মানুষের জীবন চিরকাল সমস্যাসংকুল। অন্তর্গত শক্তি ও দুর্বলতা, সামাজিক জটিলতা আর প্রাকৃতিক বাস্তবতা মানুষের জীবনকে সমস্যা সমাকীর্ণ রাখে। মানুষ সামাজিক জীব। পরিবার, সমাজ, জাতি, রাষ্ট্র ও আন্তঃরাষ্ট্রিক সম্পর্ক অবলম্বন করে তাকে বাঁচতে ও চলতে হয়। এতেও অনেক জটিলতা থাকে। চিন্তাশক্তি ও শ্রমশক্তিকে কাজে লাগিয়ে প্রকৃতিকে ব্যবহার করে তাকে বাঁচতে হয়। এক সমস্যার সমাধান করতে না করতেই তাকে নতুন আরেক সসস্যায় পড়তে হয়। স্বাধীনতা লাভ করা মানে সমস্যার সমাধান করা।
স্বাধীন থাকা মানে সমস্যামুক্ত থাকা। সমস্যার পর সমস্যার সমাধান করে করেই মানুষ চিরকাল জীবন যাপন করেছে। এরই মধ্যে মানুষের আনন্দ ও বেদনা, আশা ও নৈরাশ্য, সৃষ্টি সামর্থ্যের পরিচয় ও জীবনযাপনের সার্থকতা। নিরন্তর স্বাধীন থাকার অর্থাৎ সমস্যামুক্ত থাকার কোনো উপায় নেই। ভালো সফল জীবনযাপনের জন্য মানুষকে জীবন ও জীবনের পরিবেশকে নানা দিক দিয়ে বিচার-বিবেচনা করে দেখতে হয়। ‘অপরীক্ষিত জীবন যাপনযোগ্য নয়।’
বাস্তবভিত্তিক এবং বাস্তবায়ন সম্ভব চিন্তা আমাদের দরকার। জাতীয় জীবনে যখন চিন্তার ও বিচার-বিবেচনার অভাব দেখা দেয়, তখন জাতির স্বাভাবিক বিকাশ ব্যাহত হয় এবং বিকার-বিকৃতি দেখা দেয়। বাংলাদেশের বাস্তব অবস্থাটা এখন কেমন? এ রাষ্ট্রে জনজীবন কি এখন স্বাভাবিক আছে? উন্নতিশীল আছে? অদূর ভবিষ্যতে কী হবে? সুদূর ভবিষ্যতে?
বাংলাদেশে আমাদের জাতীয় পতাকা ও জাতীয় সংগীত আছে, জাতিসংঘের সদস্য পদ আছে।
কিন্তু জাতীয় বা রাষ্ট্রীয় স্বাধীনতা কি আছে? মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র যেভাবে বাংলাদেশের জাতীয় সংসদের নির্বাচন ও রাজনীতি নিয়ে আমাদের সরকারের ওপর চাপ সৃষ্টি করে; রাজনীতি, অর্থনীতি ও সংস্কৃতি নিয়ে তাদের ওপর আমাদের নির্ভরশীলতা বাড়ানোর চেষ্টা করে; তাতে বাংলাদেশ স্বাধীন রাষ্ট্ররূপে চলতে কিংবা গড়ে উঠতে পারে না। বাংলাদেশের ওপর ভারতের কর্তৃত্ববাদী আচরণের কথা অনেকেই বলছেন। ভারতের প্রতি বিরূপ মনোভাব নিয়ে আমরা কি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের দিকে ঝুঁকে যাব? অথবা মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের প্রতি বিরূপ মনোভাব নিয়ে ভারতের দিকে ঝুঁকে যাব? নাকি আমরা আমরা ভারত ও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র দুটিকেই আমাদের শত্রু মনে করে আমরা চলব? আমাদের পররাষ্ট্রনীতি কেমন আছে? পররাষ্ট্রনীতিকে নতুন কী রূপ আমাদের দেওয়া উচিত? মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র তো বাংলাদেশকে চীন-রাশিয়ার বিরুদ্ধে অবস্থান নিয়ে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সহযোগী হওয়ার জন্য সীমাহীন চাপ সৃষ্টি করে আসছে। বড় দুই দল—আওয়ামী লীগ ও বিএনপি ক্ষমতার বাইরে থাকাকালে নিজেদের রাজনীতিকে পশ্চিমা বৃহৎ শক্তিবর্গের স্থানীয় দূতাবাসগুলোর অভিমুখী করে তোলে।
শেখ হাসিনা প্রধানমন্ত্রীর পদ ত্যাগ করে ভারতে পালিয়ে গেলেন কেন? যেসব কথা বলা হচ্ছে, সেগুলোই কি সব! বলা হচ্ছে না, বিবেচনায় ধরা হচ্ছে না—এমন কোনো গুরুত্বপূর্ণ বিষয় কি নেই? ছাত্রদের ‘কোটা সংস্কার আন্দোলন’ ও ‘বৈষম্যবিরোধী আন্দোলন’ কি নিতান্ত স্বতঃস্ফূর্ত ছিল? সারা দেশে শেখ মুজিবের এবং তার পরিবারের লোকদের সব ভাস্কর্য যারা ভেঙেছিল, তারাও কি স্বতঃস্ফূর্তভাবে এ কাজ করেছে? তারা টেলিভিশনের আর্কাইভ ভাঙতে লেগেছিল? তারা ধানমণ্ডির ৩২ নম্বর রোডে জাদুঘর রূপে রক্ষিত শেখ মুজিবের বাড়ি ও তাতে রক্ষিত