যুদ্ধ এবং সংঘাত একটি জনগোষ্ঠীর জীবনে গভীর ক্ষতের সৃষ্টি করে। এর মধ্যেও দরিদ্র ও প্রান্তিক মানুষের জগৎকে যুদ্ধ এবং সংঘাত একদম বিপর্যস্ত করে দেয়। যুদ্ধের ফলে বহু অমূল্য প্রাণ ঝরে যায়, খাদ্যের অভাব দেখা দেয় এবং খাদ্যনিরাপত্তা বিঘ্নিত হয়। ফলে যুদ্ধাক্রান্ত জনগোষ্ঠীর মধ্যে অপুষ্টির মাত্রা বৃদ্ধি পায়। সেই সঙ্গে যুদ্ধাক্রান্ত জনগোষ্ঠীর বাড়িঘরসহ অন্যান্য সম্পদ বিলুপ্ত হয়ে যায়, অবকাঠামো বিনষ্ট হয় এবং বিশুদ্ধ জল, বিদ্যুৎসহ বিভিন্ন সেবার জোগান ব্যবস্থা ভেঙে পড়ে। স্কুল ও হাসপাতালের কর্মকাণ্ড বন্ধ হয়ে যায়। সবচেয়ে বড় কথা, যুদ্ধ এবং সংঘাতের দেশ ও মানুষের ভবিষ্যৎ অনিশ্চিত হয়ে পড়ে।
সংঘাত এবং দারিদ্র্য উভয়ে উভয়কে বিঘ্নিত করে– সংঘাত দারিদ্র্য বাড়িয়ে দেয় এবং দরিদ্র সমাজে সংঘাতের আশঙ্কা বেশি। পারস্পরিক এই বিনষ্ট চক্রের কারণে সংঘাত ও দারিদ্র্য উভয়েই উভয়কে গভীরতর সংকটের দিকে নিয়ে যায়। অর্থনীতির ওপরে আঘাত করে এবং বৈষম্যের বিস্তার ঘটিয়ে সংঘাত অত্যন্ত প্রত্যক্ষভাবে দারিদ্র্যকে বৈরীভাবে প্রভাবিত করে। দেশের সেবা অবকাঠামোগুলো বিনষ্ট করে সংঘাত বঞ্চনা বাড়িয়ে দেয়। অন্যদিকে দারিদ্র্যের উপস্থিতি সমাজে সংঘাতের আশঙ্কা বাড়িয়ে তোলে। একটি বঞ্চিত সমাজে লভ্য সম্পদে নিজ নিজ ভাগ নিশ্চিত করার প্রক্রিয়ায় সমাজের বিভিন্ন উপগোষ্ঠী পরস্পরের সঙ্গে বিবাদে জড়ায়। সমাজে বৈষম্য, অন্তর্ভুক্তির অভাব এবং অন্যায্যতার ধারণা তীব্র হয়ে দাঁড়ায়। এর ফলে সেই বঞ্চিত সমাজে সংঘাত অনিবার্য হয়ে ওঠে।
প্রথাগতভাবে দারিদ্র্যের কথোপকথনে প্রায়ই আয় দারিদ্র্যই প্রাধান্য পায়– বিশ্লেষণাত্মক আলোচনায় এবং পরিমাপেও। কিন্তু এ কথা আজ সর্বজনস্বীকৃত, দারিদ্র্য বিষয়টি একরৈখিক কিংবা একমাত্রিক নয়। আয়বহির্ভূত বিষয়গুলোতেও বঞ্চনা থাকতে পারে। যেমন– শিক্ষায়, স্বাস্থ্যে, পুষ্টিতে, সুপেয় জলের ক্ষেত্রে কিংবা কর্মনিয়োজনে। আয়ের ঘাটতি সব সময় এসব বঞ্চনাকে প্রতিফলিত করতে পারে না। যেমন– একজন ব্যক্তি অত্যন্ত ধনশালী হতে পারেন কিন্তু তিনি যদি অশিক্ষিত হন, তাহলে আয়-দারিদ্র্যে তিনি দরিদ্র নন, কিন্তু শিক্ষা মাত্রিকতায় বঞ্চনার শিকার। সেই সঙ্গে এটাও মনে রাখা দরকার, মানব উন্নয়ন শুধু মানুষের বস্তুগত কুশলের ওপরে নির্ভর করে না, তার কণ্ঠস্বরের স্বাধীনতা, তার অংশগ্রহণের অধিকার, মানুষ-পরিবেশের ভারসাম্য ইত্যাদির ওপরেও নির্ভর করে। এগুলোর ঘাটতিও মানুষকে বঞ্চিত করে। সুতরাং চূড়ান্ত বিচারে মানব-দারিদ্র্য একমাত্রিক নয়, বহুমাত্রিক।
