কোনো ঋণ কেন মন্দ ঋণে পরিণত হয়? কীভাবে আমরা ঋণক্ষতি এড়াতে পারব? ঋণ সাধারণত মন্দ হয় যেসব কারণে, তা হলো ১. ঋণ প্রয়োজনীয়তার দুর্বল মূল্যায়ন, ২. ঋণসংশ্লিষ্ট ভুল পরিকল্পনা, ৩. প্রয়োজনীয় নিরাপত্তা বা জামানতের ঘাটতি, ৪. ব্যবসায় অভ্যন্তরীণ নগদ অর্থের দুর্বল জোগান পুরোনো বকেয়ার পুনরাবৃত্তি ঘটায়, ৫. ব্যবসার ভিত্তি কিংবা ভবিষ্যৎ সম্ভাবনা অথবা এমনকি ধারাবাহিকতার দিকে না তাকিয়ে শুধু ঋণগ্রহীতার নামের ওপর ভর করে ঋণ প্রদান, ৬. প্রতিযোগিতা অথবা উদীয়মান প্রতিযোগিতা সম্পর্কে ব্যাংক কর্মকর্তার অজ্ঞতা এবং ৭. অর্থনৈতিক মন্দা অথবা মূলধারা বাদ দিয়ে অন্যান্য কম গুরুত্বপূর্ণ ব্যবসায় বিনিয়োগ।
এ কারণগুলোর সঙ্গে আরও যোগ করতে হবে দুর্বল ঋণ মূল্যায়ন, বৈদেশিক মুদ্রা বিনিময়ের ঝুঁকি বুঝতে না পারার ব্যর্থতা, ঋণ কর্মকর্তাদের দুর্নীতি বা ব্যর্থতা, ন্যূনতম প্রয়োজনীয় শর্ত পূরণ করতে না পারলেও ঋণ দেওয়া অথবা যথাযথ নজরদারির অভাব।
ইন্দোনেশিয়ায় ঋণ কর্মকর্তার বৈদেশিক মুদ্রা রূপান্তর বা মুদ্রা বিনিময় হার ওঠা-নামার ঝুঁকি বুঝতে না পারার ব্যর্থতায় অনেক ঋণকে মন্দ হতে দেখা গেছে। মেয়াদি প্রকল্পের অর্থায়নের কাজে স্বল্পমেয়াদি চলতি ঋণের ব্যবহার মালয়েশিয়ায় অনেক ঋণ মন্দ হতে দেখা গেছে। এই পরিস্থিতি অনেকটাই বাংলাদেশের মতো। তাইওয়ানে অনেক মিডল মার্কেট ঋণ মন্দ হয়ে গিয়েছিল। এর কারণ ছিল ট্রেড সাইকেলের তুলনায় ঋণ পরিশোধে সময় কম দেওয়া। ভারতে তীব্র প্রতিযোগিতার কারণে জামানতের ঘাটতি নিয়েও ব্যাংকগুলো ঋণ দিয়েছে।
পূর্ব আফ্রিকার বেশির ভাগ ঋণ মন্দ হওয়ার পেছনে অন্যতম কারণ ব্যাংক কর্মকর্তাদের ব্যবসায়ের ঝুঁকি নিরূপণের দক্ষতার অভাব। এ জন্য ঋণগ্রহীতারা মিথ্যা তথ্য দিয়ে মোটা অঙ্কের অর্থ তুলে নিয়ে যান।
এমনকি সম্প্রতি আমরা বাংলাদেশে দেখেছি কীভাবে শিল্পঋণ শেয়ারবাজারে বিনিয়োগ করা হচ্ছে। ঋণ নেওয়ার ক্ষেত্রে ‘নেম ল্যান্ডিং’ বা ‘ইনফ্লুয়েন্সড লেন্ডিং’ বলে কথা চালু আছে। এখানে একজন ঋণগ্রহীতা তার ঋণসংশ্লিষ্ট সুনামকে বাজারে সুনাম নেই, এমন কাউকে ঋণ পেতে সহযোগিতা করে।
