দুনিয়ার সব সেরা ও সফল বেসরকারি বাণিজ্যিক ব্যাংকের বৈশিষ্ট্য হলো এগুলো পরিচালনা পর্ষদের সহযোগিতা, তদারকি ও নিরীক্ষণের মধ্যে থেকেও স্বাধীনভাবে কাজ করে। নির্দিষ্ট নিয়মানুসারে চলা এসব তদারকির মধ্যে কোনো অবাঞ্ছিত কিংবা অযৌক্তিক হস্তক্ষেপ হয় না। লব্ধপ্রতিষ্ঠ এসব আর্থিক প্রতিষ্ঠানের কৌশলগত এবং কার্যপ্রণালির প্রধান সিদ্ধান্তগুলো পরিচালনা পর্ষদ কর্তৃক উপযুক্ত নিরীক্ষা, পর্যালোচনা ও অধ্যবসায়ের পর চূড়ান্ত প্রয়োগ করা হয়।
নিবিড় পর্যবেক্ষণের পর দেখা গেছে, অনেক ব্যাংকের সফলতার পেছনে অনেক স্বাধীন পরিচালকের প্রধান ভূমিকা থাকে, যাঁরা কিনা ব্যক্তিগত স্বার্থের বাইরে থেকে ব্যাংকের উন্নতি ও অর্জনের কথা চিন্তা করে কাজ করেন। উদ্বেগের বিষয় হলো বাংলাদেশের বেশির ভাগ বাণিজ্যিক ব্যাংক স্বাধীন কিংবা স্বায়ত্তশাসিত নয়। পঞ্চাশের অধিক বাণিজ্যিক ব্যাংকের মধ্যে শুধু কিছুসংখ্যক ব্যাংক পরিচালনা পর্ষদ দ্বারা সঠিক দিকনির্দেশনা ও সহযোগিতায় আংশিকভাবে স্বায়ত্তশাসিত। বলা বাহুল্য, এই মুষ্টিমেয় ব্যাংকই দেশে সবচেয়ে সফল, দৃঢ় ও প্রশংসিত।
অন্যদিকে বাংলাদেশের ‘পরিচালনা পর্ষদ’ নিয়ন্ত্রিত ব্যাংকগুলো দৈনিক ভিত্তিতে তাদের দ্বারা চালিত; কিন্তু নীতি কার্যকর করার ক্ষেত্রে এখানে পরিচালনা পর্ষদের সঙ্গে ব্যবস্থাপনা পর্ষদের ভারসাম্য ও সমঝোতার অভাব রয়েছে। এই সমঝোতা ও ভারসাম্যের অভাবের কারণ হলো বাংলাদেশের বাণিজ্যিক ব্যাংকের পরিচালনা পর্ষদ অধিক কর্তৃত্বপরায়ণ। আমাদের বাণিজ্যিক ব্যাংকের পরিচালনা পর্ষদে সরাসরি তাদের মালিকানার সঙ্গে যুক্ত ব্যক্তি, রাজনৈতিক নেতৃস্থানীয় ব্যক্তি, এমনকি মালিকদের নিকটাত্মীয়রাও প্রভাবশালী হিসেবে পরিগণিত হন।
এ অবস্থার কারণে দেখা যায়, ব্যক্তিগত লাভের আশায় ব্যাংকের কার্যক্রম ও নীতি তৈরির ক্ষেত্রে প্রভাব খাটানো হয়। বলা যায়, অনেক সময় পুরো কার্যপ্রণালিই দূষিত হয়ে ভুল পথে ব্যাংকগুলো চালিত হয়। ব্যাংকের পরিচালকেরা নিজেরা স্বাধীন নন, উপরন্তু তাঁদের মাধ্যমেই নানা অনৈতিক হস্তক্ষেপ আসে। এই বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলোর প্রাথমিক পরিকাঠামোই ভুলভ্রান্তি ভরা হয়ে থাকে এবং নীতিতেও নানা জটিলতা তৈরি হয়।
বাণিজ্যিক ব্যাংক পরিচালনার ইতিহাসের ক্ষেত্রে মালিকানা কিংবা দলের সঙ্গে জড়িত ব্যক্তিদের চেয়ে নির্বাহী দায়িত্ব নিয়ে কাজ করা পরিচালকদের কাজ বেশি ফলপ্রসূ হয়েছে। ব্যাংকের সঙ্গে এসব পরিচালকের সরাসরি কোনো বিশেষ সম্পর্ক থাকে না এবং এ কারণে তাঁদের প্রাথমিক উদ্দেশ্য থাকে কাজের মাধ্যমে ব্যাংকের উন্নতি।
এই পদ্ধতিতে পরিচালকদের ব্যবসাসংক্রান্ত চিন্তা থেকে বের করে আনা হয়, যেন তাঁদের মুনাফা লাভের দৃষ্টিভঙ্গি ঠিক রেখে নতুন পরিকল্পনা, ধারণা তৈরি করেন এবং তা নিয়ম–শৃঙ্খলার মধ্য দিয়ে কাজে পরিণত করা সম্ভব হয়।
এই পদ্ধতি অনুসারে ব্যাংকের পরিচালক হওয়ার জন্য ব্যাংকিং খাতে তাঁর বহুদিনের অভিজ্ঞতা না থাকলেও এই খাত কীভাবে কাজ করে, সে সম্পর্কে সম্যক ধারণা থাকা প্রয়োজন। এ ছাড়া এই স্বাধীন পরিচালকেরা প্রয়োজনীয় বাস্তবসম্মত ধারণা ও প্রযুক্তিগত কাজগুলো অন্য কার্যনির্বাহী পরিচালকদের কাছ থেকে শিখে নিতে পারেন। কেননা একটি প্রতিষ্ঠানের নিয়ম, গঠন ও কার্যপদ্ধতি সম্পর্কে জানা প্রয়োজন।
আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো তাঁদের মানবিক গুণাবলিসম্পন্নও হতে হবে। কেননা এর মধ্য দিয়ে অন্য সদস্যদের যুক্তি বা দৃষ্টিভঙ্গি বুঝে কাজ করা সহজ হবে। এর পাশাপাশি বাইরের জগতের সঙ্গে ভালো যোগাযোগ বা পরিচয় থাকলে এ ধরনের পরিচালকেরা বাজার, শিল্প ও মানুষের মিশ্রণে বৈচিত্র্য সৃষ্টি করে প্রতিষ্ঠানকে আরও সংহত করতে সক্ষম হন। যেহেতু পরিচালকেরা ব্যাংকের সঙ্গে সম্বন্ধের বন্ধনে যুক্ত নন, তাই তাঁরা সহজেই নানা প্রশ্ন তুলতে, এমনকি সিদ্ধান্তকে চ্যালেঞ্জ করতে পারেন। যার ফলে একপক্ষীয় সিদ্ধান্ত নেওয়া যায় না কিংবা ভুলভ্রান্তির প্রতি যে প্রশ্ন ওঠে, তা শোধরানো যায়।