সহায়তার অপর নাম কি নিজস্বার্থ?

যুগান্তর এ কে এম শামসুদ্দিন প্রকাশিত: ১৬ ডিসেম্বর ২০২৪, ১১:০৮

বাঙালি জাতির ইতিহাসে সবচেয়ে গৌরবোজ্জ্বল ঘটনা ছিল বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ। এ যুদ্ধের স্থায়িত্বকাল অল্পদিনের হলেও ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ ছিল ব্যাপক। লাখো শহিদের প্রাণের বিনিময়ে বাংলাদেশের স্বাধীনতা অর্জন ছিল বিশ্ব ইতিহাসের এক বিরল ঘটনা। একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধ ছিল একান্ত বাঙালির স্বাধিকার আদায়ের যুদ্ধ। নয় মাস ধরে প্রতিকূল পরিস্থিতিতে নানা সীমাবদ্ধতার মধ্যেও দখলদার পাকিস্তানি বাহিনীর বিরুদ্ধে লড়াই চালিয়ে গেছে তারা। সর্বোচ্চ আত্মত্যাগের মাধ্যমে শেষ পর্যন্ত বাঙালি এ দেশকে শত্রুমুক্ত করেছিল; ছিনিয়ে এনেছিল বহুল আকাঙ্ক্ষিত গৌরবোজ্জ্বল স্বাধীনতা। আমাদের স্বাধীনতা যুদ্ধে ভারতের অবদান ছিল অপরিসীম। সে সময় ভারত বেশ গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছিল। ভারত শুধু যে শরণার্থীদের আশ্রয় দিয়েছিল তা নয়, মুক্তিযোদ্ধাদের ট্রেনিং দিয়েছে, অস্ত্র দিয়েছে, অর্থ দিয়েছে। বাংলাদেশের স্বাধীনতার পক্ষে আন্তর্জাতিক মহলে কূটনৈতিক সাপোর্টও দিয়েছে। এমনকি মুক্তিযোদ্ধাদের পাশাপাশি দাঁড়িয়ে যুদ্ধও করেছে। বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধে ভারতের তিন সহস্রাধিক সেনাসদস্য নিজেদের জীবন বিসর্জনও দিয়েছেন। একথা সত্য, ভারতের সহযোগিতা ছাড়া স্বাধীনতা অর্জন করা আরও কঠিন হতো। বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধে ভারতের অবদানের কথা আমরা কৃতজ্ঞতার সঙ্গে স্মরণ করি; কিন্তু মুক্তিযুদ্ধে ভারতের ভূমিকা নিয়ে ভারত ও বাংলাদেশের দৃষ্টিভঙ্গির মধ্যে পার্থক্য রয়েছে। একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধকে আমরা বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ মনে করলেও ভারত তা মনে করে না। ভারত এ যুদ্ধকে স্রেফ ‘পাক-ভারত যুদ্ধ’ মনে করে। তাদের বক্তব্য ও বিবৃতিতে, সভা-সেমিনারে, লেখায়, আনুষ্ঠানিক অথবা অনানুষ্ঠানিক অনুষ্ঠানে মুক্তিযোদ্ধাদের বীরত্বগাথার কথা খুব কমই উল্লেখ থাকে।


