জাতিসংঘ ১৯৫৪ সালে ২০ নভেম্বর দিনটিকে শিশু দিবস হিসাবে পালনের ঘোষণা দিয়েছিল। প্রথমে দিবসটি পালন করা হতো সর্বজনীন শিশু দিবস (Universal Childre's Day) হিসাবে। পরবর্তীকালে ২০ নভেম্বর বিশ্ব শিশু দিবস হিসাবে উদ্যাপিত হয়। জরিপে দেখা গেছে, বেশিরভাগ অভিভাবকই জন্মের শুরুতে বা শৈশবে শিশুর যত্ন ও প্রতিপালন বিষয়ে জানেন না। তাই শিশু চিকিৎসায় চিকিৎসকরা শৈশবকে দু’ভাগে ভাগ করে থাকেন। একটি হলো প্রারম্ভিক শৈশব, অন্যটি হলো শৈশব। মূলত প্রারম্ভিক শৈশব নামকরণটি করা হয় শিশুর যত্ন ও চিকিৎসাসেবায় ধাপ নির্ধারণের জন্য।
প্রারম্ভিক শৈশব হচ্ছে সেই সময়টা, যখন শিশুর যত্ন ও বেড়ে ওঠার বিষয়ে সবচেয়ে বেশি খেয়াল করা প্রয়োজন। শিশুর জন্মের পর প্রথম আট বছর তার বেড়ে ওঠার জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। এটি সময় পরিবর্তনের এবং সে পরিবর্তন শারীরিক ও মানসিক উভয় ধরনের। তবে শিশুর প্রথম তিন বছর বৃদ্ধি ও বিকাশের জন্য সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ। এ সময়ে শিশুর মস্তিষ্ক নমনীয় থাকে এবং দ্রুত বিকশিত হয়। শিশুর ভালো ও খারাপ অভিজ্ঞতাগুলো মস্তিষ্কের বৃদ্ধির ওপর কড়া প্রভাব ফেলে। এ সময়ে অবহেলা বা নির্যাতন শিশুর বুদ্ধিবৃত্তি, আচরণ ও আবেগের ক্ষেত্রে জটিলতা সৃষ্টি করে।
শিশুর বিকাশের জন্য অত্যাবশ্যক উপাদান-চিকিৎসা, পুষ্টি, উদ্দীপনা, সুরক্ষা ও শিক্ষা-এ বিষয়গুলো নিশ্চিত করার লক্ষ্যে শিশু, বাবা-মা ও সেবাদাতাদের সক্ষম করে তোলার সম্ভাব্য সবকিছু নিয়ে কর্মসূচি প্রণয়ন করা হয়। সে কাজগুলোকে বলা হয় প্রারম্ভিক শৈশব সেবা বা আর্লি চাইল্ডহুড কেয়ার অ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট, অথবা ‘ইসিসিডি’।
বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে অধিকাংশ অভিভাবকের শিশুর সঠিক যত্ন ও প্রতিপালন সম্পর্কে জ্ঞান এখনো বেশ সীমিত। বাবা-মা কাজে থাকার সময় ছোট শিশুরা যথাযথ সেবা থেকে বঞ্চিত হয়। শিশুর শিক্ষাগত সাফল্যের জন্য অভিভাবকরা খুব বেশি যত্নশীল হলেও অধিকাংশ অভিভাবকই জানেন না যে, উদ্দীপনা ও নিরাপত্তার অভাব শিশুর শ্রেণিকক্ষের কর্মকাণ্ডে ব্যাপকভাবে নেতিবাচক প্রভাব ফেলে। বাংলাদেশে শিশুর প্রাথমিক বিকাশের চ্যালেঞ্জগুলো সহিংস আচরণ, জ্ঞানের সীমিত সুযোগ এবং মৌলিক সেবাগুলোর ঘাটতির সঙ্গে সম্পর্কিত। প্রতি