টাকা-পয়সা সবসময়ই একটি সংবেদনশীল বিষয়। আমাদের দৈনন্দিন জীবনে প্রয়োজনীয়তা মেটাতে যেমন টাকা অপরিহার্য, তেমনই এটি সম্পর্কের মধ্যে জটিলতা আনতে পারে। পরিবারের সদস্য, আত্মীয়-স্বজন বা বন্ধুদের মাঝে টাকার লেনদেন প্রায়ই ঘটে থাকে। অনেকেই বিপদে পড়ে নিকটজনের কাছে সাহায্য চান, এবং আপনি হয়তো দায়িত্ববোধের কারণে টাকা দিয়ে সাহায্য করেন। তবে প্রশ্ন হলো, নিকটজনের হাতে টাকা রাখা বা তাদের সাহায্য করা কতটা নিরাপদ? ইতিহাসে এর ভালো ও খারাপ দুই ধরনের উদাহরণই রয়েছে। কখনও সম্পর্কগুলো আরও মজবুত হয়েছে, আবার কখনও টাকা-পয়সার কারণে পরিবারে ভাঙনও দেখা দিয়েছে।
টাকা একটি শক্তিশালী টুল। এটি যেমন মানুষকে উপরে তুলে আনতে পারে, তেমনই সম্পর্ক ধ্বংস করতেও সক্ষম। ফলে, টাকা ব্যবহার বা লেনদেন করার সময় যথেষ্ট সতর্ক থাকা উচিত। ওয়ার্ল্ড ইকোনমিক ফোরাম এর এক গবেষণায় বলা হয়েছে, "টাকা যেভাবে ব্যবহার করা হয়, তা একজনের ব্যক্তিত্ব এবং সম্পর্কের মানকেও প্রভাবিত করে"। টাকার সঠিক ব্যবহারের অভাব হলে তা অপ্রত্যাশিত ক্ষতির কারণ হয়ে দাঁড়াতে পারে।
আপনজনদের কাছ থেকে সাহায্য চাওয়ার সময়, তাদের বিশ্বাস করার প্রবণতা স্বাভাবিক। তবে কাছের মানুষের দ্বারা ক্ষতির শিকার হওয়ার উদাহরণও অনেক রয়েছে। যেমন, আপনার ভাই বা বোন যদি ব্যবসার জন্য টাকা ধার চান, আপনি হয়তো বিশ্বাসের বশে সেই টাকা তাদের হাতে তুলে দেবেন। কিন্তু যদি সেই ব্যবসা ক্ষতিগ্রস্ত হয় বা তারা টাকা ফেরত দিতে না পারেন, তখন সম্পর্কের মাঝে বিভাজন দেখা দেয়। এই বিষয়গুলোই টাকার ক্ষেত্রে অত্যন্ত স্পর্শকাতর। ন্যাশনাল ফিনান্সিয়াল এডুকেশন কাউন্সিল এর মতে, পরিবারের সদস্যদের কাছে টাকা ধার দেওয়ার ফলে প্রায় ৩৫% ক্ষেত্রে সম্পর্কের মধ্যে ভাঙন দেখা দেয়।
অনেকেই বলেন, "টাকা ধার দিয়ে সম্পর্ক নষ্ট করা ঠিক নয়।" তবে আপনি যদি নিকটজনকে সত্যিই সাহায্য করতে চান, তাহলে অবশ্যই টাকার ব্যাপারে সুস্পষ্ট নীতি এবং লিখিত নথি প্রস্তুত করা উচিত। একজন মানুষ আপনার টাকা ধার নিলে তার দায়িত্ব থাকে তা ফেরত দেওয়ার। কিন্তু কাছের মানুষদের ক্ষেত্রে প্রায়ই দেখা যায়, টাকার ব্যাপারে সতর্কতা কম থাকে। ইন্টারন্যাশনাল মনিটারি ফান্ড এর ২০১৮ সালের গবেষণায় বলা হয়েছে, "টাকা ধার দেওয়ার সময় লিখিত চুক্তি না থাকলে প্রায় ৪০% ক্ষেত্রে অর্থ ফেরত পাওয়া সম্ভব হয় না।"
আপনজনদের টাকা ধার দেওয়ার ক্ষেত্রে একটি গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন হলো, সেই ব্যক্তি টাকার সঠিক ব্যবহার জানেন কিনা। আপনি যদি এমন কাউকে টাকা ধার দেন, যার অর্থ ব্যবস্থাপনা দুর্বল, তাহলে তিনি সেই টাকা অপ্রয়োজনীয়ভাবে খরচ করতে পারেন। উদাহরণস্বরূপ, অনেক সময় দেখা যায়, টাকা ধার নেওয়ার পর তা সঠিক কাজে ব্যয় না করে, ব্যক্তিগত খাতে ব্যবহার করা হয়। ফলে, টাকা ফেরত আসা তো দূরে থাক, সম্পর্কও ধীরে ধীরে খারাপ হয়ে যায়। একটি উদাহরণ হলো, এক ব্যক্তি তার বন্ধুকে ব্যবসার জন্য টাকা দিয়েছিলেন, কিন্তু সেই বন্ধু সেই টাকা ব্যক্তিগত কাজে খরচ করে। ফলস্বরূপ, সম্পর্কটি নষ্ট হয়ে যায় এবং তারা আর কখনও যোগাযোগ করেনি।
কিছু ক্ষেত্রে, টাকা ধার দেওয়ার পরে সেই টাকা ফেরত পাওয়া কঠিন হয়ে দাঁড়ায়। কারণ, নিকটজনদের উপর প্রায়ই কঠোর নিয়ম প্রয়োগ করা সম্ভব হয় না। তারা হয়তো ভাবেন, সম্পর্কের খাতিরে আপনি তাদের চাপ দেবেন না, ফলে তারা সেই অর্থ ফেরত দিতে উদাসীন হয়ে ওঠে। এই ধরনের উদাসীনতা সম্পর্কের ক্ষতি করে এবং অবশেষে দূরত্ব তৈরি হয়।
অর্থ ব্যবস্থাপনার ক্ষেত্রে ইসলাম ধর্মেও কিছু নির্দেশনা রয়েছে। ইসলামিক নীতি অনুযায়ী, কারও কাছে টাকা ধার দিলে তা সঠিকভাবে ফেরত দেওয়া একটি নৈতিক দায়িত্ব। এমনকি, কেউ যদি ব্যবসায়িকভাবে ক্ষতিগ্রস্তও হন, তাহলে তাদের দায়িত্ব থাকে টাকার যথাযথ ব্যবস্থা করে তা ফেরত দেওয়ার। এই নীতি থেকে বোঝা যায়, টাকার লেনদেন যতই পরিবার বা বন্ধুর মধ্যে হোক, একটি চুক্তি বা নৈতিক দায়িত্ব মেনে চলা জরুরি।