পলিথিনের বিধ্বংসী প্রলয়

দেশ রূপান্তর নিতাই চন্দ্র রায় প্রকাশিত: ০৩ নভেম্বর ২০২৪, ০৯:৩৫

পলিথিন পারমাণবিক বোমার চেয়েও ভয়াবহ। এটি মাটি, পানি ও বাতাস বিধ্বংসের মারণাাস্ত্র। শুধু মানুষের জন্য নয়, গাছপালা, লতা-গুল্ম, জীব-জন্তুর জন্য হুমকি পলিথিন ব্যবহার। পরিবেশ না বাঁচলে বাংলাদেশ বাঁচবে না। বাঁচবে না পরবর্তী প্রজন্মের স্বপ্ন, সাধ ও সাধনা। ২০০২ সালে পলিথিন নিষিদ্ধের কঠোর আইন প্রণয়ন করা হলেও গত ২২ বছরে এর সফল প্রয়োগের কোনো লক্ষণই বাংলাদেশে দৃশ্যমান নয়। বরং দিন দিন পরিবেশ বিধ্বংসী পণ্যটির ব্যবহার বাড়ছে এবং পরিবেশকে বিপন্ন করে তুলছে। বিশ্বে প্রতি মিনিটে ১০ লাখের বেশি এবং বছরে ৫ লাখ কোটি পলিথিন ব্যাগ ব্যবহার করা হচ্ছে। মাত্র ১ শতাংশ পুনর্ব্যবহারের জন্য প্রক্রিয়াজাত করা হয়। সমুদ্রে ফেলা হয় ১০ শতাংশ। এসব পলিব্যাগ ১০০ বছরেও পচনশীল নয় এবং মাটির সঙ্গেও মিশে না। 


আজ থেকে ৪-৫ বছর আগে ময়মনসিংহ বিভাগকে পলিথিনমুক্ত বিভাগ এবং জেলাকে পলিথিনমুক্ত জেলা ঘোষণা করেও পলিথিনের বিপণন ও ব্যবহার বন্ধ করা যায়নি, পলিথিনের বিকল্প ব্যাগের অভাব এবং ভোক্তা ও ব্যবসায়ীদের অসহযোগিতার কারণে। সুপারশপের পর এবার কাঁচাবাজারগুলোতে পলিথিনের তৈরি ব্যাগ ব্যবহার নিষিদ্ধের কথা জানিয়েছেন পরিবেশ, বন ও জলবায়ু পরিবর্তন মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা সৈয়দা রিজওয়ানা হক। ঘোষণা অনুযায়ী ১ অক্টোবর রাজধানীর সুপারশপগুলোতে পলিথিন ব্যাগের ব্যবহার নিষিদ্ধ হয়েছে। উপদেষ্টা সৈয়দা রিজওয়ানা হকের এই পদক্ষেপকে অভিনন্দন জানাই। গত ২৪ সেপ্টেম্বর, মোহাম্মদপুরের টাউন হল ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশন কাঁচাবাজার বণিক সমিতি অফিসে ‘পলিথিন শপিংব্যাগ বন্ধে বিদ্যমান চ্যালেঞ্জ ও সম্ভাবনা’ বিষয়ে আয়োজিত মতবিনিময় সভায় পরিবেশ, বন, জলবায়ু পরির্তন মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা পলিথিন ব্যাগ বন্ধের ব্যাপারে সরকারের গৃহীত চূড়ান্ত সিদ্ধান্তের কথা জানান। বিদ্যমান নিষেধাজ্ঞা কঠোরভাবে বাস্তবায়নের লক্ষ্যে টাউন হল কাঁচাবাজারে ক্লিন-আপ কার্যক্রম উদ্বোধন করেন উপদেষ্টা। কারণ পলিথিন বা পলিইথিলিন উৎপন্ন হয় ইথিলিন থেকে। যদিও ইথিলিন নবায়নযোগ্য সম্পদ থেকে উৎপন্ন হতে পারে, কিন্তু পলিথিন প্রধানত পেট্রোলিয়াম থেকে উৎপন্ন হয়। পলিইথিলিনের ব্যাপক ব্যবহার বর্জ্য ব্যবস্থাপনার জন্য ভয়ংকর অসুবিধার সৃষ্টি করে যদি এটিকে পুনর্ব্যবহারযোগ্য করে না  তোলা হয়। কারণ পলিইথিলিন অন্যান্য কৃত্রিম প্লাস্টিকের মতো সহজে পরিবেশে মিশতে পারে না। এর ব্যাপক ব্যবহার বর্জ্য ব্যবস্থাপনার জন্য অসুবিধার সৃষ্টি করে যদি পুনর্ব্যবহারযোগ্য করে না তোলা হয়। তার বক্তব্য থেকে জানা যায়, কাঁচাবাজারগুলো যাতে আর পলিথিন ব্যাগ ব্যবহার না করে সে জন্য সরকারের পক্ষ থেকে বিভিন্ন কর্মসূচি গ্রহণ করা হয়েছে।



বাংলাদেশ পরিবেশ সংরক্ষণ আইন ১৯৫ (সংশোধন-২০০২) অনুযায়ী, পরিবেশ ও জনস্বাস্থ্য সুরক্ষার কথা ভেবে সরকার পলিথিন ব্যাগ বিক্রি ও ব্যবহার নিষিদ্ধ ঘোষণা করে। এই আইনে পলিথিন উৎপাদন ও বাজারজাতকরণের সর্বনিম্ন শাস্তি ১০ হাজার টাকা জরিমানাসহ ৬ মাসের সশ্রম কারাদণ্ড এবং পলিথিন ব্যবহারকারীকে তাৎক্ষণিকভাবে ৫০০ টাকা জরিমানা করার বিধান রয়েছে।


