বিশ শতকের একেবারে শুরুতেই মহারাষ্ট্রে এবং বাংলা প্রদেশে বিপ্লববাদী গুপ্ত সমিতি গড়ে উঠতে থাকে। ব্রিটিশ সরকারের বিভিন্ন গোয়েন্দা সংস্থা এই ধারার কর্মকাণ্ড ও সংগঠন সম্পর্কে নানা তথ্য জেনে যায় এবং তাদের দমন করার ও শেষ করে দেওয়ার নানা পরিকল্পনা ও কর্মসূচি নিয়ে কাজ করতে থাকে। বাংলা প্রদেশে অনুশীলন সমিতি গড়ে ওঠে ১৯০২ সালে। ১৯০৫ সালে বঙ্গভঙ্গবিরোধী আন্দোলন শুরু হলে অনুশীলন সমিতি তার কর্মকাণ্ড বাড়ায় এবং দ্রুত বিকশিত হতে থাকে।
বিপ্লববাদীরা যে পদ্ধতিতে কাজ করতেন, তা ছিল অনেকটা নকশালপন্থী ও সর্বহারা পার্টির কার্যক্রমের মতো। অনুশীলন সমিতি যখন বাড়ন্ত, তখন সমিতির ভেতরে মতভেদ দেখা যায় এবং সমস্যার সমাধান করতে না পেরে কিছু সদস্য অনুশীলন ত্যাগ করে যুগান্তর নামে নতুন গুপ্ত সমিতি গড়ে তোলেন। যুগান্তর বাড়তে থাকে এবং ক্রমাগত নানাভাবে ভাঙতে থাকে। ১৯৬০-এর দশকের শেষ দিক থেকে পূর্ব পাকিস্তানের কমিউনিস্ট পার্টি যেভাবে ভাঙছিল, সেকালের বিপ্লববাদী সংগঠনগুলো সেভাবেই ভেঙে চলছিল।
বিপ্লববাদী ও কমিউনিস্টরা দলের মধ্যে নেতৃত্বের সমস্যার সমাধান করতে পারেননি। এই ধারার কোনো দল একটু বড় হলেই তা ভেঙেছে। বলা হয়েছে, আদর্শগত মতভিন্নতার কারণে দল ভেঙেছে। কিন্তু বাস্তবে দেখা গেছে, সভাপতি কিংবা সাধারণ সম্পাদক কে হবেন, তা নিয়ে বিরোধের কারণে দল ভেঙেছে।
বিপ্লববাদী ও কমিউনিস্টরাও জনগণের মধ্যে যাননি—যেতে পারেননি। বিপ্লববাদী যুগান্তর দলের নেতা সূর্য সেনের নেতৃত্বে চট্টগ্রামের অস্ত্রাগার দখল এবং অস্ত্রাদি নিয়ে যাওয়া ছিল সারা ভারতে বিপ্লববাদীদের সবচেয়ে বড় ঘটনা। কিন্তু তাঁরা পুলিশ-মিলিটারিদের হাতে ধরা পড়েন এবং তাঁদের প্রাণদণ্ড হয়। এই ঘটনার পর ব্রিটিশ সরকার লক্ষ করে যে বিপ্লবী কমিউনিস্টদের একটি আদর্শ আছে, সাংগঠনিক শৃঙ্খলা আছে এবং তাঁদের মোকাবেলা করা বেশি কঠিন নয়। আর বিপ্লববাদীদের কোনো আদর্শ নেই।
তাঁদের উদ্দেশ্য ভারতে ব্রিটিশ শাসনের উত্খাত সাধন। এর জন্য তাঁরা শত্রু হত্যার কর্মনীতি নিয়ে কাজ করেন। তাঁরা অত্যন্ত দুর্ধর্ষ, তাঁদের আইনের আওতায় এনে বিচার করা এবং দণ্ড দেওয়া অনেক কঠিন কাজ। ব্রিটিশ সরকার যে নতুন ব্যবস্থা নেয় তার মধ্যে আছে, কারাগারে কমিউনিস্টদের সঙ্গে বিপ্লববাদীদের একসঙ্গে রাখা এবং কারাগারের লাইব্রেরিতে মার্ক্সবাদীদের লেখা পুস্তকাদি রাখা—যাতে