নয় মাসব্যাপী মুক্তিযোদ্ধাদের চোরাগোপ্তা হামলা, রেইড-অ্যাম্বুশ এবং সরাসরি সম্মুখযুদ্ধে পাকিস্তান হানাদার বাহিনী যখন পর্যুদস্ত, অস্ত্র ও গোলাবারুদের স্বল্পতার জন্য যখন তারা দিশেহারা, বিভিন্ন সেক্টরে অকুতোভয় বীর মুক্তিযোদ্ধাদের হাতে মার খেতে খেতে যখন একেবারেই কোণঠাসা, পরাজয়ের শেষ সীমায় যখন উপনীত, তখন ভারতীয় বাহিনী যুদ্ধের ময়দানে বীর মুক্তিযোদ্ধাদের সঙ্গে ঘাঁট বেঁধে যৌথ অভিযান চালায়। ফলে পাকিস্তানিরা পরাভূত হয়। নয় মাসের এত রক্তক্ষয়ী মুক্তিযুদ্ধ, ৩০ লাখ শহিদের সর্বোচ্চ আত্মত্যাগ, আড়াই লাখ মা-বোনের আত্মত্যাগের বিষয়কে অস্বীকার করে ভারতের সমরবিদরা যখন আমাদের এ মহান মুক্তিযুদ্ধে বাঙালির কৃতিত্বকে খাটো করে, স্রেফ ‘১২ দিনে পাক-ভারত যুদ্ধ’ বলে চালিয়ে দিতে চায়, তখন প্রবলভাবে প্রতিবাদ তো হবেই। ভারতের এমন আচরণ মুক্তিযোদ্ধাদের অবদানকে অস্বীকার করারই শামিল। স্বাধীনতার পর থেকেই ভারত এ কাজটি করে আসছে। একাত্তরের ঐতিহাসিক ঘটনার ওপর রচিত ভারতের সরকারি দলিলপত্রে, স্কুল-কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ের পাঠ্যবইয়ে, গল্প-নাটক-উপন্যাসে, চলচ্চিত্র ও থিয়েটারে মুক্তিযুদ্ধ বলে কিছু নেই। সেখানে মুক্তিযুদ্ধের স্থলে ‘দ্বিতীয় ভারত-পাকিস্তান যুদ্ধ’ উল্লেখ আছে। এ প্রসঙ্গে দুটো ঘটনার কথা উল্লেখ করতে চাই। ২০১৭ সালে বাংলাদেশে বিজয় দিবস উদ্যাপনের ধারাবাহিক অনুষ্ঠানের অংশ হিসাবে ১৫ ডিসেম্বর ঢাকার এক অনুষ্ঠানে ভারতীয় সেনাবাহিনীর একজন অবসরপ্রাপ্ত কর্মকর্তা একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধকে ভারত-পাকিস্তান যুদ্ধ বলে মন্তব্য করেছিলেন। ওই কর্মকর্তার লেখা ‘১২ দিনের ভারত-পাকিস্তান যুদ্ধ’ শীর্ষক একটি বইয়ের মোড়কও উন্মোচন হয়। ভারতীয় ওই সেনা কর্মকর্তার বইয়ের নাম ও বক্তব্য নিয়ে সেদিন বেশ বিতর্কের সৃষ্টি হয়েছিল। অনুষ্ঠানে উপস্থিত মুক্তিযোদ্ধারা ভারতীয় ওই সেনা কর্মকর্তার মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে এমন মনোভাবে অসন্তোষ প্রকাশ করেছিলেন। ঠিক তার পরদিন ১৬ ডিসেম্বর, কলকাতায় বিজয় দিবস উদ্যাপন অনুষ্ঠানে বাংলাদেশের গণমাধ্যম প্রতিনিধিরা উল্লেখিত বিতর্কের বিষয়ে ভারতীয় সেনাবাহিনীর ইস্টার্ন কমান্ড হেডকোয়ার্টারের কমান্ডার লেফটেন্যান্ট জেনারেল অভয় কৃষ্ণের দৃষ্টি আকর্ষণ করলে তিনি দায়সারাভাবে বলেছিলেন, ‘অবশ্যই ভারত-পাকিস্তানের মধ্যে যুদ্ধ হয়েছিল, তাতে মুক্তিযোদ্ধারাও অংশ নিয়েছিল।’ অথচ ২০০৫ সালে মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক এক অনুষ্ঠানে একই কথা তারা ভাবে ভঙ্গিতে বলার চেষ্টা করেছিলেন। বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের গবেষক, লেখক ও সাহসী বীর মুক্তিযোদ্ধা মেজর কামরুল হাসান ভুঁইয়া সেদিন ওই অনুষ্ঠানেই প্রতিবাদ করে তাদের দুঃখ প্রকাশ করাতে বাধ্য করেছিলেন।



