বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়ের ‘পথের পাঁচালী’র দুর্গার মৃত্যু ঘটেছিল আকস্মিক, বৃষ্টিতে ভিজে, অতি অল্প বয়সে। কালজয়ী এই উপন্যাসের চলচ্চিত্ররূপেও তাই দেখানো হয়েছিল। গল্পের কিশোরী মেয়েটিকে সিনেমায় যিনি জীবন্ত করে তুলেছিলেন— বাঙালি সমাজে যিনি নাম-চরিত্রের মতো ‘দুর্গা’ নামেই পরিচিত হয়ে গিয়েছিলেন। তিনি উমা দাশগুপ্ত। গত সোমবার, ১৮ নভেম্বর ৮৫ বছর বয়সে তিনি চিরতরে চলে গেছেন।
উমা দাশগুপ্তের প্রয়াণের খবরটা শোনার পর থেকে মনের পর্দায় ভেসে উঠছে দুর্গার সেই মায়াবী মুখ। রূপালী পর্দায় দুর্গার মৃত্যু শুধু অপুর মনেই ক্ষতের সৃষ্টি করেনি, কাঁদিয়েছিল দর্শকদেরও। বিভূতি, সত্যজিৎ রায়, ‘পথের পাঁচালী’, অপু ও দুর্গা— যেন ইতিহাসের একই সুতোয় বাঁধা। সত্যজিৎ রায় যেমন মনে গেঁথে আছে সিনেমাপ্রেমী মানুষের মনে, তেমনি আছে কিশোরী দুর্গা। ওই কিশোরী চরিত্রটিতে জীবন্তরূপে ফুটিয়ে তুলেছিলেন উমা। ওই একটি মাত্র সিনেমাতেই অভিনয় করেছিলেন তিনি, আর তাতেই পেয়েছেন জগৎজোড়া খ্যাতি, হয়ে আছেন বাংলা সিনেমার ইতিহাসের এক অধ্যায়।
উমা দাশগুপ্তের মৃত্যু আমাদের আবার ‘পথের পাঁচালী’কে স্মৃতির পর্দায় জাগিয়ে তুলেছে। বাঁশঝাড়ের মধ্যে দিয়ে যে রাস্তাটা সেটা খানিকটা বুনো গাছে ভরা। ওই পথ দিয়ে ছুটে পালাচ্ছে একটা পুঁচকে মেয়ে। তার নাম দুর্গা। পালাচ্ছে কারণ সে লুকিয়ে কতকগুলো ফল পেড়েছে পাশের বাড়ির বাগান থেকে। তার বুড়ি পিসি ফল খেতে ভালোবাসে। লুকিয়ে লুকিয়ে কোচড় থেকে ফলগুলো পিসিকে দেয়। কয়েকটা ডাঁশা পেয়ারা পিসি যত্ন করে তুলে রাখে মাটির মালসায়।
বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায় অসাধারণ বর্ণনায় ‘পথের পাঁচালী’ উপন্যাসটিকে মূর্ত করে তুলেছিলেন। দুর্গার বয়স দশ/এগারো। ‘গড়ন পাতলা পাতলা, রং তার ছোট ভাই অপুর মত অতটা ফর্সা নয়, একটু চাপা। হাতে কাঁচের চুড়ি, পরনে ময়লা কাপড়, মাথার চুল রুক্ষ-মুখের গড়ন মন্দ নয়, অপুর মত চোখগুলি বেশ ডাগর ডাগর।’ দুর্গার চেহারার বিবরণে অপুর থেকে তেমন কোনো ভয়ঙ্কর তফাৎ না থাকলেও চুলের বর্ণনায় কিছু তফাৎ দেখা যায়। দুর্গার চুল রুক্ষ এবং তেলের অভাবে তা বাতাসে উড়ছে।
