সম্প্রতি ভিয়েতনামের নারী ধনকুবের ট্রুং মাই লানকে আর্থিক কেলেঙ্কারির কারণে মৃত্যুদণ্ড দিয়েছে দেশটির আদালত। ১১ বছর ধরে দেশটির বড় একটি ব্যাংক থেকে কোটি কোটি ডলার লুট করার দায়ে তাকে এ সাজা দেওয়া হয়। বলা হচ্ছে, এটিই বিশ্বের সবচেয়ে বড় ব্যাংক জালিয়াতির ঘটনা। আর এ বিচার ভিয়েতনামে অনুষ্ঠিত সবচেয়ে দর্শনীয় বিচার। আর্থিক খাতে জালিয়াতি নতুন কোনো ঘটনা নয়। ভারত, ইতালি, মেক্সিকো, আরব আমিরাতসহ অনেক দেশেই বিরাট বিরাট আর্থিক জালিয়াতির ঘটনা ঘটেছে। তবে ভিয়েতনামের ব্যাংক আর্থিক জালিয়াতির বিচার একটি অনন্য দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছে।
৬৮ বছর বয়সি ট্রুং মাই লান ভূমি-আবাসন ব্যবসায়ী এবং ভিয়েতনামের অন্যতম শীর্ষ ধনী। তার উত্থানের গল্পটি অনেকটাই সিনেমার কাহিনির সঙ্গে মিলে যায়। এক সময় মায়ের সঙ্গে হো চি মিন শহরের প্রাচীন মার্কেটে প্রসাধনীর ছোট্ট দোকান দিয়ে ট্রুং জীবন শুরু করেছিলেন। ধীরে ধীরে তার ছোট ব্যবসা বড় করেন। ১৯৮৬ সালে দেশটির কমিউনিস্ট পার্টি অর্থনৈতিক সংস্কার চালু করলে ট্রুং মাই লান শুরু করেন জমি ও আবাসন ব্যবসা। নব্বইয়ের দশকে বিভিন্ন হোটেল ও রেস্তোরাঁর একটি বড় অংশের মালিক বনে যান। ট্রুং ব্যবসার মাধ্যমে বিপুল আয় করতে থাকেন। রাষ্ট্রীয় বড় কর্মকর্তাদের সঙ্গে ব্যক্তিগত সম্পর্কের সুবিধা নিয়ে রাষ্ট্রীয় মালিকানাধীন জমি ব্যবহারের সুবিধা নেন ট্রুং। পরে তাকে তিনটি ছোট ব্যাংককে একটি বৃহত্তর সত্তায় একীভূত করার ব্যবস্থার অনুমতি দেয় সায়গন কমার্শিয়াল ব্যাংক।
চীনা ভিয়েতনামি পরিবারে জন্ম নেওয়া ট্রুং মাই লানের ভাগ্যের পরিবর্তন হতে শুরু করে হংকংয়ের বিনিয়োগকারী এরিক চুয়ের সঙ্গে পরিচয়ের পর। ১৯৯২ সালে তারা বিয়েও করেন। একই বছর ট্রুং চালু করেন আবাসন কোম্পানি ভ্যান থিন ফ্যাথ হোল্ডিংস। ২০১১ সালের মধ্যে হয়ে ওঠেন হো চি মিন সিটির প্রভাবশালী ব্যবসায়ী এবং ভিয়েতনামের শীর্ষ ধনীদের একজন, তবে ট্রুং ছিলেন অনেকটাই প্রচারবিমুখ। সে বছরই তিনি সায়গন কমার্শিয়াল ব্যাংকের সঙ্গে দুটি আর্থিক প্রতিষ্ঠানের একীভূতকরণ প্রক্রিয়ায় যুক্ত হন। এ প্রক্রিয়ার সমন্বয়কের দায়িত্বে ছিল খোদ দেশটির কেন্দ্রীয় ব্যাংক। এরপর থেকেই ট্রুং মাই লানের নাটকীয় উত্থানের শুরু।