আমরা প্রায়ই শুনতে পাই, ভারত নিঃস্বার্থভাবে মুক্তিযুদ্ধে বাংলাদেশকে সাহায্য করেছে। এ কথা শুধু ভারতীয়দের মুখেই শোনা যায়নি, গত ১৬ বছর ধরে বিগত পতিত সরকারও নানাভাবে আমাদের শুনিয়ে এসেছে। বিশেষ করে আওয়ামী লীগ সভাপতি শেখ হাসিনা থেকে শুরু করে বিভিন্ন পর্যায়ের নেতাকর্মীর মুখে এসব কথা শোনা যেত। বিভিন্ন সভা-সেমিনারে আওয়ামী ঘরানার সরকারি কর্মকর্তা ও পদলেহনকারী তথাকথিত সুশীল সমাজ ও বুদ্ধিজীবীরাও এ বিষয়ে পিছিয়ে ছিলেন না। শিশুতোষ পাঠ্যবই থেকে শুরু করে শিক্ষাব্যবস্থার বিভিন্ন স্তরে আমাদের নতুন প্রজন্মকেও তাই বোঝানোর চেষ্টা হয়েছে। ভারত কোনো স্বার্থ ছাড়াই মুক্তিযুদ্ধে সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দিয়েছে যদি বলা হয়, তাহলে তা হবে ইতিহাসের অনিবার্য সত্যের অপলাপ। একাত্তরে বাঙালি ও বাংলাদেশকে সাহায্যের পেছনে কী স্বার্থ ছিল, তা ভারতও জানে; কিন্তু তারা কোনোদিনও স্বীকার করবে না। স্বার্থ তাদের থাকতেই পারে। তা নিয়ে আপত্তি নেই। আপত্তি তখনই ওঠে, যখন তা অস্বীকার করা হয়। ইতিহাসের সত্যকে অস্বীকার করা যায় না বা করা উচিতও নয়। বাংলাদেশের সঠিক ইতিহাস আমাদের এ প্রজন্মকে জানাতে হবে। জানাতে হবে একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধ পেছনের দীর্ঘ ইতিহাস।


১৯৪৭ সালে পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার পর থেকেই পূর্ব পাকিস্তানকে আলাদা করার প্রচেষ্টা থাকলেও ১৯৬২ সালে চীন-ভারত সীমান্ত যুদ্ধে অনুরোধ করা সত্ত্বেও সাড়া না দেওয়ায় নাখোশ হয়ে পাকিস্তান ভেঙে তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানকে পশ্চিম পাকিস্তান থেকে বিচ্ছিন্ন করার পরিকল্পনা হাতে নেয় ভারত। নেহেরু ভারতীয় কেন্দ্রীয় গোয়েন্দা সংস্থাকে এ বিষয়ে কাজ শুরু করার নির্দেশ দেন। এর কিছুদিনের মধ্যেই ‘স্বাধীন বাংলা বিপ্লবী পরিষদ’ নামে একটি গোপন সংগঠনের অস্তিত্বের খবর পাওয়া যায়। এ গোপন সংগঠনটি পাকিস্তান থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে পূর্ব পাকিস্তানকে একটি পৃথক রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার উদ্দেশ্যে সংগঠিত হয়। চিত্তরঞ্জন সুতার ও ড. কালিদাস বৈদ্য নামে দুজন রাজনীতিবিদ এ গোপন সংগঠনের পক্ষে ভারতীয় কেন্দ্রীয় গোয়েন্দা সংস্থার সঙ্গে যোগাযোগ রক্ষা করতেন। তারা উভয়েই বাংলাদেশের পিরোজপুর জেলার অধিবাসী। চিত্তরঞ্জন ছিলেন ১৯৭০ ও ১৯৭৩ সালের সাধারণ নির্বাচনে আওয়ামী লীগের টিকিটে নির্বাচিত সংসদ-সদস্য। ১৯৭৫ সালের রাজনৈতিক পটপরিবর্তনের পর তিনি ভারত চলে যান এবং কালিদাস বৈদ্যকে সঙ্গী করে ভারতের মাটিতে বসেই বাংলাদেশকে দ্বিখণ্ডিত করে তথাকথিত ‘স্বাধীন বঙ্গভূমি’ প্রতিষ্ঠায় তৎপরতা চালান।


