যেকোনো সামাজিক বিষয় বা সামাজিক সমস্যা নিয়ে আমরা যখন আলোচনা করি, তখন কখনো কখনো তত্ত্ব দিয়ে তার ব্যাখ্যা করি, আবার কখনো কখনো বাস্তব অবস্থার পরিপ্রেক্ষিতে সে বিষয় বা সমস্যার বিশ্লেষণ করি। তাত্ত্বিক ব্যাখ্যা এবং বাস্তবতার বিশ্লেষণ যে সর্বদা সামঞ্জস্যপূর্ণ হয়, তা নয়। অনেক ক্ষেত্রেই দেখা যায় যে তত্ত্ব দিয়ে বাস্তব অবস্থার ব্যাখ্যা করা যাচ্ছে না। তবু অহরহ নানান তাত্ত্বিক আলোচনার সঙ্গে আমাদের জগতের বাস্তবতা গুলিয়ে ফেলি। তাত্ত্বিক বহু ধ্যান-ধারণার সঙ্গে আমরা এমন ‘অন্ধ প্রেমে’ পড়ে যাই যে চারপাশের বাস্তবতাটুকু দেখতেই পাই না। এর ফলে, বহু ভ্রান্ত উপসংহারে গিয়ে আমরা পৌঁছাই।
নিজের কথাই বলি না কেন! ছাত্রজীবনে, শিক্ষকতার কালে, উচ্চশিক্ষার সময়ে তাত্ত্বিক ধারণা, বিতর্ক-আলোচনায় বুঁদ হয়ে থাকতাম। নিজেকে মননের জগতে একজন কেউকেটা বলে মনে হতো। তারুণ্যের অহম্ বোধ থেকে মনে হতো যে তত্ত্ব দিয়েই সব সমস্যার সমাধান আমি দিতে পারব। নানান তাত্ত্বিকের মতামত, ধারণা আমার ঠোঁটস্থ ছিল। ফলে আমার চিন্তাচেতনায় দুটি সমস্যার সৃষ্টি হয়। এক. নিজস্ব চিন্তাভাবনার বদলে আমি অন্যের ভাবনাচিন্তার ওপর বেশি নির্ভরশীল হয়ে পড়ি। দুই. তত্ত্বের দিকে বেশি ঝুঁকে পড়ায় অনেক সময় আমি বাস্তবতার উপলব্ধি থেকে দূরে সরে পড়ি।
উচ্চশিক্ষা শেষে দেশে ফিরে শিক্ষকতার পাশাপাশি প্রায়োগিক গবেষণা করতে গিয়ে বুঝতে পারি যে তাত্ত্বিক জ্ঞান ও বাস্তব অবস্থা ভিন্ন, তফাৎ রয়েছে পড়ার বইয়ের সঙ্গে জীবনের অভিজ্ঞতার। শ্রেণিকক্ষে পড়াতে গিয়ে দেখা গেল যে পাঠ্যপুস্তকের তত্ত্বের সঙ্গে বাস্তব অবস্থা মিলছে না। পূর্ণ প্রতিযোগিতামূলক বাজার বইয়ের পাতায় থাকলেও বাস্তব বাজারে নেই। কল্যাণমূলক অর্থনীতির সুগভীর তত্ত্ব পুস্তকে থাকলেও রাষ্ট্রীয় জীবনে তার হদিস মেলে না। এইসব বোধ শিক্ষক হিসেবে আমার শিক্ষার বেসাতি সাজাতে সাহায্য করেছে এবং আমার শিক্ষার্থীদের সঙ্গে একটা অর্থবহ শিক্ষাসংযোগ তৈরি করেছে। অর্থনীতির তত্ত্বের নানান কচকচিকে খুব বাস্তবঘনিষ্ঠ করে সহজ ভাষায় আমি শ্রেণির দুর্বলতম শিক্ষার্থীর কাছেও পৌঁছে দিতে পেরেছি। শিক্ষক হিসেবে সেটুকুই আমার সার্থকতা।
