দেশে দ্বিকক্ষবিশিষ্ট সংসদের সুবিধা ও প্রয়োজনীয়তার কথা আলোচিত হচ্ছে। বিশ্বের প্রায় ৪০ শতাংশ পার্লামেন্ট দ্বিকক্ষবিশিষ্ট। Mother of Parliaments-খ্যাত যুক্তরাজ্যের পার্লামেন্টকে আদর্শ ধরে বিশ্বের বেশির ভাগ আইনসভা গঠিত হয়েছে। ১৩৪১ সালে প্রথমবার ইংল্যান্ডের পার্লামেন্টে সাধারণ লোকেরা অভিজাত ও যাজকদের থেকে আলাদাভাবে সভার আয়োজন করেছিল। এর ফলে সংসদে কার্যত উচ্চকক্ষ ও নিম্নকক্ষ গড়ে উঠেছিল। ইংল্যান্ডের পার্লামেন্টের উচ্চকক্ষ হাউজ অব লর্ডস এবং নিম্নকক্ষ হাউজ অব কমন্স নামে পরিচিত। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে উচ্চকক্ষ সিনেট এবং নিম্নকক্ষ প্রতিনিধি সভা। ভারতে রাজ্যসভা ও লোকসভা। আমাদের দেশেও সমাজের বিশিষ্টজনদের সমন্বয়ে উচ্চকক্ষ গড়ে তোলার প্রস্তাব এসেছে, যেটি অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের হালধরা বা রাষ্ট্রক্ষমতার নিয়ন্ত্রণ ও ভারসাম্য বজায় রাখতে সহায়ক হতে পারে।
বাংলাদেশের সংবিধান প্রণয়নের শুরুতে জাতীয় ঐকমত্যের ভিত্তিতে এক-কক্ষবিশিষ্ট বা এককেন্দ্রিক ‘জাতীয় সংসদ’ প্রতিষ্ঠিত হয়। ১৯৭৫ সালে সংবিধানের ৪র্থ সংশোধনীর মধ্য দিয়ে একদলীয় বাকশাল প্রতিষ্ঠা, রাষ্ট্রপতিশাসিত সরকারব্যবস্থা ও সংসদের ক্ষমতা সীমাবদ্ধ করার মধ্য দিয়ে এর কার্যকারিতা অনেকটাই নষ্ট হয়ে যায়। এরপর অব্যাহত থাকে রাষ্ট্রপতিশাসিত সরকারব্যবস্থা। ’৯০-এর গণঅভ্যুত্থানে এরশাদের পতনের পর তিন জোটের রূপরেখা অনুয়ায়ী বিজয়ী বিএনপি বাংলাদেশে আবার সংসদীয় সরকারব্যবস্থা প্রবর্তন করে। যদিও বয়কট ও রাজনৈতিক অস্থিরতায় এর যথাযথ সুফল পায়নি জনগণ।
সুপ্রিমকোর্টের আইনজীবী এবং রাষ্ট্র সংস্কার আন্দোলনের প্রধান সমন্বয়ক হাসনাত কাইয়ুম বলেছেন, সংবিধান সংস্কার দিয়ে রাষ্ট্র সংস্কারের কাজ শুরু করতে হবে। সংবিধানে যেভাবে প্রধানমন্ত্রীকে ক্ষমতা দেওয়া হয়েছে, রাষ্ট্রপতিকে ক্ষমতাহীন করা হয়েছে এবং সংসদকে যেভাবে ক্ষমতাহীন করা হয়েছে, অ্যাটর্নি জেনারেল এবং বিচার বিভাগকে প্রধানমন্ত্রীর অধীনে আনা হয়েছে কিংবা রাষ্ট্রের বিভিন্ন সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠানকে নির্বাহী বিভাগের অধীনে নিয়ে আসা হয়েছে, এসব ব্যাপারে ব্যাপক সংস্কার লাগবে। এ জন্য আমাদের প্রস্তাব হচ্ছে, জরুরি ভিত্তিতে সংস্কার করার জন্য টাস্কফোর্স গঠন করতে হবে। উদাহরণ হিসাবে বলা যায়, বাংলাদেশের নির্বাচন কীভাবে হবে? তার জন্য একটা টাস্কফোর্স হতে পারে। বাংলাদেশের সংসদ বা আইন বিভাগ কীভাবে পরিবর্তিত হবে, তা নির্ধারণের জন্য একটা টাস্কফোর্স গঠিত হতে পারে। যে বিশেষজ্ঞদের নিয়ে এটা গঠিত হবে, তারা একটা নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে মতামত দেবেন।
