কেউ কেউ জুলাই বিপ্লবকে বিপ্লব না বলে প্রতিক্রিয়াশীল বিপ্লব বলতে আগ্রহী। যারা একে প্রতিক্রিয়াশীল বিপ্লব বলতে চান তাদের মধ্যে আবার দুটি পক্ষ রয়েছে। তারাও আবার দুটি ভিন্ন অবস্থান থেকে এ গণজাগরণের মধ্য দিয়ে গড়ে ওঠা নতুন রাজনৈতিক বন্দোবস্তের ফলে বর্তমান যে পরিবর্তন তাকে প্রতিক্রিয়াশীল বলতে আগ্রহী।
প্রতিক্রিয়াশীলতা বলতে বোঝায় পুরাতন রাজনৈতিক এবং সামাজিক ব্যবস্থা রাষ্ট্র ও সমাজে পুনঃস্থাপন করা। এ আকাঙ্ক্ষার অনুসারীরা মনে করেন, পুরাতন ব্যবস্থার মাঝে ইতিবাচক গুণাবলি রয়েছে, যা কিনা বর্তমান রাজনৈতিক এবং সামাজিক ব্যবস্থায় অনুপস্থিত। যারা এ বিপ্লবকে প্রতিক্রিয়াশীল বলতে চাচ্ছেন তাদের বক্তব্য হলো, এ বিপ্লবের মাধ্যমে পুরাতন রাজনৈতিক এবং সামাজিক বন্দোবস্ত ইন্তেজাম করবার পথ উন্মুক্ত হয়েছে।
জুলাই বিপ্লবকে প্রতিক্রিয়াশীল বলতে চাওয়া একটি পক্ষ হচ্ছে সদ্য ক্ষমতা থেকে উৎখাত হওয়া আওয়ামী লীগের নেতাকর্মী এবং তাদের দল থেকে নানাভাবে সুবিধাপ্রাপ্তরা। এদের আগ্রহ তাত্ত্বিক জায়গা থেকে বর্তমান বন্দোবস্তের সমালোচনা নয়— ক্ষমতা, প্রতিপত্তি, প্রভাব হারাবার বেদনার জায়গা থেকে সমালোচনা করা। ফলে তাদের সমালোচনার মূল লক্ষ্য হলো, সাবেকি বন্দোবস্ত ভেঙ্গে যাবার ফলে রাষ্ট্র এবং সমাজের প্রাধান্যবিস্তারী ভূমিকা থেকে উৎখাত হয়ে যাবার কারণে তারা যে রাজনৈতিক এবং অর্থনৈতিক প্রভাব হারিয়েছেন তা পুনরুদ্ধার।
রাজনৈতিক দায়বদ্ধতার চেয়ে তাদের মূল আগ্রহ রাজনৈতিক এবং সামাজিক প্রতিপত্তি; এবং তার সূত্র ধরে তাদের আমলে লুটপাটের ওপর ভিত্তি করে যে মাফিয়া পুঁজিবাদ গড়ে উঠেছে, ওই পুঁজিবাদ পরিচালনার কর্ণধার হয়ে আবার ফিরে আসা। এ ফিরে আসার প্রক্রিয়ায় প্রতিক্রিয়াশীল বিপ্লবের রাজনৈতিক তত্ত্ব তাদের কাছে একটি গুরুত্বপূর্ণ হাতিয়ার।
আওয়ামী লীগের বাইরে আরেকটি পক্ষ জুলাই বিপ্লবকে প্রতিক্রিয়াশীল বিপ্লব বলে মনে করছেন। এরা আওয়ামী লীগের শাসনকে ফ্যাসিবাদী শাসন বলে মনে করেন। সাড়ে পনের বছর এরা তাদের সাধ্য অনুযায়ী আওয়ামী লীগের বিরুদ্ধে সোচ্চার থেকেছেন, জুলাই বিপ্লবেও অংশ নিয়েছেন।
বিপ্লব সফল হওয়ার পর এদের অনেকে মনে করছেন— বিপ্লব পরবর্তী নতুন রাজনৈতিক বন্দোবস্ত, মধ্যযুগে ইউরোপে যে ধর্মতাত্ত্বিক-ধর্মভিত্তিক রাষ্ট্র কাঠামো এবং রাজনৈতিক ব্যবস্থা ছিল— ওরকম ধাঁচের একটি রাষ্ট্র, এবং রাজনৈতিক ও সামাজিক ব্যবস্থা গঠনের একটি নতুন রাজনৈতিক পরিসর বাংলাদেশে প্রথমবারের মতো তৈরি হয়েছে। বস্তুত এ জায়গাটিতে দাঁড়িয়ে তারা একে প্রতিক্রিয়াশীল বিপ্লব বলতে চান।
বিপ্লবকে এভাবে যারা মূল্যায়ন করছেন তাদের বড় অংশটি হচ্ছে ইউরোপজাত সেক্যুলার রাজনৈতিক চিন্তাধারার অধিকারী, বামপন্থীদের একটা উল্লেখযোগ্য অংশ এবং আওয়ামী রাজনীতির সমর্থক হলেও অন্ধ সমর্থক নয়। এরা নানাভাবে বিল্পবে সক্রিয় থেকেছেন। অবশ্য এদের আরেকটি অংশ মনে করেন, বিপ্লবের চরিত্র মূল্যায়ন করবার সময় এখনো আসেনি। এর জন্য জাতিকে আরও কিছুটা সময় অপেক্ষা করতে হবে।
এর বাইরে আরেকটি অংশ রয়েছে যারা ষড়যন্ত্র-তত্ত্বে বিশ্বাস করতে পছন্দ করেন। তারা এ আন্দোলন গড়ে ওঠা এবং পরিচালনার ক্ষেত্রে ছাত্র-জনতার ভূমিকা দেখেন না বা দেখতে চান না। তারা মনে করেন এ আন্দোলন গড়ে উঠেছে বাইরের দেশ; বিশেষত, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের অর্থ এবং প্রেসক্রিপশন অনুযায়ী।
এরা কল্পনা করতে পছন্দ করেন, যুক্তরাষ্ট্র বিশ্বরাজনীতিতে ঈশ্বরসম। তারা চাইলে তাদের নানাবিধ প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে বিশ্বের যে কোনো স্থানে যে কোনো পরিবর্তন ঘটাতে পারে। এমনকি গণআন্দোলন, বিল্পবও তারা গড়ে তুলতে পারে।