গবেষণার জন্য বাংলাদেশের গ্রামগঞ্জে গিয়ে দারিদ্র্য, বঞ্চনা, বৈষম্য, উন্নয়ন যে কী, তা আমি সত্যিকার অর্থে বুঝতে পারলাম। উপলব্ধি করলাম যে তাত্ত্বিক শিক্ষা কোনো বিশেষ বিষয়ের বিশ্লেষণের ও ব্যাখ্যার কিছু উপকরণের সঙ্গে আমাদের পরিচয় করিয়ে দেয়, গবেষণা সেসব উপকরণের প্রয়োগ শেখায়। কিন্তু সেসব উপকরণ নিমিত্ত মাত্র, সেগুলো দিয়ে আমরা বাস্তব সমস্যার একটি অর্থবহ বিশ্লেষণ করতে পারি এবং সেসব থেকে কিছু অর্থবহ উপসংহারে উপনীত হতে পারি। অন্য কথায়, বঞ্চনা, সমতা, বৈষম্যের ওপরে খুব জোরালো তাত্ত্বিক জ্ঞান আমার ছিল। দারিদ্র্য এবং অসমতা পরিমাপের জন্য প্রয়োজনীয় কাঠামো ও তাদের গাণিতিক সূত্রও আমার আয়ত্তের মধ্যে ছিল। কিন্তু বাংলাদেশের গ্রামগঞ্জে গবেষণা করতে গিয়ে এসব আর্থসামাজিক বিষয়ের বাস্তব স্বরূপ ও ব্যাপ্তি সম্পর্কে আমার জ্ঞানলাভ হলো। আমার এ জ্ঞানলাভের জন্য আমি প্রয়াত দুজন অর্থনীতিবিদের কাছে কৃতজ্ঞ—অধ্যাপক মুশাররফ হোসেন ও ড. মাহবুব হোসেন।
আশির দশকের কথা। গবেষণার কারণে ড. মাহবুব হোসেন ও আমি তখন ফরিদপুরে। নতুন এক প্রজাতির ধানের ফলন ভালো, খরচও কম। তবু কৃষকেরা এ ধান লাগাচ্ছেন না। কোনো তত্ত্ব দিয়ে এর ব্যাখ্যা করা যাচ্ছে না। একদিন বিকেলে মাহবুব ভাই আর আমি চাষি ভাইদের সঙ্গে কথা বলছিলাম। তাঁদের জিজ্ঞাসা করলাম, তাঁরা কেন ওই ধানটা লাগাচ্ছেন না। একজন চাষি একটু চুপ করে থেকে বললেন, ‘নতুন যে ধানের কথা কইতেছেন আপনেরা, তার সবই ভালো, কিন্তুক পাকনের কালে ওই ধানের শিষ চোহে দ্যাহা যায় না। শিষগুলান পাতার তলে ঢাইক্যা থাহে। কন্ স্যার, অ্যাতে কি নয়নসুখ হয়, না হেতে পরান ভরে?’ এ প্রশ্নের জবাব আমরা কেউ দিতে পারিনি। ব্যয় আর উৎপাদনশীলতার তত্ত্ব দিয়ে এ বাস্তবতার ব্যাখ্যা করা যায়নি।
পরবর্তী সময়ে জাতিসংঘের দারিদ্র্যবিমোচন বিভাগের পরিচালক হিসেবে কাজ করার সময় পৃথিবীর ১০০টি দেশের দারিদ্র্য ও অসমতা সম্পর্কে যে বাস্তব জ্ঞান লাভ করেছি, কোনো তাত্ত্বিক শিক্ষাই তার সঙ্গে তুলনীয় নয়। সাম্প্রতিক সময়ে জাতিসংঘের মানব উন্নয়ন প্রতিবেদনের পরিচালক ও মুখ্য লেখক হিসেবে দায়িত্ব পালন করার সময় তাত্ত্বিক শিক্ষার সঙ্গে প্রায়োগিক বাস্তবতার সমন্বয় করতে প্রয়াসী হয়েছি। তাই দারিদ্র্য, বঞ্চনা, সমতা আমার কাছে আজ আর কোনো বিমূর্ত ধারণা নয়। দেশভেদে দারিদ্র্য, বঞ্চনা ও অসমতার স্বরূপ, তার ভিন্নতা এবং সুনির্দিষ্ট সমাধান সম্পর্কে কিছুটা হলেও জেনেছি। তাত্ত্বিক শুদ্ধতার মধ্যে নিজেকে আবদ্ধ রাখিনি, বিমূর্ত কোনো ধারণা থেকে বিভ্রান্ত হইনি, উল্টাপাল্টা উদাহরণ নিয়ে বেপথু হইনি—না চিন্তায়, না কাজে।