ঐতিহাসিকভাবে গুরুত্বপূর্ণ সব জিনিস ভেঙে নষ্ট করেছে কেন? ১৫ বছর ধরে শেখ মুজিব ও তার পরিবারের সবার স্মৃতি রক্ষার উদ্দেশে যেসব স্থাপনা সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার উদ্যোগে রাষ্ট্রীয় অর্থ ব্যয় করে প্রতিষ্ঠা করা হয়েছিল, সেই প্রায় সব কিছু ধ্বংস করা হয়েছে। হাসিনা সরকার তার মা-বাবার, ভাইদের ও ভাই বউদের যেসব স্মারক ও নামকরণ করেছিলেন, সেগুলো নিশ্চিহ্ন করা হয়েছে। নিতান্ত স্বতঃস্ফূর্তভাবে করা হয়েছে কি? বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনে দেশব্যাপী বিভিন্ন স্থানে যে জনসমাগম হয়েছে, তা-ও কি স্বতঃস্ফূর্তভাবে হয়েছে? দেশব্যাপী ছাত্রলীগ, আওয়ামী যুবলীগ এবং আওয়ামী লীগের অনেক নেতাকর্মী ছাত্র-ছাত্রীদের ও জনসাধারণের প্রতি যে জুলুম-জবরদস্তি, লুটপাট ও নির্যাতন চালিয়েছিলেন, বিএনপির নেতাকর্মীদের প্রতি অত্যন্ত নিষ্ঠুর আচরণ করে, মামলা-মোকদ্দমা দিয়ে ক্রমাগত হয়রান করেছিলেন, তার যে প্রতিক্রিয়া হতে পারে, আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীদের মধ্যে কেউই তা বুঝতে পারেননি কেন? আওয়ামী লীগের কিছু নেতা ব্যাংকগুলো থেকে অর্থ আত্মসাৎ করে, ঋণখেলাপি হয়ে, বিদেশে অর্থ পাচার করে আর্থিক দিক দিয়ে আমাদের জাতি ও রাষ্ট্রকে চরম দুর্গতির মধ্যে ফেলে দিলেন, তাদের মনে কি কখনো প্রশ্ন জাগেনি যে এসব অপকর্মের জন্য তারা চরম দুর্গতির মধ্যে পড়তে পারেন? একটানা দীর্ঘদিন ক্ষমতায় থাকার মধ্যে শক্তির পরিচয় থাকে। কিন্তু শক্তির প্রয়োগ যদি খারাপ কাজে হয়, তাহলে তার প্রতিক্রিয়া যে মারাত্মক হতে পারে, এই বোধ তাদের মনে দেখা দেয়নি কেন? এমনই অনেক প্রশ্ন অনেকের মনে আছে। শেখ হাসিনার শক্তির দম্ভ তাকে বিপদে ফেলেছে। আওয়ামী লীগ ও বাংলাদেশকেও বিপদে ফেলেছে।
এককালের মামলা-মোকদ্দমার প্রতিক্রিয়ায় এখন ভিন্ন ধারায় মামলা-মোকদ্দমা হচ্ছে। লোকে প্রকৃত অপরাধীদের আইন অনুযায়ী শাস্তি চাইছে। শাস্তির চেয়েও বড় ব্যাপার হলো ভবিষ্যতে এই ধরনের অপকর্ম যেন না হয়, তার ব্যবস্থা করা। তা কঠিন কাজ। সেই কঠিন কাজও করতে হবে। হিংসা-প্রতিহিংসা নয়, কেবল অপরাধীদের শাস্তি দান নয়, চাই এই ধরনের অপকর্মের যাতে পুনরাবৃত্তি না হয়, তার জন্য ব্যবস্থার সংস্কার করা দরকার। এর জন্য নৈতিক দিক দিয়েও সমস্যাগুলোকে বিচার করে দেখতে হবে এবং নীতিগত প্রচার চালাতে হবে। আমি মনে করি, বিজ্ঞানসম্মত দৃষ্টিভঙ্গি নিয়ে নৈতিক সমস্যাগুলোকে বিচার করতে হবে। শিক্ষাব্যবস্থা ও শিক্ষানীতিতেও বিজ্ঞানসম্মত নৈতিক শিক্ষা প্রবর্তন করতে হবে। বিজ্ঞানসম্মত দৃষ্টিভঙ্গিকে যথোচিত গুরুত্ব না দিলে সুফল হবে না। যারা আমলাতান্ত্রিক ক্ষমতা কিংবা রাজনৈতিক ক্ষমতার সুযোগ নিয়ে বিপুল সম্পত্তির অধিকারী হয়েছেন, তাদের অতিরিক্ত সম্পত্তি দ্রুত সরকারের নিয়ে নেওয়া এবং তা বিক্রি করে প্রাপ্ত অর্থ রাষ্ট্রীয় কোষাগারে বা ট্রেজারিতে জমা দেওয়ার ব্যবস্থা করতে হবে। এর জন্য নতুন আইন জারি করে এবং বিচারব্যবস্থা সম্প্রসারিত করে প্রয়োজনীয় সব কাজ দ্রুত সম্পন্ন করতে হবে। বাংলাদেশের প্রচলিত আইন ও বিচারব্যবস্থা দুর্নীতি কমানোর অনুকূল নয়—সহায়ক। যে বিশিষ্ট নাগরিকরা চিরকালের জন্য দুর্নীতি নির্মূল করতে চিৎকার করেছেন, তাদের কথাবার্তায় কাণ্ডজ্ঞানের অভাব ছিল। পশ্চিমা আধিপত্যবাদীদের প্রচারমাধ্যম নানাভাবে বিপুল প্রচার দিয়ে দুর্বল জাতি ও রাষ্ট্রগুলোর সুষ্ঠু চিন্তা-ভাবনার বিকাশের সম্ভাবনাকে বিভ্রান্ত ও বিকৃত করে দিয়েছে।