামানের সামনে। সেবার পুলিশের লাঠিচার্জেরও শিকার হন তিনি। মাটিতে লুটিয়ে পড়া সেই ছবি ছড়িয়ে পড়ে দেশে-বিদেশে। ওই বছর যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক ‘মঙ্গাবে’ নামে পরিবেশবাদী সংগঠন ফলাও করে প্রচার করে মিজানুরের অদম্য কীর্তিগাঁথা। মঙ্গাবে’র সংবাদের পর সুইডেনের বিখ্যাত ম্যাগাজিন ‘রিপাবলিক’ তাকে জলবায়ু গেরিলা যোদ্ধা উপাধি দেয়। মিজানুর রহমানের ছবি ও পরিবেশ নিয়ে তার লড়াইয়ের গল্প ছাপা হয় বিশেষ নিবন্ধ আকারে। তবে সবকিছু ছাপিয়ে মিজানুর যেন জুরাইনেরই ছেলে, সেখানকার মানুষের সংকট-সম্ভাবনার সঙ্গী, আরেক ভরসার নাম। কয়েক বছর ধরে সেখানে বইমেলা আয়োজন, জলাবদ্ধতা নিরসন, রক্তদান কর্মসূচি কিংবা যে কোন বিপদে মানুষের পাশে দাঁড়ানোর তাড়না তার। সবশেষ গত ২৩ শে এপ্রিল নিজের এলাকার পানি সমস্যা নিয়ে রাজধানীর ওয়াসা ভবনে প্রতীকী শরবত পান করানোর উদ্যোক্তাও এই মিজান। স্ত্রী শামীমা হাশেম খুকি ও তিন বছরের কন্যা মৃন্ময়ী হাসিনাকে সঙ্গে নিয়ে সেদিন ওয়াসা ভবনে যান তিনি। সঙ্গে ছিলেন জুরাইনের আরো দুই বাসিন্দা। গতকাল সকালে জুরাইন এলাকায় কথা হয় তার সঙ্গে। সেখানকার কমিশনার রোডের মা মিষ্টান্ন ভাণ্ডার নামের একটি দোকান থেকে শুরু হয় আলাপ। নিজে ষষ্ঠ শ্রেণিতে পড়ার সময়ে ফিরে যান মিজানুর। ৮৮ সালের ভয়াবহ বন্যার ঠিক আগে আরো নিচু ছিল জুরাইন জনপদ। মূলত বুড়িগঙ্গা তীরের ফসলের জমি ভরাট করে গড়ে তোলা হয় আবাসন। জুরাইনের মানুষজনের কপালে তখন চিন্তার ভাঁজ। দেশজুড়ে বন্যা শুরু হয়েছে। ঢাকা-নারায়ণগঞ্জ-ডেমরা (ডিএনডি) বাঁধ পেরিয়ে পানি ঢুকে পড়লে সব বানের জলে ভেসে যাবে। সে সময় প্রথম বুড়িগঙ্গা সেতু বানানোর কাজ শুরু হচ্ছিল। বন্যার পানি রুখতে সেতুর জন্য রাখা বালু থেকে বস্তা ভরে বাঁধটিকে আরো উঁচু করা হয়। মিজানুর রহমানের স্বেচ্ছাসেবী কাজের শুরু ৮৮’র বন্যার সময় থেকে। ছোট-বড় অনেকের সঙ্গে এলাকায় বস্তা জোগাড় করা, বালু ভরা, বস্তাভর্তি ঠেলাগাড়ি ঠেলে বাঁধের কাছে নিয়ে যাওয়া। এটাই ছিল মিজানুর রহমানের জীবনের প্রথম স্বেচ্ছাসেবী কাজ, যে পথে এখনো হাঁটছেন। এক যুগ আগের আরেক স্মৃতিতে ফিরে যান তিনি। রাতের বেলা বাড়ির সামনের সড়কে বন্ধুদের কয়েকজনের সঙ্গে আলাপ চলছিল