এসবের মধ্যে বিপ্লববাদীরা মার্ক্সবাদীদের প্রতি আকৃষ্ট হন এবং নিজেদের আচরণ মার্জিত করেন। স্কুল-কলেজে শিক্ষার্থীদের বয়েজ স্কাউট, ব্রতচারী অনুশীলন ইত্যাদির মাধ্যমে শিক্ষার্থীদের দৃষ্টিভঙ্গি মার্জিত ও শৃঙ্খলাপ্রিয় হয়। কেবল শাস্তি দিয়ে নয়, মনোভাব পরিবর্তনের জন্য শিক্ষার এবং সেবামূলক কার্যক্রমের মাধ্যমে তাদের ব্যক্তিত্বকে নতুনভাবে গঠন করার কর্মনীতি চালু করা হয়। শাস্তিমূলক ব্যবস্থাও রাখা হয়।
ভারতের ব্রিটিশ সরকার বিপ্লববাদীদের, মার্ক্সবাদীদেরও প্রতিহত করে সন্ত্রাসবাদী বা terrorist বলে। ভারত থেকে যাঁরা লেখাপড়া করার জন্য, বিশেষভাবে ব্যারিস্টারি পড়ার জন্য যেতেন, তাঁরা আইরিশদের স্বাধীনতাসংগ্রামে যেভাবে সংগ্রাম চালাতেন, তার মধ্যে গুপ্ত সমিতি ও গুপ্তহত্যার ঘটনা দেখে, ভারতকে ব্রিটিশ শাসন থেকে মুক্ত করার এবং ভারতকে ভারতের জনগণের সমৃদ্ধিমান
রাষ্ট্ররূপে গড়ে তোলার স্বপ্ন নিয়ে চরম ত্যাগের মানসিক প্রস্তুতি নিয়ে গুপ্ত সমিতিগুলো কাজ করেছে। ব্রিটিশ-ভারতে বিপ্লববাদী ও কমিউনিস্টদের রাজনীতি কতখানি সফল হয়েছে? আজ রাষ্ট্রপতি ও উপদেষ্টামণ্ডলী নিয়ে যে সরকার কাজ করছে এবং নতুন বাংলাদেশ গঠনের সংকল্প ব্যক্ত করে এগোচ্ছে, তার সাফল্য কিভাবে কতখানি হবে, তা ওপর থেকে কিছু লোক এসে শ্রমিক-কৃষক-নিম্নমধ্যবিত্তদের অবস্থা উন্নত করে দিয়ে যাবে—এই রকম চিন্তা ও কার্যক্রমের ফল পরাধীনতা ছাড়া আর কী হতে পারে?
বিপ্লব সাধনের ঘোষণা দিয়ে এখনো যাঁরা কাজ করছেন, তাঁরা কী করবেন? অত্যন্ত নতুন প্রযুক্তির অভিঘাতে এবং সোভিয়েত ইউনিয়নের বিলোপের পরে তাদের পরিচ্ছন্ন নতুন কোনো বক্তব্য তো খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না। গণতন্ত্র, সমাজতন্ত্র, মার্ক্সবাদ, জাতীয়তাবাদ ও তার সম্পূরক আন্তর্জাতিকতাবাদ, কল্যাণ রাষ্ট্র ইত্যাদিকে ইতিহাসের গতিধারায় বিচার-বিশ্লেষণ করে নতুন আদর্শের রূপ ও প্রকৃতিকে ভাষার মাধ্যমে ফুটিয়ে তুলতে হবে। বর্তমানে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, বিশ্বব্যাংক, আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল যে গণতন্ত্র প্রচার করে, তা ‘নব্য উদার গণতন্ত্র’। আসলে এই গণতন্ত্র হলো ধনিক-বণিকদের গণতন্ত্র। আমরা যে গণতন্ত্রের প্রতিষ্ঠা চাই, তা হলো সর্বজনীন গণতন্ত্র। এসব নিয়ে লেখকদের আন্তরিক মতবিনিময় দরকার।