চারটি শিশুর মধ্যে তিনটি শিশু মানসিক নির্যাতনের শিকার এবং প্রতি তিনটি শিশুর মধ্যে দুটি শারীরিক অশান্তি ভোগ করছে। মূলত বস্তি, অস্বাস্থ্যকর পরিবেশ, প্রত্যন্ত গ্রামীণ অঞ্চল এবং সুবিধাবঞ্চিত সংখ্যালঘু জনগোষ্ঠীর শিশু, যাদের মৌলিক সেবা পাওয়ার সুযোগ সীমিত, তারাই বেশি ঝুঁকিতে থাকে। এছাড়া দ্রুত নগরায়ণ এবং লোকজনের শহরমুখী হওয়া, সেটা স্বেচ্ছায় বা জলবায়ু পরিবর্তনজনিত কারণে বাধ্য হয়ে, যা-ই হোক না কেন, দুটি বিষয়ই সন্তানের প্রতি বাবা-মায়ের যত্ন নেওয়ার ক্ষেত্রে হুমকি তৈরি করছে।
শিশুর প্রারম্ভিক যত্ন ও বিকাশকে (আর্লি চাইল্ডহুড কেয়ার অ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট) অগ্রাধিকার দেওয়ার উদ্দেশ্যে একটি জাতীয় নীতিমালা তৈরি করেছে বাংলাদেশ সরকার। তবে নীতিমালার সফল বাস্তবায়নের জন্য প্রয়োজনীয় বিষয়গুলোকে অগ্রাধিকার দেওয়া এবং তার জন্য বিনিয়োগ করা প্রয়োজন এবং তা করতে হবে বিভিন্ন খাতের সমন্বয় এবং পর্যাপ্ত তহবিল সংগ্রহের মাধ্যমে। আশঙ্কার কথা হলো, শিশুর প্রারম্ভিক যত্ন ও বিকাশের ক্ষেত্রে যথেষ্ট বিনিয়োগ করার সদিচ্ছা না থাকলে একটা অপেক্ষাকৃত তরুণ জনগোষ্ঠী থাকা সত্ত্বেও বাংলাদেশ অর্থনৈতিকভাবে অনেক পিছিয়ে পড়বে। এছাড়া সঠিক প্রারম্ভিক বিকাশ না হলে শিশুরা শিক্ষাক্ষেত্রে সীমিত অর্জন, অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে পরনির্ভরতা, অধিক মাত্রায় সহিংসতা ও অপরাধ, মাদক সেবন ও নৈরাজ্যের মাঝে ডুবে যেতে পারে।
কীভাবে শিশুর অবস্থার উন্নতি হতে পারে
সরকারের ধারাবাহিক সহযোগিতা ও অগ্রাধিকারের ওপরই এক্ষেত্রে সাফল্য নির্ভর করে। এ সম্পর্কে বাংলাদেশে ইউনিসেফের শুভেচ্ছাদূত ও দেশবরেণ্য ক্রিকেটার মুশফিকুর রহিম ‘বিশ্ব শিশু দিবস ২০২১’ উপলক্ষ্যে খুবই প্রয়োজনীয় ও চমৎকার একটি উক্তি করেছেন। তিনি বলেছেন, ‘আমি পরিবার থেকে শিক্ষা, পুষ্টি, আশ্রয় এবং স্বাস্থ্যসেবাসহ একটি নিরাপদ শৈশব পেয়ে কৃতজ্ঞ; কিন্তু সারা দেশে এখন অনেক শিশু এসব মৌলিক অধিকার থেকে বঞ্চিত। ভবিষ্যতে বড় সমস্যাগুলো মোকাবিলা করার জন্য আমাদের শিশুদের অনেক বেশি স্বাস্থ্যকর, দক্ষ ও সক্ষম হতে হবে। এ কারণে আমাদের সরকারকে এখনই শিক্ষা, স্বাস্থ্য ও নিরাপত্তার মতো গুরুত্বপূর্ণ দিকগুলো বিবেচনা করে সরকারি খাতে শিশুদের জন্য বিনোয়োগ বাড়াতে হবে।’