তার। এমন সময় ‘ছিনতাইকারী, ছিনতাইকারী, ভাই বাঁচান, বাঁচান’ বলে চিৎকার শুনতে পান। পূর্ব জুরাইন এলাকার আশরাফ মাস্টারের স্কুলের গলির দিকে দৌড়াতে শুরু করেন তিনি। কিন্তু সেখানে গিয়ে কাউকে খুঁজে পেলেন না। এরপর রাস্তায় ছোপ ছোপ রক্তের দাগ ধরে সামনে এগোন। একটি বাসার সামনে গিয়ে দেখেন ছিনতাইয়ের শিকার একটি ছেলে কাতরাচ্ছে। ছেলেটার হাত থেকে রক্ত ঝরছে তখনো। মোবাইল ফোন ও সঙ্গে থাকা তিন হাজার টাকা খোয়া গেছে। টাকার অভাবে হাসপাতালে না গিয়ে তিনি বাসায় চলে আসেন ছেলেটিকে নিয়ে। পরে এক বন্ধুকে সঙ্গে করে আহত ছেলেটিকে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ভর্তি করেন। ধার করে ওষুধ আর চিকিৎসার জন্য দুই হাজার টাকা পরিশোধ করেন মিজানুর রহমান। এরপর জুরাইনের মানুষের প্রতি তার ভালোবাসার কথা ছড়িয়ে পড়ে গোটা জুরাইনে। তাইতো জুরাইনবাসীর কাছে ‘মিজান ভাই’ যেন এক ভরসার নাম। মহল্লায় পানি নেই, তাঁর ডাক পড়ে। পাড়ায় ময়লার ভাগাড়ের দুর্গন্ধে প্রাণ যায়, মিজান ভাইয়ের কাছে চলো। কারো আত্মীয়ের জন্য রক্ত মিলছে না? কিংবা মধ্যরাতে কেউ অসুস্থ হয়ে পড়েছে, হাসপাতালে নিতে হবে। ভয় কী। মিজান ভাই আছে না? এলাকায় মাদকবিরোধী আন্দোলনে মিজানুরের অবদানও কম নয়। এ কারণে হামলা-মামলারও শিকার হতে হয়েছিল তাকে। জুরাইনের পানি সমস্যা নিয়েও সোচ্চার মিজানুর রহমান ও তার পরিবার। তিনি বলেন, শুধু আমার বাড়ির পানির সমস্যার জন্য এসব করছি না। জুরাইনের প্রতিটি মানুষের সুপেয় পানি পাবার অধিকার আছে। আমাদেরকে কেন সে অধিকার থেকে বঞ্চিত করা হচ্ছে আমি শুধু বার বার সেই প্রশ্নটি করার চেষ্টা করেছি। আলাপের এক ফাঁকে ২০১২ সালের একটি ভিডিও ফুটেজ দেখান তিনি। পানির সমস্যা নিরসনে সেবার নিজের দুই জমজ কন্যা প্রাপ্যতা ও পূর্ণতাকে নিয়ে জাতীয় প্রেসক্লাবের সামনে মানববন্ধনে দাঁড়ান মিজানুর। ওই বছর সাড়ে তিন হাজার মানুষের গণসাক্ষর ও পানির নমুনা ওয়াসাকে দিলেও এত বছরে কোন উদ্যোগ না নেয়ায় আক্ষেপ প্রকাশ করেন। নিজের পরিবার কখনো এমন কাণ্ডে বাধা দেয় না? হেসে ফেলেন তিনি। বলেন, আন্দোলনে-প্রতিবাদে পরিবারই আমার অনুপ্রেরণা। স্ত্রী ও তিন কন্যাকে নিয়ে মানুষের কথা বলার চেষ্টা করি। এ লড়াই আমার একার না, আমার