অন্তর্বর্তী সরকারের সঙ্গে দেশের প্রধান প্রধান রাজনৈতিক দলের সমঝোতা কিংবা বৃহত্তর জাতীয় ঐক্যের অভাব বর্তমান সংকটময় পরিস্থিতিকে আরো বিপর্যয়ের মুখে ফেলে দেবে। উল্লেখিত পরিস্থিতিতে অন্তর্বর্তী সরকারের সঙ্গে দেশের সব দেশপ্রেমিক গণতান্ত্রিক দলের সম্মিলিতভাবে একটি জাতীয় ঐক্য গড়ে তুলতে হবে। এই কাজটি অতি দ্রুত এবং অত্যন্ত জরুরিভাবে করতে হবে, যাতে আমাদের দেশবাসীর প্রাণের বিনিময়ে অর্জিত সফল গণ-অভ্যুত্থানের কোনো অর্জন বিনষ্ট না হয়। এই প্রক্রিয়ায় দেশি-বিদেশি সব অপশক্তি বা স্বার্থান্বেষী মহলকে প্রথমে পরাজিত করতে হবে।
নতুবা দেশের বাজারব্যবস্থা থেকে শুরু করে আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতি পর্যন্ত কিছুই নিয়ন্ত্রণে আনা সম্ভব হবে না। অন্যদিকে বিদেশি শক্তিকেও দক্ষতার সঙ্গে মোকাবেলা করা যাবে না। এখন যদি আমাদের রাজনৈতিক দলগুলো সব কিছু মোকাবেলা করতে সক্ষম না হয়, তাহলে ক্ষমতায় গিয়ে তারা কিভাবে সমাধান করবে সেসব? দেশীয় সমাজবিরোধী ও স্বার্থান্বেষী মহলের অপতৎপরতা এবং বিদেশি শক্তির ষড়যন্ত্র কিভাবে উচ্ছেদ করবে তারা? সে কারণে এখনই একটি ইস্পাত কঠিন জাতীয় ঐক্যের প্রয়োজন আমাদের। সে ঐক্য দলীয় স্বার্থে কিংবা ক্ষমতা দখলের প্রত্যাশায় নয়, বরং দেশের স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্ব অক্ষুণ্ন রাখা এবং মুক্তিযুদ্ধের চেতনাকে জাগ্রত রাখার লক্ষ্যেই সূচিত হতে হবে।
নতুবা চারদিকে নাগিনীরা যেভাবে বিষাক্ত নিঃশ্বাস ছড়াতে শুরু করেছে, তাতে দেশের স্বার্থ, জনগণের স্বপ্ন এবং সর্বোপরি মুক্তির আকাঙ্ক্ষা পর্যুদস্ত হবে। এমনকি আমরা চিরতরে আমাদের স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্বকে হারিয়ে ফেলতে পারি।
জুলাই-আগস্টের গণ-অভ্যুত্থান-পরবর্তী বাংলাদেশের বিভিন্ন অঞ্চলে উপর্যুপরি বন্যা এবং আন্তর্জাতিক বাজারে অর্থনৈতিক মন্দার কারণে আমরা আমাদের নিত্যপ্রয়োজনীয় সামগ্রীর উচ্চমূল্য নিয়ে সম্প্রতি হিমশিম খাচ্ছিলাম। স্থানীয় মজুদদার ও এক শ্রেণির ব্যবসায়ীর কারসাজিতে আমাদের বাজার এখনো নিয়ন্ত্রণের মধ্যে আসেনি। এর পাশাপাশি একটি অপশক্তির তৎপরতায় রাজধানী ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে প্রায়ই আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতির অবনতি হতে দেখা গেছে, যা এখনো অব্যাহত রয়েছে বলে অভিযোগ পাওয়া যায়।