বহুমাত্রিক এই দারিদ্র্য পরিমাপের জন্য জাতিসংঘ উন্নয়ন কর্মসূচি এবং অক্সফোর্ড দারিদ্র্য ও মানব উন্নয়নের যৌথ প্রচেষ্টায় বেশ কয়েক বছর আগে বহুমাত্রিক দারিদ্র্যের একটি বহুমাত্রিক সূচক গঠন করা হয়েছে। স্বাস্থ্য, শিক্ষা এবং মানুষের জীবনযাত্রা মানের ১১টি সূচক (যেমন– পুষ্টি, বিদ্যালয়ে উপস্থিতি, সুপেয় জল, বিদ্যুৎ ইত্যাদি) নিয়ে এই সমন্বিত সূচক তৈরি করা হয়। এ সূচক সম্পর্কে তিনটি পর্যবেক্ষণ প্রণিধানযোগ্য। প্রথমত, সূচকটি দারিদ্র্য পরিমাপের জন্য একটি একরৈখিক পরিমাপ নয়, এটি যেহেতু বঞ্চনার অন্য দিকগুলোও ধর্তব্যের মধ্যে আনে, তাই এটি বহুমাত্রিক। দ্বিতীয়ত, যদিও বহুমাত্রিক দারিদ্র্য সূচক আয় দারিদ্র্যের তুলনায় একটি ব্যাপ্ত পরিমাপ, কিন্তু এ সূচকে আয় অন্তর্ভুক্ত না হওয়ায় এটি আসলে আয়বহির্ভূত দারিদ্র্যের ওপরেই নজর দেয়। সুতরাং আয়-দারিদ্র্য সূচকের মাধ্যমে আলাদা করে আয়ের বঞ্চনাটা বুঝতে হবে। তৃতীয়ত, বহুমাত্রিক দারিদ্র্য সূচকও শুধু মানুষের বস্তুগত কুশলকেই আমলে আনে, মানুষের কণ্ঠস্বরের স্বাধীনতা, তার অংশগ্রহণের অধিকার, মানুষ-পরিবেশ ভারসাম্যের ব্যাপারটি এ সূচকের অন্তর্ভুক্ত নয়।
সপ্তাহখানেক আগে বহুমাত্রিক দারিদ্র্যের ওপরে সাম্প্রতিক গবেষণা প্রতিবেদনটি প্রকাশিত হয়েছে। প্রকাশনা ক্রমধারায় এটি সপ্তম প্রতিবেদন। এ বছরের এই প্রতিবেদনের প্রতিপাদ্য হচ্ছে– সংঘাত এবং বহুমাত্রিক দারিদ্র্য। বিশ্বের ১১২টি দেশের জন্য বিভিন্ন সময়কালের উপাত্ত নিয়ে এ দেশগুলোর জন্য সূচকটি নির্মিত হয়েছে। গবেষণা থেকে দেখা গেছে, বিশ্বের ৬৩০ কোটির মধ্যে ১১০ কোটি মানুষ (১৭ শতাংশ) বহুমাত্রিক দারিদ্র্যের শিকার। এই ১১০ কোটি বহুমাত্রিক দরিদ্র মানুষের ৯৬ কোটি মানুষই (৮৪ শতাংশই) আবার গ্রামে বাস করে। অন্যদিকে বহুমাত্রিক দরিদ্রের মধ্যে অর্ধেকই শিশু-কিশোর, অর্থাৎ বিশ্বের প্রায় ৫৪ কোটি শিশু-কিশোর বহুমাত্রিক দারিদ্র্যের শিকার। সুতরাং চূড়ান্ত বিচারে বহুমাত্রিক দারিদ্র্যের একটি তাৎপর্যপূর্ণ গ্রামীণ ও কৈশোর মাত্রিকতা আছে।
আমরা যখন সংঘাতের সঙ্গে বহুমাত্রিক দারিদ্র্যের সম্পৃক্ততার দিকে তাকাই, তখন দেখতে পাই যুদ্ধাক্রান্ত দেশগুলোতে বহুমাত্রিক দারিদ্র্যের আপাতন ৩৪ শতাংশ, অর্থাৎ এসব দেশের প্রতি তিনজনের মধ্যে একজন দরিদ্র। ক্ষুদ্র সংঘর্ষের দেশগুলোতে এই দারিদ্র্যের আপাতন ২৩ শতাংশ। অন্যদিকে যুদ্ধ-বিগ্রহ এবং ক্ষুদ্র দেশের বাইরের দেশগুলোতে বহুমাত্রিক দারিদ্র্যের আপাতন ১০ শতাংশ। সংখ্যার দিক থেকে বিশ্বের ১১০ কোটি বহুমাত্রিক দরিদ্রের মধ্যে ৪৬ কোটি (৪০ শতাংশ) মানুষই সংঘাতসংকুল দেশগুলোতে বাস করে। এর মধ্যে ২২ কোটি মানুষ যুদ্ধাক্রান্ত দেশগুলোতে বসবাস করে।