‘দাম দিয়ে কিনেছি বাংলা/কারোর দানে পাওয়া নয়।/দাম দিছি প্রাণ লক্ষ কোটি/জানা আছে জগৎময়।’ একটি নয় দুটি নয় লাখ লাখ প্রাণের বিনিময়ে অর্জিত হয়েছে আমাদের স্বাধীনতা। ১৬ ডিসেম্বর আমাদের জাতীয় জীবনের শ্রেষ্ঠ অর্জন। ১৯৭১ সালের এই দিনে আমাদের গৌরবোজ্জ্বল মুক্তিযুদ্ধের আনুষ্ঠানিক সমাপ্তি ঘটেছিল। ২৫ মার্চ গভীর রাতে পাকিস্তানি বাহিনী অতর্কিতে বাঙালি জাতির ওপর সশস্ত্র আক্রমণ শুরু করলে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান স্বাধীনতা ঘোষণা করে প্রতিরোধ যুদ্ধের ডাক দেন। তবে সলতে পাকানোর কাজটি চলছিল আগে থেকেই। পাকিস্তানি রাষ্ট্র কাঠামোর মধ্যে যে বাঙালি জাতি অধিকার ও মর্যাদা নিয়ে বসবাস করতে পারবে না– এটা পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার পরই বোঝা গিয়েছিল। শুরু হয়েছিল বাঙালির মুক্তি আন্দোলন সংঘটনের নানামুখী তৎপরতা। এরই ধারাবাহিকতায় ১৯৭০ সালে পাকিস্তানের প্রথম সাধারণ নির্বাচনে মুসলিম লীগের ভরাডুবি ঘটে।
ওই নির্বাচনে আওয়ামী লীগের বিপুল বিজয় পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠীর বুকে কাঁপন ধরিয়ে দিয়েছিল। বাঙালির হাতে ক্ষমতা হস্তান্তরে তাদের অনীহা ছিল। তাই তারা নির্বাচনের পর শুরু করেছিল প্রাসাদ ষড়যন্ত্র। ১৯৭১ সালের ১ মার্চ পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খান আকস্মিকভাবে সংসদ অধিবেশন স্থগিত ঘোষণা করার সঙ্গে সঙ্গে বাঙালি জাতি বিক্ষুব্ধ হয়ে ওঠে। রাস্তায় বেরিয়ে আসে। বীর বাঙালি অস্ত্র ধরো বাংলাদেশ স্বাধীন করো, ইয়াহিয়ার মুখে লাথি মারো বাংলাদেশ স্বাধীন করো ইত্যাদি স্লোগান ধ্বণিত হয় মানুষের মুখে মুখে। শুধু ঢাকা নয়, প্রত্যন্ত অঞ্চলের মানুষও বেরিয়ে আসে পথে। ১ মার্চ সংসদ অধিবেশন স্থগিত করে ইয়াহিয়া খান আগুনে ঘি ঢালেন। শুরু হয় অসহযোগ আন্দোলন।
মার্চ মাসের পঁচিশ তারিখ পাকিস্তানি বাহিনী রাতের অন্ধকারে ঝাঁপিয়ে পড়ে বাঙালি জাতির ওপর। শুরু হয় যুদ্ধ, স্বাধীনতার যুদ্ধ। নিরস্ত্র বাঙালি জাতি পাকিস্তানি সামরিক বাহিনীর সশস্ত্র আক্রমণের মুখে যার যা কিছু আছে তা-ই নিয়ে যোদ্ধায় পরিণত হয়েছিল। তারপর নয় মাস জুড়ে বাঙালি জাতি রচনা করেছিল এক নতুন ইতিহাস ।