এই পরিস্থিতিতে হঠাৎ করে শোনা গেল, আমাদের দেশের সনাতন ধর্মাবলম্বীদের একটি সংগঠনের নাম ভাঙিয়ে চট্টগ্রামে মহাসমাবেশ ডাকার কথা। হিন্দুদের প্রতিনিধিত্বকারী কোনো দেশি ধর্মীয় সংগঠন নয়, বরং ইসকন নামে বিদেশে রেজিস্ট্রিকৃত একটি উগ্র সংগঠন বাংলাদেশে হিন্দুদের ওপর নির্যাতনের অভিযাগ এনেছে। বলা হয়েছে, জুলাই-আগস্টে সংঘটিত অভ্যুত্থানের শেষের দিকে বাংলাদেশের বিভিন্ন স্থানে কয়েকজন হিন্দু নাগরিককে হত্যা করা হয়েছে, কয়েকটি মন্দির আক্রমণসহ হিন্দুদের কয়েকটি বাড়িঘর ও দোকানপাট ধ্বংস করা হয়েছে। বিষয়টি তদন্ত করে বর্তমান নির্দলীয় অন্তর্বর্তী সরকার বলেছে, সেটি কোনো ধর্মীয় বা সাম্প্রদায়িক আক্রমণ ছিল না। কিছু হিন্দু নাগরিকের আওয়ামী লীগের সঙ্গে সম্পৃক্ততা ও তাদের রাজনৈতিক কার্যকলাপের কারণে ঘটেছে। সরকার সেটি সম্পূর্ণভাবে বন্ধ করার জন্য ব্যবস্থা নিয়েছে এবং অপ্রত্যাশিত কিছু বিচ্ছিন্ন ঘটনার জন্য দুঃখ প্রকাশ করেছে। কিন্তু বিষয়টি সেখানে থেমে থাকেনি। উল্লিখিত ঘটনাগুলোকে কেন্দ্র করে এক নৈরাজ্যকর পরিস্থিতি সৃষ্টি করার প্রয়াস পেয়েছে উল্লিখিত মহলটি। তারা এমনকি সেই বিচ্ছিন্ন রাজনৈতিক উদ্দেশ্যপ্রণোদিত ঘটনাগুলোকে কেন্দ্র করে সম্প্রতি একটি দাঙ্গা সৃষ্টির প্রয়াসও পেয়েছিল। তাকে কেন্দ্র করে চট্টগ্রামের আদালত প্রাঙ্গণের কাছে সাইফুল ইসলাম নামের একজন আইনজীবীকে হত্যা করা হয়েছে। এসব ঘটনায় যখন সর্বত্র ইসকনের নাম সামনে আসছিল, তখন সেই প্রতিষ্ঠানটির মুখপাত্র চারুচন্দ্র দাস ব্রহ্মচারী বলেছেন, চিন্ময় কৃষ্ণ দাস, যিনি সম্প্রতি গ্রেপ্তার হয়েছেন, তার সঙ্গে ইসকনের এখন কোনো সম্পর্ক নেই। কারণ শৃঙ্খলাজনিত কারণে তার সঙ্গে ইসকনের সব সম্পর্ক ছেদ করা হয়েছে। পরে জানা যায়, চিন্ময় কৃষ্ণ দাস ব্রহ্মচারী বাংলাদেশ সনাতন জাগরণ মঞ্চ নামে প্রতিষ্ঠিত একটি সংগঠনের নেতা ও মুখপাত্র। সুতরাং ইসকন চিন্ময় কৃষ্ণ দাস ব্রহ্মচারীর সব অপকর্মের দায়দায়িত্ব অস্বীকার করেছে। কিন্তু কলকাতাসহ ভারতের কিছু সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম এবং কিছু গণমাধ্যম বিষয়টি নিয়ে মনগড়া অনেক অপপ্রচার চালাচ্ছে।
বাংলাদেশে সংঘটিত সাম্প্রতিক রাজনৈতিক গণ-অভ্যুত্থানকে কেন্দ্র করে আওয়ামী লীগ দলীয় সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ভারতে পালিয়ে যাওয়া এবং দেশে অবস্থানরত আওয়ামী লীগ ও ছাত্রলীগ সদস্যদের সরকারবিরোধী বিভিন্ন কার্যকলাপকে কেন্দ্র করে ভারত থেকে বিষয়টিকে একটি সম্পূর্ণ নৈরাজ্যকর অবস্থায় নিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করা হচ্ছে বলে অভিযোগ উঠেছে। শুধু তা-ই নয়, বাংলাদেশের