কোভিড মহামারি থেকে বিশ্ব এখন বেরিয়ে এলেও অর্থনীতিতে এর বিরূপ প্রভাব এখনো বিরাজমান। এর মধ্যে ফেব্রুয়ারি থেকে ইউক্রেন-রাশিয়া যুদ্ধ যেন আগুনে ঘি ঢালার মতো কাজ করেছে। এসব কারণে তীব্র জ্বালানি সংকট, খাদ্য সরবরাহ কমে যাওয়া, উৎপাদন ব্যয় বৃদ্ধির মতো সমস্যার সাথে বড় সমস্যা দেখা দিয়েছে মূল্যস্ফীতি।
মূল্যস্ফীতি অর্থনীতির একটি স্বাভাবিক চিত্র হলেও বড় ধরনের মুদ্রাস্ফীতিকে অর্থনীতির জন্য অভিঘাত হিসেবে দেখা হয়। মুদ্রাস্ফীতি হলো, একটি অর্থনীতিতে পণ্য ও পরিসেবার দামের একটি সাধারণ বৃদ্ধি। অর্থাৎ দ্রব্য বা সেবার দাম বেড়ে গেলে স্থানীয় মুদ্রা দিয়ে ঐ দ্রব্য বা সেবা কিনতে বেশি পরিমাণ মুদ্রা খরচ করতে হয় বা একই পরিমাণ মুদ্রা দিয়ে দ্রব্য বা সেবা কিনতে গেলে আগের চেয়ে কম পরিমাণ পাওয়া যায়।
আধুনিক অর্থনীতি, দেশে সবসময় একটি স্বল্প কিন্তু স্থিতিশীল মুদ্রাস্ফীতির পক্ষে মতামত দেয়। কারণ স্বল্পমাত্রার ও স্থিতিশীল মুদ্রাস্ফীতি, অর্থনীতির সূচকগুলো সচল রাখে এবং এর বাজারগুলো বিভিন্ন অর্থনৈতিক মন্দার মধ্যেও সচল ও স্থিতিশীল রাখে।
তাই সাধারণত ২ থেকে ৫ শতাংশ মুদ্রাস্ফীতি থাকলে সেটাকে সহনীয় বলা যায় কিন্তু তা বৃদ্ধি পেয়ে ৭ থেকে ১০ শতাংশ হলে মধ্য ও নিম্নবিত্ত আয়ের মানুষের কষ্ট বেড়ে যায়। এবং এর চেয়ে বেশি মুদ্রাস্ফীতি পুরো দেশের জন্য বিপর্যয় ডেকে আনতে পারে।
তাত্ত্বিকভাবে চাহিদা ও জোগানের অসমতাই মূল্যস্ফীতির প্রধান কারণ। উৎপাদন খরচ বেড়ে গেলে অথবা প্রাকৃতিক দুর্যোগসংক্রান্ত কোনো কারণে পণ্যের সরবরাহ কমে গেলে (cost-push) ব্যয় প্রভাব মূল্যস্ফীতি ঘটে।
অন্যদিকে সরকারের সম্প্রসারণমূলক উন্নয়ন নীতি, বেতন বৃদ্ধি, ঘাটতি বাজেট পূরণ, কেন্দ্রীয় ব্যাংক সুদের হার কমানো ইত্যাদি নীতির ফলে সামগ্রিক চাহিদা বেড়ে (demand-pull) চাহিদা প্রভাব ধরনের মুদ্রাস্ফীতি ঘটে।
কোনো দেশের অর্থনীতির আকারের তুলনায় ছাপানো মুদ্রার পরিমাণ অনেক বেশি হলে মুদ্রার একক মান হ্রাস পায়, মূল্যস্ফীতি ঘটে। এছাড়াও রপ্তানি আয় বৃদ্ধি, নতুন বেতন স্কেল প্রদান, প্রশাসনিক খরচ বৃদ্ধি, আমদানি খরচ বৃদ্ধি, সহজ শর্তে বেশি পরিমাণ ঋণ ছাড়করণের নীতি, খাদ্য ঘটতি, চোরাচালান, হুন্ডি, বাজার ব্যবস্থাপনার দুর্বলতা—এসব মূল্যস্ফীতির কারণ হিসেবে চিহ্নিত করা হয়ে থাকে।
মূল্যস্ফীতির ফলে নগদ অর্থের ব্যয় কমে যায়। মানুষ নগদ অর্থের সঞ্চয়ের পরিবর্তে খরচ করে। এর ফলে আর্থিক প্রতিষ্ঠান সঞ্চয়ের অভাবে ভোগে এবং অর্থনীতিতে বিনিয়োগ কমে আসে। এছাড়াও কাঁচামালের মূল্য বেড়ে যাওয়ায় সামগ্রিক উৎপাদন খরচের ওপর এর প্রভাব পড়ে।
এমন অবস্থায় উৎপাদন কমার আশঙ্কা দেখা দেয়। উৎপাদন কমে গেলে অনেকের কর্মসংস্থান হারানোর শঙ্কা থাকে। মুদ্রাস্ফীতি সমাজে আয় বণ্টনের বৈষম্য করে, অর্থনীতিতে একটা সার্বিক অস্থিতিশীল পরিবেশ সৃষ্টি করে। মুদ্রাস্ফীতির ফলে মুদ্রার মূল্য কমে যায় এবং স্থির আয়ের মানুষের জীবনযাত্রার মান নিচে নেমে আসে। কেন্দ্রীয় ব্যাংককে সুদের প্রকৃত হার পুনরায় নিরূপণ করতে হয়।