পাকিস্তানে এই প্রক্রিয়া অনেক ব্যাংককে দেউলিয়া হওয়ার পথে ঠেলে দিয়েছে। এ ক্ষেত্রে লাতিন আমেরিকার ঘটনাগুলো আবার বৈদেশিক মুদ্রার ওপর অতিরিক্ত নির্ভরশীলতা–সংশ্লিষ্ট। আর ইউরোপ, এমনকি উত্তর আমেরিকার ঘটনাগুলো জড়িত অন্তর্নিহিত সম্পত্তি মূল্যের চরম পতন, যা সেখান থেকে বের হয়ে আসাকে প্রায় অসম্ভব করে দেয়।
গ্রাহক যে–ই হোন অথবা যে ব্যবসাই করুক না কেন, ঋণ কর্মকর্তাকে ব্যবসার জন্য গ্রাহকের কী পরিমাণ অর্থ প্রয়োজন এবং কী আদলে তা দেওয়া হবে, তা নিয়ে গভীরভাবে পর্যালোচনা করতে হবে। যদি আপনার কানে কিছু পানি প্রবেশ করে, তবে ওই পানিকে বের করার জন্য আপনাকে আরও কিছু পানি প্রবেশ করাতে হবে। তাই ঋণ দেওয়ার আগে ঋণ কর্মকর্তাকে ব্যবসা মডেলের দিকে তাকাতে হবে। দেখতে হবে অনুমিত টার্নওভার কত, অ্যান্ড টু এল ট্রানজেকশনের মেয়াদ বা ধরন। এরপর সব হিসাব মিলিয়ে একটি অঙ্ক দাঁড় করাতে হবে এবং অবশ্যই জানতে হবে, এই অঙ্কের কতটা ব্যাংক অর্থায়ন করবে এবং কতটা মালিক বা ঋণগ্রহীতা।
এ–ও দেখা গেছে যে গ্রাহকের ১৫০ দিনের জন্য ঋণ দরকার অথচ ব্যাংক সময় দিচ্ছে মাত্র ১২০ দিনের। এমন কারণেও কিন্তু ঋণ মন্দ হয়ে পড়ে। ট্রেড সাইকেলের পাশাপাশি আরও কিছুদিন সময় দিয়ে ঋণ পরিশোধের সময় বা কাঠামো ঠিক করা উচিত।
আমরা প্রায়ই দেখি, মার্কেটিং বা রিলেশনশিপ ম্যানেজাররা কিছু অনুমোদিত জামানত শর্তের ওপর ভিত্তি করে ঋণ নিয়ে প্রচারণা চালান এবং অনেক সময় কিছু প্রক্রিয়া বাকি রেখেই ঋণ ছাড় করে দেন। যদি ‘অনুমোদন শর্ত’ তদারক–ব্যবস্থা না থাকে, তবে হয়তো নিরাপত্তা বা জামানত সম্পাদন বছরের পর বছর ঝুলে থাকে এবং শেষমেশ মন্দে পরিণত হয়। ঋণ কর্মকর্তাকে অবশ্যই সব সময় চেষ্টা করতে হবে সবচেয়ে ভালো জামানত জমা নিতে। অন্যদিকে জামানতের নিয়মিত মূল্য নির্ধারণ ঋণ সংস্কৃতির অংশ হওয়া উচিত।
বর্জ্য নিষ্কাশনব্যবস্থা থাকতে হবে, নদী দূষণ করা যাবে না—কর্তৃপক্ষের এ ধরনের বাধ্যবাধকতা না মানার কারণেও ঋণ মন্দে পরিণত হতে দেখা যায়। এসব নিয়ম না মানলে সামাজিক গোষ্ঠীগুলো এসব কারখানা বন্ধ করতে কর্তৃপক্ষকে বাধ্য করে বা করতে পারে। ভুল ভূমি অধিগ্রহণ, যেমন স্কুল বা প্রার্থনার জায়গা নিয়ে কারখানা স্থাপন করতে গেলে বাধা আসতে পারে। এর ফলে কোম্পানিকে কারখানা অন্য কোথাও সরিয়ে নিতে হতে পারে, যার ফলে অবধারিতভাবে প্রকল্প ব্যয় বেড়ে যায়। এ ছাড়া মূল ব্যক্তির মৃত্যু হলে এবং তার কোনো যোগ্য উত্তরসূরি না থাকলে অনেক ঋণই ঝুঁকিতে পড়ে।