১০ এপ্রিল ভারতের (আগরতলায়) মক্তিযুদ্ধের সূচনালগ্নে গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশের প্রবাসী সরকার গঠিত হয়। এ সরকারই ১৭ এপ্রিল মেহেরপুরের বৈদ্যনাথতলায় প্রকাশ্যে আনুষ্ঠানিক শপথ গ্রহণ করেন এবং 'মুজিবনগর সরকার' হিসেবে পরিচিতি লাভ করে। শপথ অনুষ্ঠানে স্বাধীনতার ঘোষণা পাঠ করা হয় এবং পাকিস্তানি সৈন্যদের বাংলাদেশ থেকে চিরতরে নির্মূল করার অঙ্গীকার করা হয়। অনুষ্ঠানে উপরাষ্ট্রপতি সৈয়দ নজরুল ইসলামকে ভারপ্রাপ্ত রাষ্ট্রপতি, তাজউদ্দীন আহমদকে প্রধানমন্ত্রী ঘোষণা করা হয়। প্রবাসে অবস্থান করে এ সরকার মুক্তিযুদ্ধে দিকনির্দেশনা প্রদান করে থাকে। যুদ্ধের সশস্ত্রবাহিনীর নামকরণ করা হয় মুক্তিবাহিনী এবং এর প্রধান সেনাপতি নিযুক্ত হন কর্নেল এম এ জি ওসমানী।
সরকার গঠনের পর থেকে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর আক্রমণ বেড়ে যাওয়ায় বাধ্য হয়েই এই সরকারের কার্যক্রম পরিচালনা করতে হয় কলকাতা থেকে। এই সরকারকে অনেকেই প্রবাসী সরকার, অস্থায়ী সরকার কিংবা বিপ্লবী সরকার বলেও ডাকে। স্বাধীনতাকামী বাঙালির আন্দোলনকে পাকিস্তান সরকার বৈশ্বিক পরিমণ্ডলে বিচ্ছিন্নতাবাদী আন্দোলন বলে যে প্রচার করছিল তাতে পানি ঢেলে দেয় নতুন এই সরকার।
একাত্তরের নভেম্বরের শেষ দিকেই এটা স্পষ্ট হয়ে উঠছিল যে পাকিস্তানি বাহিনীর চূড়ান্ত পরাজয় সময়ের ব্যাপার মাত্র। মুক্তিবাহিনীর আক্রমণ প্রবল হচ্ছিল। চারদিক থেকে আক্রান্ত হয়ে তাদের নাস্তানাবুদ অবস্থা। তারা ঘাঁটি রক্ষা করতে পারছিল না। পিছু হটছিল। মুক্তাঞ্চলের পরিমাণ বাড়ছিল। প্রবাসী সরকারের নেতৃত্বেই বাংলাদেশ পাকিস্থানি বাহিনীকে পরাজিত করে স্বাধীনতাকামী মানুষ বিজয় ছিনিয়ে আনে।
একাত্তরে যারা পরাজিত হয়েছিল তাদের একটি রাজনৈতিক দর্শন ছিল। তারা ছিল গণবিরোধী, শোষক, ধর্মান্ধ-সাম্প্রদায়িক এবং স্বৈরাচারী। আমরা বিজয়ী হয়েছিলাম এসব থেকে মুক্ত হওয়ার জন্যই। আমাদের যুদ্ধ ছিল স্বাধীনতার, মুক্তির। একটি নির্দিষ্ট ভূখণ্ড, একটি জাতীয় সঙ্গীত, জাতীয় পতাকার সঙ্গে আমরা সেদিন শোষণ-বঞ্চনা-বৈষম্য থেকেও মুক্তি চেয়েছিলাম।
১৬ ডিসেম্বর পাকিস্তানিদের পরাজয়ে আমাদের স্বাধীনতা নিশ্চিত হয়েছিল। কিন্তু মুক্তি কি পেয়েছিলাম? বৈষম্য কি কমেছে? একথা ঠিক, গত যে ৫৩ বছরে আমরা এগিয়েছি অনেক। সামাজিক অগ্রগতির নানা সূচকে আমরা প্রতিবেশী অনেক দেশের চেয়ে এগিয়ে। তবে দেশে এখনো রাজনৈতিক স্থিরতা আসেনি। রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে গণতন্ত্র চর্চার মানসিকতা তৈরি হয়নি। দুর্নীতিবাজ লুটপাটকারীদের দৌরাত্ম্য নিয়ন্ত্রণ করা যায়নি। দেশে ধনবৈষম্যও প্রকট হয়েছে। কোটিপতির সংখ্যা বেড়েছে। সব মানুষের জন্য সমান নিরাপদ ব্যবস্থা নিশ্চিত করা যায়নি। সমতাভিত্তিক সমাজের স্বপ্ন এখনও পূরণ হয়নি।