সনাতন ধর্মাবলম্বী নাগরিকদের ওপর বর্তমান অন্তর্বর্তী সরকারের দমন-পীড়ন কিংবা অত্যাচারের পরিমাণ অনেক বেড়ে গেছে বলে অপপ্রচার করা হচ্ছে। তদুপরি তারা বাংলাদেশ সনাতন জাগরণ মঞ্চের নেতা চিন্ময় কৃষ্ণ দাসের গ্রেপ্তারকে কেন্দ্র করে এবং চট্টগ্রামে অনুষ্ঠিত তাদের সাম্প্রতিক জমায়েতে সরকারের হস্তক্ষেপকে কেন্দ্র করে বিষয়টিকে আন্তর্জাতিকভাবে একটি অপপ্রচারের সুযোগ হিসেবে নির্ধারণ করেছে। তারা বহির্বিশ্বে দেখাতে চাইছে যে শেখ হাসিনা-পরবর্তী বাংলাদেশ একটি জঙ্গিবাদী রাষ্ট্রে পরিণত হচ্ছে, সেখানে সংখ্যালঘু হিন্দুদের জন্য কোনো প্রতিরক্ষার ব্যবস্থা নেই। এই বিষয়টিকে বাংলাদেশিরা তাদের দেশের বিরুদ্ধে গভীর ষড়যন্ত্র বলে বিবেচনা করছে। তাদের প্রশ্ন হচ্ছে, বাংলাদেশের সাম্প্রতিক গণ-অভ্যুত্থানে কয়জন হিন্দু নাগরিক মারা গেছেন? তা ছাড়া ছাত্র-জনতার বিরুদ্ধে যারা আওয়ামী লীগের পক্ষে আক্রমণ চালিয়েছেন, তারা এখন উদ্দেশ্যমূলকভাবে দলীয় পরিচয় ঢেকে দিয়ে ধর্মগত পরিচয় তুলে ধরছেন। এর পেছনে তাদের প্রকৃত উদ্দেশ্যটি কী? তা ছাড়া চট্টগ্রামসহ বিভিন্ন স্থানে হিন্দুদের সমাবেশে আওয়ামী লীগ ও নিষিদ্ধ ছাত্রলীগের কর্মীদের অধিক সংখ্যায় পাওয়া যাচ্ছে কেন? বিগত কিছুদিনে তাদের একটি বিরাট গ্রুপকে পুলিশ গ্রেপ্তার করেছে। তার পরও বংলাদেশের আন্দোলনরত ছাত্র-জনতা কিংবা কোনো রাজনৈতিক দলের সদস্যরা সনাতন ধর্মাবলম্বী কিংবা চিন্ময় সংগঠিত বাহিনীর বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা গ্রহণ করেননি। দেশের আইন-শৃঙ্খলা রক্ষা বাহিনী বিষয়টি তাদের আয়ত্তে রাখার চেষ্টা করেছে। কোনো দাঙ্গা-হাঙ্গামার দিকে যেতে দেয়নি। একটি অভ্যন্তরীণ কুচক্রীমহল বিদেশের সঙ্গে হাত মিলিয়ে বাংলাদেশকে অত্যন্ত অস্থিতিশীল করে তুলতে চায়। ৫ আগস্টের পর থেকে প্রতিনিয়ত তারা বাংলাদেশকে দুর্বল করে তুলতে চেয়েছে তাদের পুর্নবাসনের জন্য। রাজনৈতিক প্রত্যাবাসনের জন্য। তারা আবার দ্রুত তাদের কায়েমি স্বার্থ সিদ্ধি করতে চাচ্ছে। অথচ বাংলাদেশের সাধারণ মানুষ, রাজনৈতিক দলগুলো এবং এমনকি বর্তমান অন্তর্বর্তী সরকারও তাদের সঙ্গে বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক রক্ষা ও শান্তিপূর্ণ সহাবস্থানে বিশ্বাসী। সে কারণে বাংলাদেশের মানুষ চায় তারা ভালো করে চোখ খুলে দেখুক আসলে প্রকৃত ঘটনাগুলো কী ঘটেছে। বাংলাদেশ কারো হুমকি-ধমকিতে কাঁপবে না, কারো করদরাজ্যে পরিণত হবে না কখনো। এ ব্যাপারে খুব বেশি দেরি হয়ে যাওয়ার আগে তাদের বোধোদয় হোক, সেটি সবাই চায়।