বাংলাদেশের বিশিষ্ট সাংবাদিক ও মুক্তিযুদ্ধের গবেষক আফসান চৌধুরী রচিত ‘বাংলাদেশের স্বাধীনতা আন্দোলন ধারাবাহিকতার ইতিহাস,’ মহিউদ্দিন আহমেদ রচিত ‘প্রতিনায়ক’ এবং আবদুল আজিজ বাগমার রচিত ‘স্বাধীনতার স্বপ্ন উন্মেষ ও অর্জন’ ইত্যাদি বইয়ে চল্লিশ দশক থেকেই পূর্ব পাকিস্তানকে স্বাধীন করার লক্ষ্যে নানা কার্যক্রম ও তৎপরতা শুরুর তথ্য পাওয়া যায়। এরই মধ্যে ‘ইনার গ্রুপ’ অন্যতম। রাজনীতিবিদ ও সংগঠক মোয়াজ্জেম আহমেদ চৌধুরী, আবদুল আজিজ বাগমার, সাংবাদিক ফয়েজ আহমেদ, কূটনীতিবিদ কামরুদ্দীন আহমেদ এবং রুহুল কুদ্দুস মিলে ‘ইনার গ্রুপ’ গড়ে তোলেন। ভারতীয় দূতাবাস ইনার গ্রুপের সদস্যদের সঙ্গে সার্বক্ষণিক যোগাযোগ রাখত। এমনকি ইনার গ্রুপের কয়েকজন সদস্য কলকাতায় গিয়ে ভারতীয় গোয়েন্দাদের সঙ্গে একাধিকবার বৈঠকও করেন। একই সময়ে আওয়ামী লীগের কয়েকজন নেতার উদ্যোগে তৎকালীন ময়মনসিংহের জামালপুর মহকুমায় গঠিত হয় ‘ইস্ট বেঙ্গল লিবারেশন ফ্রন্ট’। তারা ভারতের সাহায্যে সশস্ত্র সংগ্রামের মাধ্যমে দেশ স্বাধীন করতে চেয়েছিলেন। এ ব্যাপারে আলোচনা করতে ফ্রন্টের নেতারা ভারতের তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী নেহেরুর সঙ্গে সাক্ষাৎও করেছিলেন। শেখ মুজিবও একই উদ্দেশ্যে ১৯৬২-৬৩ সালে গোপনে আগরতলা গমন করে ত্রিপুরার মুখ্যমন্ত্রী শচীন্দ্র লাল সিংহের মাধ্যমে নেহেরুর সঙ্গে যোগাযোগ করেন। নেহেরু জানান, এ বিষয়ে তিনি অবগত আছেন। এরপর থেকে তিনি যেন ঢাকার ভারতীয় দূতাবাসের মাধ্যমেই দিল্লিতে যোগাযোগ করেন। এজন্য ১৯৬৮ সালের জানুয়ারিতে পাকিস্তান সরকার শেখ মুজিবসহ ২৮ জনের বিরুদ্ধে মামলা করে, যা বিখ্যাত ‘আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা’ নামে পরিচিত।

সম্পূর্ণ আর্টিকেলটি পড়ুন

সংবাদ সূত্র

News

The Largest News Aggregator
in Bengali Language

Email: [email protected]

Follow us