সহিংস ও কর্তৃত্ববাদী শাসনের পরবর্তী সময়ে বিভিন্ন আনুষ্ঠানিক ও অনানুষ্ঠানিক পদ্ধতির মাধ্যমে সমাজের মধ্যে শান্তি ও সহাবস্থান পুনরুদ্ধারের প্রক্রিয়াকে ট্রানজিশনাল জাস্টিস বা ক্রান্তিকালীন বিচার বলা হয়। এই ক্রান্তিকালীন বিচারব্যবস্থা রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীর বর্তমান ক্যাম্পজীবনে কীভাবে প্রভাব ফেলতে পারে, তা আমার বর্তমান পিএইচডি গবেষণার বিষয়। জুলাই অভ্যুত্থান-পরবর্তী বাংলাদেশে অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের ১১০ দিনের খেরোখাতায় শান্তি ও সহাবস্থান পুনঃপ্রতিষ্ঠার উদ্যোগগুলোকে তাই ক্রান্তিকালীন বিচারের লেন্স দিয়ে দেখার চেষ্টা করেছি।
ট্রানজিশনাল জাস্টিস বা ক্রান্তিকালীন বিচার ধারণাটি একেবারেই নতুন। নব্বই দশকের শেষের দিকে আন্তর্জাতিক অঙ্গনে সহিংসতা-পরবর্তী সময়ে কীভাবে সমাজে শান্তি ও সহাবস্থান পুনরুদ্ধার করা যায়, তার পরিপ্রেক্ষিতেই এই ক্রান্তিকালীন বিচারের উদ্ভব।
ক্রান্তিকালীন বিচারের আওতাধীন মূল পাঁচটি পদ্ধতি হলো আদালতের বিচার, সত্য উদ্ঘাটন, ক্ষতিপূরণ প্রদান, প্রাতিষ্ঠানিক সংস্কার ও স্মৃতিচারণামূলক পদক্ষেপ।
তবে ক্রান্তিকালীন বিচারের এই পাঁচ প্রক্রিয়ার মধ্যে কোনটি কিংবা কোন সমন্বয়ের ভিত্তিতে নির্ধারিত হবে, তা নির্ভর করে দেশটির সামাজিক ও রাজনৈতিক অন্যান্য পরিস্থিতির ওপর। স্বৈরশাসকদের করা অপরাধের ধরন, অপরাধের ব্যাপকতা, ভিকটিমের ধরন যেমন গুরুত্বপূর্ণ, ঠিক তেমনি অপরাধীদের সংখ্যা, বর্তমান রাজনৈতিক অবস্থা, নতুন সরকার গঠন ইত্যাদিও আমলে নিতে হয়।
সরকারি পরিসংখ্যান অনুযায়ী, জুলাই অভ্যুত্থানের সময় তৎকালীন সরকারের নির্দেশে পুলিশ ও দলীয় অঙ্গসংগঠনের মাধ্যমে সরকারি হিসাবে কমপক্ষে আট শতাধিক আন্দোলনকারী নিহত এবং ১৮ হাজার ছাত্র-জনতা আহত হন। রাষ্ট্রীয় পৃষ্ঠপোষকতায় করা এই অপরাধের বিচার করতে ইতিমধ্যে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের আনুষ্ঠানিক কার্যক্রম শুরু হয়েছে গত ১৭ অক্টোবর।
নতুনভাবে ট্রাইব্যুনালকে ঢেলে সাজানোর লক্ষ্যে প্রসিকিউটর টিম, বিচারক ও তদন্ত কমিটি পুনর্গঠন করা হয়েছে। অন্তর্বর্তীকালীন সরকার আন্তর্জাতিক অপরাধ (ট্রাইব্যুনাল) আইন, ১৯৭৩-কে যুগোপযোগী ও আন্তর্জাতিকভাবে মানসম্মত করার লক্ষ্যে সংশ্লিষ্ট আটটি ধারার সংশোধনের খসড়া প্রস্তাব করলেও মৃত্যুদণ্ড পরিবর্তনের কথা এখনো শোনা যায়নি।
কেননা, এই ট্রাইব্যুনালের অধীন পূর্ববর্তী বিচারকালে মৃত্যুদণ্ডাদেশের কারণে ট্রাইব্যুনালের রায় আন্তর্জাতিক মহলে তীব্র সমালোচনার সম্মুখীন হয়। অন্তর্বর্তী সরকারের আইন উপদেষ্টা ড. আসিফ নজরুল ট্রাইব্যুনাল প্রসঙ্গে বলেন, ‘আমরা এই সমাজে আর ক্ষত চাই না। বিভাজন চাই না। বিচারের মধ্য দিয়ে একটা রিকনসিলিয়েশন (পুনর্মিলন) প্রসেসের (প্রক্রিয়া) শুরু করতে চাই।’ তিনি বলেন, ‘যত হতাশা থাক, যত ক্রন্দন থাক, ক্ষোভ থাকুক, বিচার অবশ্যই সবার কাছে গ্রহণযোগ্য হতে হবে।’ (প্রথম আলো, ২৩ সেপ্টেম্বর ২০২৪ )
তাঁর এই মহতী আকাঙ্ক্ষা অনুসারে ট্রাইব্যুনাল কতটা পক্ষপাতহীন ও আন্তর্জাতিক মানদণ্ডে সফল হয়ে বিচারকার্য পরিচালনা করতে পারে, তা সময়ই বলে দেবে।
জুলাই হত্যাকাণ্ডের বিচারপ্রক্রিয়া শুরু করার সঙ্গে অন্তর্বর্তীকালীন সরকার আরও কয়েকটি আইনি বিষয়ে সংস্কারকাজ হাতে নিয়েছে। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো সাইবার নিরাপত্তা আইনসহ অন্যান্য কালো আইন বাতিলের উদ্যোগসহ সুপ্রিম কোর্টে বিচারপতি নিয়োগ আইনের খসড়া প্রণয়ন, বিচার বিভাগ সংস্কার কমিশন গঠন, গণ-আন্দোলন দমনে করা ফৌজদারি মামলা প্রত্যাহার ও গুমবিরোধী সনদ অনুসমর্থন তথা তদন্ত কমিশন গঠনের পদক্ষেপের বিষয়গুলো উল্লেখযোগ্য।