সাবেক প্রধান নির্বাচন কমিশনার বিচারপতি মোহাম্মদ আবদুর রউফ বলেছেন, নির্বাচন অংশগ্রহণমূলক ও গ্রহণযোগ্য করতে বাংলাদেশের নির্বাচনি প্রক্রিয়া ও ভোটগ্রহণ পদ্ধতি পরিবর্তন করতে হবে। তার মতে, মনোনয়ন বাণিজ্য রাজনৈতিক হানাহানির জন্য দায়ী। তাই জনগণ প্রার্থীকে নয়, দলকে ভোট দেবে। তিনি বলেন, নির্বাচন পদ্ধতি সংস্কার করে রাজনৈতিক দলগুলোর প্রাপ্ত ভোটের আনুপাতিক হারে সংসদে তাদের নিজ নিজ আসন বরাদ্দের ব্যবস্থা রাখতে হবে। দেখা যায় সরকারি ও বিরোধী দলের মোট প্রাপ্তভোট কাছাকাছি হলেও সংসদে তাদের প্রাপ্ত আসনের বিশাল তারতম্য তৈরি হয়। প্রাপ্ত ভোটের ভিত্তিতে আসন বিন্যাস হলে সংসদে কারও একচ্ছত্র আধিপত্য তৈরি হবে না।
রাষ্ট্রবিজ্ঞানী ও যুক্তরাষ্ট্রের ইলিনয় স্টেট বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ড. আলী রীয়াজ বলেছেন, এ গণ-অভ্যুত্থানের আকাঙ্ক্ষা হলো দেশকে স্বৈরশাসনমুক্ত করে গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠা করা। জনগণের এ আকাঙ্ক্ষাকে বাস্তবায়ন করতে হলে সংবিধানের পুনর্লিখন করতে হবে। যদি কোনো দল নির্বাচনে ৩০০ আসনও পায়, তারাও এ সংবিধান পরিবর্তন করতে পারবে না। সংবিধান সংশোধন কোনো কাজে আসবে না জানিয়ে তিনি বলেন, এটি পুনর্লিখন ছাড়া কোনো উপায় নেই। কারণ সংবিধানের ৭ অনুচ্ছেদে ‘ক’ ধারায় এমন কিছু জিনিস আনা হয়েছে যেটি সংশোধন করার কোনো উপায় নেই। তিনি আরও বলেন, সাংবিধানিকভাবে একনায়কতন্ত্রের প্রতিষ্ঠা করা হয়েছে, যার কারণে প্রধানমন্ত্রীর হাতে অভাবনীয় ক্ষমতা। সহনশীলভাবে মতপ্রকাশ এবং মতপ্রকাশে সংখ্যালঘুর নিশ্চয়তা বিধানই হচ্ছে গণতন্ত্র। আমাদের সেই গণতন্ত্র পুনর্গঠন করতে হবে। তাই সংবিধানে হাত দেওয়া ছাড়া আমি আর কোনো পথ দেখতে পাচ্ছি না। ড. আলী রীয়াজ এ লক্ষ্যে গণপরিষদ বা সংবিধান সভার মাধ্যমে সংবিধান প্রণয়ন, ফ্যাসিবাদবিরোধী রাজনৈতিক দল ও সব পক্ষের সঙ্গে আলোচনা, গণশুনানি ও গণভোটের প্রয়োজনীয়তার কথা জানান।
বাংলাদেশের শুরুতে রাজনৈতিক অস্থিরতা, বিশৃঙ্খলা ও অনৈক্য দূর করতে এবং পেশাজীবীদের স্বার্থ সংরক্ষণে প্রথম দ্বিকক্ষবিশিষ্ট পার্লামেন্টের কথা প্রস্তাব করেন বামধারার বিশিষ্ট তাত্ত্বিক সিরাজুল আলম খান। নিরপেক্ষ নির্বাচনের জন্য উচ্চকক্ষসহ দ্বিকক্ষবিশিষ্ট জাতীয় সংসদ গঠন করে নির্বাচন সমস্যার স্থায়ী সমাধানের উদ্যোগ নেওয়ার কথা বলেন জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দলের (জেএসডি) সভাপতি আ স ম আব্দুর রব। তিনি বলেছেন, ‘পার্লামেন্টের নিম্নকক্ষ হবে ৩০০ সদস্যবিশিষ্ট। আর ২০০ সদস্যবিশিষ্ট উচ্চকক্ষে থাকবেন অদলীয়ভাবে নির্বাচিত বিভিন্ন শ্রম ও পেশার প্রতিনিধিরা। নিম্নকক্ষে থাকবেন নির্বাচনে বিভিন্ন দলের প্রাপ্ত আসনের আনুপাতিক প্রতিনিধি। থাকবেন প্রবাসী, রাষ্ট্রপতি কর্তৃক মনোনীত, বিভিন্ন প্রাদেশিক পরিষদের (গঠনের পর) প্রতিনিধি, নারীর ক্ষুদ্র জাতিসত্তার প্রতিনিধিরা।’ তিনি আরও বলেন, ‘পার্লামেন্টে গঠিত এ উচ্চকক্ষ থেকে নির্বাচনকালীন নির্দলীয় সরকার নির্বাচিত হবে এবং ওই সরকার নির্বাচন কমিশন গঠন করলে তা সবার কাছে গ্রহণযোগ্য হবে। নির্বাচন কমিশন হবে পৃথক এবং পূর্ণাঙ্গ। কমিশনের সচিবালয় হবে নির্দলীয় এবং রাজনৈতিক দলের প্রভাবমুক্ত। নির্বাচন কমিশন ইউনিয়ন পর্যন্ত বিস্তৃত থাকবে।’