উপন্যাসে দুর্গা-অপু একই বৃন্তে দুটি ফুল। স্বভাবে বা প্রকৃতিতে দুর্গা অপুর মতো নয়। দিদির হাত ধরে অপুর জঙ্গলে জঙ্গলে ঘোরায় আছে একটা রোমান্টিক বিস্ময়বোধ এবং মুগ্ধতা কিন্তু দুর্গার মধ্যে তা নেই। সে অনেকটা বাস্তববাদী। অপু ধীর-স্থির-শান্ত ও অর্ন্তমুখী। কিন্তু দুর্গার অবস্থান যেন এর বিপরীত। সে চঞ্চল, একগুঁয়ে এবং অবাধ্য ও লোভী। এর সঙ্গে আরেকটি স্বভাবও তার রয়েছে। অন্যের দ্রব্য সে অনায়াসে অপরের চোখেকে ফাঁকি দিয়ে হাতাতে পারে। জঙ্গলে তার তীক্ষ্ণদৃষ্টি, কেবল কোথায় কি প্রয়োজনীয় জিনিস আছে খুঁজে বার করা। এ সব বিষয়ে অপু, দুর্গার তুলনায় হাঁদা।
যদিও এই দুর্গাই অপুর প্রাকৃতিক বর্ণ পরিচয়ের প্রথম ও প্রধান শিক্ষক। সেই-ই অপুকে প্রথম নিয়ে গিয়েছে জঙ্গলের রাজ্য-প্রকৃতির মাঝখানে। কিন্তু চোর-অবাধ্য-একগুঁয়ে হওয়া সত্ত্বেও দুর্গার মধ্যে ছিল তার ছোট ভাই অপু এবং জনম দুখিনী পিসির জন্য অফুরন্ত মমতা। সহায়হীনা-অবহেলিতা পিসির মরুজীবনে দুর্গা ছিল মরুদ্যান বিশেষ। তার মাঝেই বল্লালী বালাই ইন্দির ঠাকরুণ তার মৃতা মেয়ের প্রতিরূপ খুঁজে পেয়ে সান্ত্বনা পান, দুঃখ ভোলেন। নিঃসঙ্গ পিসিকে সঙ্গ দিয়ে তার একাকীত্বকে দূর করে সে। পিসি-ভাইঝির পারস্পরিক আন্তরিক টানে অনেকেই দুর্গাকে তাই ইন্দির ঠাকরুণের পূর্বজন্মের মেয়ের ভূমিকায় বসিয়ে দেয়।
ছোট্ট ভাই অপুর কাছে অস্তিরমতি দুর্গা রেললাইনের কথা শুনে তার রেলগাড়ি দেখার সাধ জেগেছিল খুব। এরপর নীরেনের সঙ্গে পরিচয়ের পর তাকে ঘিরে যে নবজীবনের আকাঙ্ক্ষা— ওই আকাঙ্ক্ষা রেলগাড়ি দেখার সাধকে যেন আরও তীব্রতর করে দেয়। গোটা ‘পথের পাঁচালী’তে সে অপুর মত কল্পনা কিংবা স্বপ্ন কোনোটাই দেখেনি, কেবল একটিবার ছাড়া। ওই স্বপ্ন নীরেনকে ঘিরে নবজীবনের স্বপ্ন। কিন্তু দুর্গার ওই সাধ-স্বপ্ন কোনোটাই পূর্ণ হয়নি। চুরির অপরাধে মারের চোটে নাকে-মুখে রক্তের দাগ নিয়েও সে একটিবারের জন্য সোনার সিঁদুর কৌটো আত্মসাতের কথা স্বীকার করেনি। বোধহয় নীরেনকে নিয়ে স্বপ্নভঙ্গের ভয়ে।
কিন্তু একদিন সব স্বপ্ন ছিড়ে গেল তার। নিজের কৃতকর্মের জন্য মার খাওয়ার কিছুদিন পর ম্যালেরিয়ায় আক্রান্ত হয়ে দুর্গা শয্যা নিয়েছিল। ওই শয্যাই ছিল তার শেষ শয্যা। তার শেষ শয্যার অন্তিম বাসনা লেখক একটি করুণ আবেদনে শেষ করেছেন। দুর্গা তার ছোট্ট সোনার ভাইটির কাছে শেষ করুণ মিনতি জানিয়ে বলেছে, ‘আমায় একদিন তুই রেলগাড়ী দেখাবি?’ তার রেলগাড়ী দেখা হয়নি। তার এই সামান্য সাধ পূর্ণ হয়নি। অপূর্ণই থেকে গেছে। অন্তিমের অতৃপ্ত বাসনা নিয়ে দুর্গার এই চলে যাওয়া পাঠককে পীড়িত করেছে, বেদনা বিধুর করেছে। ভালো-মন্দে মেশানো দুর্গাই পাঠকের মনের মণিকোঠায় তার কীর্তি-অকীর্তি ও অকাল মৃত্যুর ভেতর দিয়ে একটি স্থায়ী আসন করে নিয়েছে।
