গোলতাজ বেগমের সংসারে স্বামী-সন্তান নিয়ে অনেক মুখ। ঊর্ধ্বমুখী বাজারে খোলা ট্রাকে চাল কিনতে গিয়েছিলেন তিনি। মেয়ের কানের দুল বন্ধক রেখে কিছু টাকা সুদে এনে তা নিয়ে টিসিবির খোলা ট্রাকের সামনে লাইন ধরেন। ক্ষুধার জ্বালা মেটাতে চাল, ডাল, তেল, পেঁয়াজের টিসিবির খোলা ট্রাকে গোলতাজ বেগম যখন পৌঁছেছেন, কয়েক ঘণ্টা ততক্ষণে পেরিয়ে গেছে। বন্ধকি টাকায় কিছু পণ্য কিনে ফিরে গেছেন বাড়ি। ঘরে অসুস্থ স্বামী, বেকার ছেলে। মেয়ের এক জোড়া স্বর্ণের দুলের বন্ধকি টাকায় কতক্ষণ টিকে থাকবেন, জানেন না চট্টগ্রামের খাজা রোডের বাসিন্দা ৭৫ বছর বয়সী গোলতাজ। দুল বন্ধক রেখে বাজার করার খবর গত ৭ নভেম্বর প্রকাশ হয়েছে ঢাকার একটি সংবাদপত্রে।
গরিবের এই পরিস্থিতি করোনার পর থেকেই। ২০২৩ সালের ফেব্রুয়ারিতে চট্টগ্রামেই গীতা বিশ্বাস নামে এক নারী কয়েক ঘণ্টা দাঁড়িয়ে থেকে যখন চাল শেষ; ট্রাকে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা দেড় কেজি চাল পুঁটলিতে নিয়ে ঘরে ফিরতে চেয়েছেন, তাতেও ব্যর্থ। খোলা ট্রাকের কর্মচারীরা সেই চালও নিতে দেননি গীতা বিশ্বাসকে। এ নিয়ে সমকালেই লিখেছিলাম– ‘গীতা বিশ্বাসের মাথাপিছু আয় ও দেড় কেজি চাল’ (১৪ ফেব্রুয়ারি ২০২৪)।
গীতা বিশ্বাস আর গোলতাজ বেগমের ঘটনার ব্যবধান প্রায় দেড় বছর। এর মধ্যে ঘটে গেছে অনেক কিছু। বৈষম্যের বিরুদ্ধে আন্দোলনে রক্ত ঝরেছে রাজপথে। ক্ষমতা ছেড়ে দেশ ত্যাগ করেছেন শেখ হাসিনা ও তাঁর দলের মন্ত্রী অনেকে। ক্ষমতায় এসেছে নির্দলীয় অন্তর্বর্তী সরকার। কিন্তু গীতা আর গোলতাজ– এ দুই হিন্দু-মুসলমান নারীর ক্ষুধার জ্বালা মেটেনি, বরং বেড়েছে।
এর মধ্যে তর্ক-বিতর্ক চলছে রাষ্ট্র, সংবিধান, ধর্ম, অধর্ম, নিষিদ্ধ, প্রসিদ্ধ নিয়ে। মন্দির, মাজার ভাঙার ঘটনা ঘটেছে। কিন্তু গীতা আর গোলতাজ যেমন ছিলেন, তেমনই আছেন। সভা-সমাবেশ-সেমিনার আর রাষ্ট্র গঠনের তর্ক-বিতর্কে দরিদ্র মানুষের কথা উঠে আসেনি কোথাও। মাথাপিছু আয় বেড়েছে। পরিসংখ্যান বলছে, ২০২৩ সালের ফেব্রুয়ারিতে মাথাপিছু আয় ছিল ২ হাজার ৫৫৪ মার্কিন ডলার; এখন তা বেড়ে হয়েছে ২ হাজার ৭৮৪ মার্কিন ডলার। পরিসংখ্যান আরও বলছে, বিগত সময়ে মূল্যস্ফীতি ছিল ৯.৯২ শতাংশ। এখন তা বেড়ে হয়েছে ১০ দশমিক ৮৭ শতাংশ।
করোনা-পরবর্তী সময়ে দেশে বেকারত্বও বেড়েছে। চরম দারিদ্র্যসীমার নিচে জনসংখ্যার ১৮.৭ শতাংশ। ১৬ লাখ মানুষ এমন খাদ্য ঝুঁকিতে রয়েছে যে, তারা এক বেলার আহার গ্রহণের পর পরবর্তী আহারের সংস্থান করতে পারেন না। এরই মধ্যে বিগত সরকারের চালু করা বয়স্ক ভাতাসহ নানা কর্মসূচি বর্তমান সরকার স্থগিত করেছে।
বড় ঘোষণা দিয়ে বাংলাদেশে মুক্তবাজার অর্থনীতির যাত্রা শুরু ১৯৯১ সালে। বিশ্বজুড়েই বাজার অর্থনীতির রাষ্ট্রগুলো খাদ্য, শিক্ষা, স্বাস্থ্য, চিকিৎসা, বাসস্থানের মতো মৌলিক খাতে ঢালাও মুক্তবাজার আনেনি। বাংলাদেশসহ কিছু দেশ বিশ্বব্যাংক, আইএমএফের পরামর্শে এমনভাবে বাজার অর্থনীতির চর্চা করেছে; সরকার নিজে থেকেই ক্ষমতা পুঁজিপতিদের হাতে তুলে দিয়েছে। ট্রেডিং করপোরেশন অব বাংলাদেশ-টিসিবিকে অথর্ব করে খাদ্যপণ্য আমদানি বেসরকারি খাতের হাতে তুলে দিয়েছে। টিসিবি যদি প্রান্তিক দরিদ্র শ্রেণির মানুষের চাহিদা বিবেচনা করে খাদ্যপণ্য আমদানির ধারা চালু রাখতে পারত তাহলে গোটা বাজার বেসরকারি পুঁজিপতির কাছে চলে যেত না। আগের সরকার বাধ্য হয়ে টিসিবিকে আবার সক্রিয় করে। কিন্তু দুর্নীতি, রাজনৈতিক প্রভাব ও লুটপাটের অর্থনীতি সেই কার্যক্রমকে বেশিদূর এগোতে দেয়নি।