শুধু সুপারশপ নয়, সারা দেশের কাঁচাবাজার, মাছ-মাংসের বাজার, মুদি দোকান সব জায়গার পলিথিনের অবাধ ব্যবহার। স্বল্পমূল্য ও সহজলভ্যতার কারণে মানুষ না জেনে, না বুঝে পলিথিন ব্যবহার করে পরিবেশের ক্ষতি করছে। ডেকে আনছে নিজের সর্বনাশ। এক কেজি আলু, আধা কেজি পটোল, এমনকি আড়াইশ গ্রাম কাঁচা মরিচ কিনলেও হাতে ধরিয়ে দেওয়া হয় পলিথিনের ব্যাগ। মাছ মাংস ডিম কিনলে তো কথাই নেই, পারলে ডবল পলিথিনে মুড়ে দেওয়া হয় পণ্যগুলো। ভাবতে অবাক লাগে এখন ভোজ্যতেল, ঘি ও মধুর মতো তরল পদার্থ কিনলেও তা পলিথিন ব্যাগের মাধ্যমেই সরবরাহ করা হয়! অথচ আগে এসব তরল খাদ্যপণ্য বিক্রি করা হতো কাচের বোতলে। আর পাটের ব্যাগ তো কবেই উঠে গেছে? কৃষি, স্বাস্থ্য, মৎস্য, নৌপরিবহন এমনকি সমুদ্র অর্থনীতির জন্যও পলিথিন ও প্লাস্টিকের ব্যবহার মারাত্মক ক্ষতির কারণ দাঁড়িয়েছে।


কৃষিক্ষেত্রে পলিথিন সূর্যের আলো ফসলের গোড়ায় পোঁছাতে দেয় না। ফলে মাটির ক্ষতিকারক অণুজীব মারা না যওয়ার কারণে জমির উৎপাদন ক্ষমতা হ্রাস পায়। পলিথিনের বিষাক্ত প্রভাবে পুকুর, খাল, বিল, নদী-নালা ও সাগরের মাছসহ বিভিন্ন জলজ প্রাণী মারা যাচ্ছে। পলিথিন থেকে নির্গত হয় বায়োফিনাইল ও ডায়োঅক্সিন। এগুলো মানুষের স্বাস্থ্যের জন্য মারাত্মক ক্ষতিকর। এর প্রভাবে ক্যানসারসহ বিভিন্ন মারাত্মক রোগ হতে পারে। এ ছাড়া পলিথিন ব্যাগ বা অন্যান্য সামগ্রী থেকে মানুষের রক্ত, মস্তিষ্ক ও লিভারে সূক্ষ্ম মাইক্রো প্লাস্টিকের অস্তিত্ব পাওয়া যাচ্ছে। পলিথিন মানবদেহে হরমোন উৎপাদনে বাধাগ্রস্ত করছে। বন্ধ্যত্বসহ গর্ভবতী মায়ের ভ্রুণ নষ্ট এবং কিডনি বিকল করে দিতে পারে এই পলিথিন। রঙিন পলিথিন জনস্বাস্থ্যের জন্য আরও বেশি ক্ষতিকর। এ থেকে নির্গত ক্যাডমিয়াম শিশুদের হাড়ের বৃদ্ধি বাধাগ্রস্ত করে এবং উচ্চ রক্তচাপের ঝুঁকি বাড়ায়।


বাংলাদেশে প্রতিদিন যে পরিমাণ প্লাস্টিক বর্জ্য তৈরি হয়, অনেক দেশে এক মাসেও সে পরিমাণ প্লাস্টিক বর্জ্য তৈরি হয় না। বাংলাদেশে প্রতিদিন চার থেকে সাড়ে চার হাজার টন বর্জ্য তৈরি হয়। এর ১৭ শতাংশই প্লাস্টিক জাতীয়। এসব বর্জ্যরে অর্ধেকই সরাসরি পানিতে বা নিচু জমিতে ফেলা হয়। জানা যায়, ঢাকা শহরেই প্রতিদিন ১২৪ টন প্লাস্টিক জাতীয় বর্জ্য তৈরি হয়, যার ৮৬ শতাংশ আবার ব্যবহার করা হয়। বাকি যে অংশটি ব্যবহার করা হয় না, তার বেশিরভাগই পলিথিন। এগুলো সরাসরি মাটি ও পানিতে গিয়ে জমা হচ্ছে। একই সঙ্গে তা খাদ্যচক্রে প্রবেশ করে মানুষসহ অন্যান্য প্রাণীর শরীরে প্রবেশ করছে। ফলে ক্যানসারসহ নানা রোগ তৈরিতে বড় ভূমিকা রাখছে এই পলিথিন। বাংলাদেশে প্লাস্টিকের অতি সূক্ষ্ম কণা মাছসহ অন্যান্য প্রাণীর দেহে প্রবেশ করছে। ঢাকা, চট্টগ্রাম ও সিলেটের বাজারে যেসব রুই, লাইট্টা, চিংড়ি ও সার্ডিন মাছ বিক্রি হয়, তার অর্ধেকের বেশির দেহে ক্ষুদ্র প্লাস্টিক কণা পাওয়া যাচ্ছে। এভাবে যদি চলতে থাকে, প্লাস্টিক দূষণ যদি নিয়ন্ত্রণ না হয়, তাহলে তা দেশের জন্য মারাত্মক স্বাস্থ্যঝুঁকি তৈরি করবে।

সম্পূর্ণ আর্টিকেলটি পড়ুন
ট্রেন্ডিং

সংবাদ সূত্র

News

The Largest News Aggregator
in Bengali Language

Email: [email protected]

Follow us