আর সত্যজিৎ রায় ক্যামেরা দিয়ে উপন্যাসটিকে জীবন্ত করেছেন। একটি দৃশ্যের কথা মনে করা যাক। হরিহরের ভিটেয় প্রথম সন্ধ্যার দৃশ্য। প্রথমে দেখি, দিন শেষ হয়ে আবার আলো নেভার পর্ব, প্রান্তর থেকে ক্রমশ গুটিয়ে আসি উঠোনে, দাওয়ায়। প্রথমে শেষ বিকেলের আলো; দুর্গা আর অপু মাঠ থেকে ফিরছে রাঙী গাইকে নিয়ে ঘরে। আকাশে কালো মেঘের চাদর ছিঁড়ে উঁকি দিচ্ছে শেষ সূর্য; বাড়ির দেওয়াল, তার পর উঠোন। থিম সঙ্গীত মিলিয়ে গিয়ে ভেসে আসে পল্লী থেকে উঠে আসা শাঁখের আওয়াজ। উঠোনে, তুলসীতলায় প্রণাম করতে আসে একে একে ইন্দির, সর্বজয়া; চলে যায়। এরপর আরও অন্ধকারে আসি বাড়ির দাওয়ায়। তেলের বাতির আধো আলোয় বসে হরিহর আর অপু লেখাপড়া করছে, গায়ে শীতের চাদর। এক ধারে সর্বজয়া গৃহস্থালি কাজে ব্যস্ত। ক্যামেরা বাবা আর ছেলের ওপর এগিয়ে যায়। পাশের দাওয়ার দৃশ্য: দুর্গাকে দেখি সেখানে; ইন্দির ঠাকরুণ এসে যোগ দেয়, শতচ্ছিন্ন শীতের কাঁথা নিয়ে বিড়বিড় করে অভিযোগ জানায়। সর্বজয়ার ডাকে দুর্গা চলে আসে অন্য দাওয়ায়; মার হাতে ছোট একটা চড় খায় চুল না-বাঁধার জন্য। অপু হাসে; দুর্গা সর্বজয়ার সঙ্গে চুল বাঁধতে বসে অন্য ধার থেকে তাকে ভ্যাংচায়। অন্য দাওয়ার আধো অন্ধকারে সূচে সুতো পরাতে গিয়ে বিচিত্র মুখব্যাদান করে ইন্দির। এই দাওয়ায় দেখি চারজনকে। দুর্গা আর সর্বজয়ার কথা হয় চারগাছার বিনুনি নিয়ে, রানুদির বিয়ে নিয়ে। মাঝখানে আর একবার ইন্দিরের মুখে সুতো ভেজানো, এদের দিকে দৃষ্টিপাত। এরপর হরিহর আর অপুর ওপর নিবদ্ধ হয় দৃষ্টি; দূর থেকে ভেসে আসে ট্রেনের শব্দ; অপুর দিকে এগিয়ে যায়; সে অন্ধকারের দিকে চেয়ে শুনছে ওই শব্দ। দুর্গাকে সে জিজ্ঞেস করে কখনও ট্রেন দেখেছে কিনা। দুর্গা বলে দেখেছে। মা বকুনি দেয় মিথ্যে বলার জন্যে। অপুর প্রশ্ন, দিদি কি জানে রেল লাইনটা কোন দিকে; দুর্গা তাকে বলে কেমন করে সেখানে যেতে হয়। দিদি কি তাকে নিয়ে যাবে একদিন? অপুর প্রশ্নের মাঝে হরিহর তার বানান-লেখা স্লেট দেখতে চায়। নতুন শব্দ লিখতে বলে, ‘ঐ ভূত বাপ রে!’