এক দশকের বেশি সময় পর ভিয়েতনামের ফুলেফেঁপে ওঠা আবাসন খাত ধসে গেলে আর্থিক খাতে নানা প্রতারণার ঘটনা বেরিয়ে আসতে শুরু করে। করোনা মহামারির সময় ট্রুং মাই লানের ব্যবসায়িক অবস্থা খারাপ হতে থাকে। শেষ পর্যন্ত আর্থিক কেলেঙ্কারির দায়ে ২০২২ সালের অক্টোবরে তাকে গ্রেফতার করা হয়। তার বাসার বেজমেন্টে মেলে ৪ বিলিয়ন ডলার।
অর্থ আত্মসাতের ক্ষেত্রে ট্রুং মাই লান প্রচলিত ও জনপ্রিয় পথেই হেঁটেছেন। ভিয়েতনামের আইন অনুসারে, একজন ব্যক্তি ব্যাংকের সর্বোচ্চ ৫ শতাংশ শেয়ারের মালিকানা অর্জন করতে পারে। আইনানুসারে, কাগজে-কলমে ট্রুংও ছিলেন সায়গন কমার্শিয়াল ব্যাংকের ৫ শতাংশ শেয়ারের মালিক। ভিয়েতনামের আইনে কোনো ব্যাংকে ব্যক্তি বা পরিবারের ৫ শতাংশের বেশি শেয়ার থাকার ক্ষেত্রে বিধিনিষেধ রয়েছে। ক্ষমতার অপব্যবহার করে নিজের লোকদের ব্যবস্থাপক হিসাবে নিয়োগ দেন তিনি। সরকারি কৌঁসুলিরা বলছেন, পরোক্ষভাবে বেনামি কোম্পানির মাধ্যমে তিনি সায়গন কমার্শিয়াল ব্যাংকের ৯০ শতাংশের বেশি শেয়ার হাতিয়ে নিয়েছিলেন। ২০১১ সাল থেকে ১১ বছর ধরে নামসর্বস্ব প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে ঋণ ও নগদ হিসাবে তার এবং তার সহযোগীদের বিরুদ্ধে সায়গন কমার্শিয়াল ব্যাংক থেকে ৪৪ বিলিয়ন বা ৪ হাজার ৪০০ কোটি ডলার জালিয়াতির মাধ্যমে ঋণ নেওয়ার অভিযোগ আনা হয়েছে, যা তারা আত্মসাৎ করেছেন বলে অভিযোগ। এর মধ্যে অবশ্য ১ হাজার ২০০ কোটি বা ১২ বিলিয়ন ডলার আত্মসাতের ঘটনা প্রমাণ করতে পেরেছেন আইনজীবীরা।
আইনজীবীদের ভাষ্যমতে, ২০১৯ সালের ফেব্রুয়ারি থেকে তিন বছরের মধ্যে তিনি তার গাড়িচালককে দিয়ে ব্যাংক থেকে ৪০০ কোটি মার্কিন ডলার (১০৮ ট্রিলিয়ন ভিয়েতনামি ডং) তুলে তার বেজমেন্টে রাখার নির্দেশ দিয়েছিলেন। ভিয়েতনামের সবচেয়ে বড় অঙ্কের ব্যাংক নোটে এ পরিমাণ অর্থের ওজন দুই টন। অভিযোগ রয়েছে, ট্রুং যে ঋণ নিয়েছেন, তা কখনো যাচাই-বাছাই করা হয়নি। ঋণ নিয়ে অর্থ আত্মসাতের প্রক্রিয়াকে মসৃণ করতে ট্রুং মাই লান ব্যাংক কর্মকর্তা ও নিয়ন্ত্রক সংস্থার কর্মকর্তাদের বড় অংকের ঘুস দিতেন। তার বেআইনি কার্যক্রমের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা না নেওয়ার বিনিময়ে দেশটির কেন্দ্রীয় ব্যাংকের একজন সাবেক প্রধান পরিদর্শক ৫০ লাখ ডলার ঘুস নিয়েছিলেন বলে স্বীকারও করেন। তিনি ঘুস নেওয়ার অপরাধে যাবজ্জীবন কারাদণ্ডাদেশ পেয়েছেন।