পরিবারেরও। আমার কন্যাদেরও আমি এমন শিক্ষাই দিয়েছি। এবার শোনা যাক এলাকাবাসীর কথা- গাজী আলমগীর কামাল নামে একজন বলেন, ওয়াসার এমডি তাকে পাগল বলেছেন। আমিও বলছি, জুরাইনের সুখে-দুখে আমরা সব সময় এই পাগল মিজান ভাইকেই চাই। যে পাগল মানুষের অধিকারের দাবিতে সোচ্চার থাকে। তার মতো আরো অনেক পাগল দরকার আমাদের। একটি প্রকাশনা সংস্থায় কর্মরত সাগর ইসলাম বলেন, মিজান ভাইয়ের চাওয়া খুব কম। তিনি শুধু অধিকারগুলো ঠিকঠাক বুঝে নিতে চান। এখানেই যত আপত্তি। এসব করতে গিয়ে নিজের জন্য কিছু করতে পারেননি। বাবা আব্দুস সামাদের নামে থাকা বাড়ির ভাড়া থেকে সংসার চালান। স্ত্রী শামীমা হাশেম খুকি গৃহিনী। ঘর-সংসার সামলিয়ে স্বামীর সঙ্গেও মানুষের কাতারে দাঁড়ান। সাগর ইসলাম আরো জানান, গাড়িচালক থেকে শুরু করে নানা ধরনের কাজ করেছেন মিজান ভাই। কিন্তু তার নীতির গোঁড়ামির কারণে কোথাও স্থায়ী হতে পারেননি। ২০১০ সালের দিকে মোবাইল রিচার্জের ব্যবসাও শুরু করেন। সেসময় রিচার্জ করার জন্য প্রতি অঙ্কের বিনিময়ে অতিরিক্ত এক টাকা করে নিতেন ব্যবসায়ীরা। কিন্তু মিজান ভাই কখনো তা নেননি। উল্টো অন্য ব্যবসায়ীদের রোষানলে পড়েন। মুঠোফোন কোম্পানির এক ডিলার তার দেড় লাখ টাকা নিয়ে উধাও হয়ে গেলে সে ব্যবসায়ও ইতি টানেন মিজানুর রহমান। মিজানুর রহমানের জন্ম বেড়ে ওঠা রাজধানীর পূর্ব জুরাইনে। সাত ভাই- বোনের মধ্যে তিনি পঞ্চম। উচ্চ মাধ্যমিকের পর ইচ্ছা ছিল চারুকলায় পড়বেন। কিন্তু আর্থিক অনটনে তা আর সম্ভব হয়নি। বিশ্ব সাহিত্য কেন্দ্রে চলচ্চিত্র নিয়েও কোর্স করেছিলেন। সেটাও বেশি দূর এগোয়নি। এখন বয়স পঞ্চাশের কাছাকাছি। চুল-দাঁড়িতে পাক ধরেছে। এই বয়সেও তরুণদের নিয়ে বইমেলা, রক্তদান কর্মসূচি, জলাবদ্ধতা নিরসনসহ নানা সচেতনতামূলক কাজ করে যাচ্ছেন। সক্রিয়ভাবে অংশ নিচ্ছেন পরিবেশ রক্ষার নানা আন্দোলন-সংগ্রামে। এর মধ্যে ৫০ বারের বেশি সময় রক্ত দিয়েছেন। অন্যদেরও উৎসাহিত করছেন রক্তদানে। রক্ত দিতে গিয়ে কখনো কখনো নিজের গাঁটের পয়সা খরচ করে রোগির ভাড়াটাও দিয়ে এসেছেন। এসবেই আনন্দ খুঁজে পান মিজানুর রহমান। জুরাইনবাসীর প্রিয় ‘মিজান ভাই’ হয়ে থাকতে চান আজীবন। আর সবার জন্য রেখে যেতে চান এক মানবিক পৃথিবী। সুন্দর পৃথিবী।